একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাত ও ২৬ মার্চের সকাল
বৃহস্পতিবার, ২৫ মার্চ, ১৯৭১। আর দশটা দিনের মতোই ঢাকা শহরের মানুষ সারাদিনের কাজ শেষে বাড়ি ফিরেছিলেন। পরিবারের সঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে গিয়েছিলেন। মা হয়তো তার ছোট্ট সন্তানকে বুকে জড়িয়ে গল্প শোনাচ্ছিলেন, পরিবারের কর্তা হয়তো রেডিওতে দেশ-বিদেশের খবর শুনছিলেন সেরাতেও।
রাত গভীর হলো, ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালির জীবনে নেমে এলো বিভীষিকাময় সেই ক্ষণ। পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হলেন লাখ লাখ মানুষ। এক্ষেত্রে তারা কিন্তু শ্রেণি বিভেদ করেনি। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, শিক্ষক, চিকিৎসক, চারকিজীবী সবাইকে হত্যা করেছে নির্বিচারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, রাজারবাগ, পুলিশলাইন, পিলখানা (বর্তমান বিজেপি সদর দপ্তর) সহ সারাদেশে চলে এই হত্যাযজ্ঞ। সাঁজোয়া ট্যাংক বহর নিয়ে পুরো ঢাকা শহরে সে রাতে মৃত্যুর তাণ্ডব চালিয়েছে তারা। যেখানে যাকেই পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে হানাদার বাহিনী। ফুটপাতে ঘুমন্ত খেটে খাওয়া সাধারণ দিন মজুরকে ছাড়েনি। আর এই গণহত্যার নাম তারা দেয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ । তৎকালীন সময় বিশ্বের প্রতিটি গণমাধ্যমে এই সংবাদ প্রচার করা হয়।
আরও পড়ুন
পরদিন অর্থাৎ ২৬ মার্চ ভোরের আলো ফুটতেই দেখা যায় লাশের স্তূপ। মানুষের ক্ষতবিক্ষত, গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়া রক্তাক্ত মানুষের মৃতদেহ পড়ে আছে যেখানে সেখানে। ঢাকা যেন এক মৃত্যুপুরী পরিণত হয় এক রাতে। শহরের বিভিন্ন জায়গায় তখনো আগুন জ্বলছে, কিংবা ধোঁয়া। যা দেখে রাতের আক্রমণের তীব্রতা বোঝা যাচ্ছিলো। ভয়ংকর নিস্তবতা নেমে আসে ঢাকার বুকে।
শহরে তখনো অনির্দিষ্টকালের কারফিউ ছিল, কোনো পরিবহণ নেই। সকালেই বেশিরভাগ মানুষ পরিচিতদের খোঁজ নিচ্ছিলেন। যেখানে টেলিফোন সক্রিয় ছিল সেখানে ফোন করছিলেন আত্মীয়,বন্ধু এবং পরিচিতদের। বিশেষ করে যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে থাকতেন। কারফিউর মধ্যেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কী হয়েছে, শেখ মুজিবের কী অবস্থা, কত মানুষ মারা গেছে-এসব জানার চেষ্টা করছিলেন অনেক মানুষ।
এর মধ্যেই ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে অলিগলি পাড়ি দিয়ে শহর ছাড়তে শুরু করেছিল মানুষজন। সবার ততক্ষণে জানা হয়ে গেছে পুরো ঢাকা শহরে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে রাতে। তাই জীবন বাঁচাতে গ্রামে চলে যেতে শুরু করে সবাই। কিন্তু এ কথা নিরীহ, সহজ সরল বাঙালি বুঝতেই পারেনি যে শুধু ঢাকা হয় পুরো দেশেই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে হানাদাররা। কোথাও নিস্তার নেই। পাকসেনা আর মৃত্যু তাদের পিছু নিচ্ছে সব জায়গায়।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক, গবেষক ও ঢাকায় থাকা মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, পঁচিশ মার্চের রাতের গণহত্যার জের ধরে ২৬ মার্চের দিনের বেলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা ও রাজারবাগের পুলিশ লাইনস এলাকায় আগুনের কুণ্ডলী দেখা যাচ্ছিল। এর মধ্যেও পরিচিতদের খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছেন অনেকে। যদিও কারফিউ থাকায় বের হওয়ার সুযোগ ছিল সীমিত।
২৬ মার্চের পরিস্থিতি নিয়ে সুফিয়া কামাল তার ‘একাত্তরের ডায়েরি’ বইতে লিখেছিলেন। সেদিন দশটার পর তিনি দিনের ঘটনাবলী তার ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘গতকাল রাত পৌনে ১২টায় হঠাৎ চট্টগ্রাম ফোন এল, ঢাকায় কোন গণ্ডগোল হচ্ছে কি না। ততক্ষণ পর্যন্ত ঢাকা শান্ত। ফোনটা রাখা মাত্র পুলের উপর মা বলে একটি আর্তনাদ শোনা গেলো, পরপর মেশিনগানের শব্দ ও জয়বাংলা শব্দের পর অবিরাম রাইফেল বোমা স্টেনগান মেশিনগান এর শব্দ, সাত মসজিদ, ইপিআর এর দিক থেকে গোলা কামানের শব্দ, জয় বাংলা আল্লাহ আকবর এর আওয়াজ ২টা পর্যন্ত হল, তারপর থেকে শুধু কামান গোলার শব্দ, রাত সাড়ে তিনটায় মিলিটারি ভ্যান বাড়ীর সামনে এসে আবার চলে গেলো’।
আরও পড়ুন
তিনি আরও লিখেছেন, ‘কাল থেকে কারফিউ জারি। শোনা যাচ্ছে, মুজিব বন্দি। ওদিক থেকে আগুনের আভা দেখা যাচ্ছে। আজ রাত দশটা পর্যন্ত। রেডিওতে ইয়াহিয়া ভাষণ দিল। আওয়ামী লীগ বন্ধ। মুজিব শর্তে আসেননি, সামরিক শাসন অমান্য করেছেন বলা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত মেশিনগানের শব্দ আসছে। মানুষের শব্দ কোথাও নেই, ঘর থেকে বের হতে পারছি না’।
মার্চের শুরু থেকেই উত্তাল ছিল সারাদেশ। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মাধ্যমে বাঙালি শপথ নিয়েছিল স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার। কিন্তু এমন হত্যাযজ্ঞ চালানোর পরিকল্পনা যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আগেই করে রেখেছে তা হয়তো টের পায়নি কেউ। শুধু বাঙালি জাতি নয় বিশ্ব ইতিহাস সবচেয়ে ঘৃণ্য গণহত্যার সাক্ষী হয় ২৫ মার্চের ‘অপারেশন সার্চলাইট’।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের ফলাফলে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ১৬৭টি, জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টি ৮৮টি এবং অন্যান্য সব দল মিলে ৫৮টি আসন লাভ করে। ১৪ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন দেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী।’
আওয়ামী লীগ ১৯৭০ এর নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাক-সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা টালবাহানা শুরু করে। লোক দেখানো বৈঠকের মাধ্যমে সময় ক্ষেপণ করে নিরস্ত্র বাঙালি নিধনের গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
১৭ জানুয়ারি ভুট্টোর গ্রামের বাড়ি সিন্ধু প্রদেশের লারকানায় ইয়াহিয়া-ভুট্টো গোপন বৈঠকের পরপরই ফেব্রুয়ারি মাসে, বাঙালির লাগাতার আন্দোলন প্রসঙ্গে ইয়াহিয়া খান হুংকার দেন, ‘কিল থ্রি মিলিয়ন অব দেম অ্যান্ড দ্য রেস্ট উইল ইট আউট আওয়ার হ্যান্ডস’। কিন্তু তিনি ১৫ মার্চ ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার প্রহসন করতে থাকেন।
এদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ২ মার্চ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে দীর্ঘ ২৩ বছরের শাসন-শোষণ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট রূপরেখা প্রদান করেন এবং ১৫ মার্চ থেকে ৩৫ দফা নির্দেশনা পালনের আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশ সারা বাংলায় অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়। পূর্ব বাংলায় বেসামরিক শাসন ব্যবস্থা পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়লে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে বারবার সমঝোতার প্রস্তাব দিতে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতার মোহ ত্যাগ করে এদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অটল থাকেন।
অন্যদিকে প্রতিদিন বিমানযোগে ঢাকায় সৈন্য আনা হতে থাকে পাকিস্তান থেকে। অস্ত্র ভর্তি যুদ্ধ জাহাজ এসে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করে। ১৭ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠক করেন। ঐদিনই প্রেসিডেন্ট ভবনে রাতে তিনি গভর্নর টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠক করেন। রাত দশটায় টিক্কা খান ১৪ পদাতিক বাহিনীর জিওসি খাদিম হোসেন রাজাকে চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। ১৮ মার্চ সকালে জেনারেল রাজা ও সামরিক উপদেষ্টা রাও ফরমান আলী ঢাকা সেনা নিবাসে জিওসির অফিসে বসে রচনা করেন নৃশংস গণহত্যার নীল নকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এর রূপরেখা।
আরও পড়ুন
কেএসকে/জিকেএস