দ্বীপটিকে দিন-রাত পাহারা দিচ্ছে হাজারখানিক মূর্তি
কবে, কখন, কীভাবে এই মূর্তিগুলো এই দ্বীপে এসেছে বা কারা এনেছে তা কারও জানা নেই। কেউ যে এই মূর্তি এখানে নিয়ে এসে বসিয়ে গেছে তাও বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ মূর্তিগুলো একেক টি বোয়িং বিমানের চেয়েও ভারী। এই মূর্তিগুলোকে বলা হয় মোয়াই।
এর মধ্যে সবচেয়ে লম্বা মোয়াই, যাকে পারো বলা হয়, সেটি প্রায় ১০ মিটার (৩৩ ফুট) উঁচু এবং ওজন ৮২ টন। সবচেয়ে ভারি মোয়াই ছিল আহু টোঙ্গারিকিতে একটি খাটো কিন্তু স্কোয়াটার মোয়াই, যার ওজন ৮৬ টন। প্রাচীন লোকগাথা অনুযায়ী, মোয়াইয়ের মূর্তিগুলো নাকি পায়ে হেঁটে ইস্টার দ্বীপের উপকূলবর্তী এলাকায় পৌঁছে যায়। দ্বীপের পূর্বপুরুষের আশীর্বাদও নাকি জড়িয়ে রয়েছে মূর্তিগুলোর সঙ্গে।
দ্বীপের সবচেয়ে কাছের জনবসতিপূর্ণ শহরও এর থেকে দু’হাজার কিলোমিটার দূরে। বিশ্বের দূরবর্তী জনবসতিপূর্ণ এলাকার মধ্যে রয়েছে এই দ্বীপের নাম রয়েছে প্রথম সারিতে। এই দ্বীপের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে প্রাচীন লোকগাথা। স্থানীয়দের দাবি, ইস্টার দ্বীপকে কড়া পাহারায় রেখেছে পাথরের তৈরি হাজারটি মূর্তি। এমনকি এই দ্বীপের উন্নতির নেপথ্যেও নাকি এই মূর্তিগুলোর আশীর্বাদ রয়েছে।
প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রয়েছে ইস্টার দ্বীপ। এই দ্বীপ চিলির অন্তর্গত। ১৯৯৫ সালে এই দ্বীপটিকে ইউনেসকো বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় জায়গা দিয়েছে। দ্বীপের উপকূলবর্তী এলাকায় পাথরের তৈরি বিশেষ মূর্তির জন্য পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় ইস্টার দ্বীপ।
আরও পড়ুন
ইতিহাসবিদদের মতে, ৮০০ থেকে ১২০০ সালের মধ্যে ইস্টার দ্বীপে লোকজন থাকতে শুরু করেন। তারা ‘রাপা নুই’ নামে পরিচিত। ১৭২২ সালে ইউরোপের নজরে পড়ে এই দ্বীপটি। সেই সময় এই দ্বীপের জনসংখ্যা ছিল দু’হাজার থেকে তিন হাজারের মধ্যে। ১৭২২ সালের ৫ এপ্রিল জ্যাকব রোগেভিন নামে ইউরোপের এক পর্যটক নাম রাখেন ইস্টার দ্বীপের। ইতিহাসবিদদের মতে, প্রশান্ত মহাসাগরে ডেভিস নামের একটি দ্বীপের সন্ধানে বেরিয়েছিলেন জ্যাকব। কিন্তু তার পরিবর্তে একটি নতুন দ্বীপের খোঁজ পান।
খ্রিস্টানদের বিশেষ পর্ব ‘ইস্টার সানডে’র দিন নতুন দ্বীপের সন্ধান পেয়েছিলেন বলে দ্বীপের ওই নামকরণ করেন জ্যাকব। ২০১৭ সালের জনগণনা অনুযায়ী, ইস্টার দ্বীপের জনসংখ্যা ছিল ৭,৭৫০। তার মধ্যে ৪৫ শতাংশ রাপা নুই সম্প্রদায়ের অধিবাসী। ইতিহাসবিদদের একাংশের দাবি, রাপা নুই সম্প্রদায়ের অধিবাসীরাই ওই পাথরের মূর্তিগুলো গড়ে তুলেছিলেন।
রাপা নুই সম্প্রদায়ের ধারণা, পূর্বপুরুষদের আশীর্বাদ তাদের বর্তমানকে আরও সুন্দর করে তোলে। জীবনযাপনে যেন কোনো রকম অসুবিধা না হয়, জমি যেন চাষবাসের যোগ্য থাকে, কোনো রোগ যেন শরীরে বাসা না বাঁধে এই সব কিছুর জন্যই নাকি মোয়াইয়ের মূর্তির মাধ্যমে তাদের পূর্বপুরুষেরা ইহজগতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে থাকেন।
প্রাচীনকালে ইস্টার দ্বীপে প্রচুর সংখ্যক তাল গাছ ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই গাছের সংখ্যা কমে যায়। ইতিহাসবিদদের মতে, পাথরের ভারী মূর্তিগুলি নিয়ে যাওয়ার জন্য তাল গাছের ডাল ব্যবহার করেছিলেন রাপা নুই সম্প্রদায়ের অধিবাসীরা। সে কারণে এত গাছ কাটা হয়েছিল যে, গাছের পরিমাণ অনেকটাই কমে যায়।
ইতিহাসবিদের মতে, ইস্টার দ্বীপে ইঁদুরের প্রকোপ ছিল খুব বেশি। ফসল নষ্ট হওয়ার নেপথ্যে অন্যতম কারণ ছিল সেটি। আগে ওই দ্বীপে যে পরিমাণ চাষবাস হত, ইঁদুরের প্রকোপে তা কমে যায়। আগেকার মতো চাষযোগ্য জমিও তেমন নেই সেখানে। আগে এই দ্বীপে বছরে সর্বাধিক ৯০ দিন পর্যটকেরা থাকতে পারতেন। ২০১৮ সালে চিলি সরকার ঘোষণা করে, পর্যটকেরা ৯০ দিনের পরিবর্তে সর্বাধিক ৩০ দিন ইস্টার দ্বীপে থাকতে পারবেন। তা-ও শুধুমাত্র সমাজ এবং পরিবেশের সঙ্গে জড়িত কাজকর্মের জন্যই। ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে ইস্টার দ্বীপে দাবানল হয়, যার প্রভাবে পাথরের মূর্তিগুলোর অনেকগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান
কেএসকে/জিকেএস