গ্রামে গ্রামে বৈশাখী উৎসব
বছরের শেষ দিনকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করে নিতে চৈত্রসংক্রান্তি ও বৈশাখী মেলায় বাংলা ও বাঙালি মেতে ওঠে অনাবিল আনন্দে। নববর্ষের সকালে নানা রঙে সেজে শোভাযাত্রার মাধ্যমে স্বাগত জানানো হয় পহেলা বৈশাখকে। গ্রামে গ্রামে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলা বা উৎসবের। তবে অঞ্চলভেদে এ উৎসব বা মেলারও রয়েছে রকমফের।
হালখাতা
তৎকালীন রাজ পুণ্যাহই বর্তমানের ‘হালখাতা’ বা ‘গদিসাইত’। পুরনো হিসেব-নিকেষ চুকিয়ে নতুন খেরোখাতা খোলার মধ্য দিয়ে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ক্রেতা সাধারণদের আপ্যায়ন করে মিষ্টি আর নানান উপঢৌকন দিয়ে। আর হিন্দু ব্যবসায়ীরা তাদের হালখাতাকে সৌভাগ্যের নিদর্শন স্বরূপ রাঙায় সিঁদুর রঙে। অপরদিকে মুসলিম ব্যবসায়ীরা মিলাদ-মাহফিল ও দোয়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শুভ হালখাতার সূচনা করতো।
পান্তা-ইলিশ
চৈত্রসংক্রান্তির রাতে রান্না করা ভাতে পানি দিয়ে পান্তা করে রেখে পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে বিভিন্ন ধরনের মাছ বিশেষ করে ইলিশ মাছ ভাজি ও ভর্তা সহকারে খাওয়া হয়। তবে বর্তমানে পান্তা-ইলিশ বৈশাখের প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে।
গ্রামীণ মেলা
নববর্ষের একটি আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান ‘গ্রামীণ মেলা’ যা ‘বৈশাখী মেলা’ নামে ব্যাপক পরিচিত। গ্রাাম-গঞ্জের ঘাটে, মাঠে, বয়সী বটের তলায় বর্ণাঢ্য আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় এই মেলা। এক দিন থেকে শুরু করে সপ্তাহব্যাপীও এ মেলা বসে। পাশাপাশি বিনোদনের জন্য বৈশাখী মেলায় থাকে নানা আনন্দ-আয়োজন।
পূণ্যস্নান
হিন্দু পঞ্জিকা মতে দিনটিকে গণ্য করা হয় মহবিষুব সংক্রান্তি নামে। হিন্দুরা পিতৃপুরুষের তর্পণ করে থাকে, নদীতে বা দিঘীতে পূণ্যস্নান করে থাকে। শাস্ত্র ও লোকাচার অনুসারে চৈত্রসংক্রান্তির দিনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস প্রভৃতি ক্রিয়াকর্মকে পূণ্যজনক বলে মনে করা হয়।
গাজন
গাজন একটি লোকউৎসব। চৈত্র সংক্রান্তি থেকে শুরু করে আষাঢ়ি পূর্ণিমা পর্যন্ত সংক্রান্তি কিংবা পূর্ণিমা তিথিতে এ উৎসব উদযাপিত হয়। এই উৎসবের সাথে জড়িত রয়েছে বিভিন্ন পৌরাণিক ও লৌকিক দেবতাদের নাম। যেমন- শিবের গাজন, নীলের গাজন ইত্যাদি। এ উৎসবের মূল লক্ষ্য সূর্য এবং তার পতœীরূপে কল্পিত পৃথিবীর বিবাহ দেয়া। গাজন উৎসবের পিছনে কৃষক সমাজের একটি সনাতনী বিশ্বাস কাজ করে।
চড়ক
চড়ক গাজন উৎসবের একটি প্রধান অঙ্গ। এ উপলক্ষে এক গ্রামের শিবতলা থেকে শোভাযাত্রা শুরু করে অন্য শিবতলায় নিয়ে যাওয়া হয়, একজন শিব ও একজন গৌরী সেজে নৃত্য করে এবং অন্য ভক্তরা নন্দি, ভৃঙ্গী, ভূত-প্রেত, দৈত্যদানব প্রভৃতি সেজে শিব-গৌরীর সঙ্গে নেচে চলে। এ সময়ে শিব সম্পর্কে নানারকম লৌকিক ছড়া আবৃত্তি করা হয়, যাতে শিবের নিদ্রাভঙ্গ থেকে শুরু করে তার বিয়ে, কৃষিকর্ম ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ থাকে। এ উপলক্ষে মেলা বসে। অতীতে এই মেলাতে ভক্তদের শূলফোঁড়া, বানফোঁড়া ও বড়শিগাঁথা অবস্থায় চড়কগাছে ঘোরানো, কাঁটা জাতীয় গাছের শাখা-লতা কিংবা আগুনের উপর দিয়ে হাঁটা প্রভৃতি সব ভয়ঙ্কর ও কষ্টসাধ্য শারীরিক কসরত দেখানো হয়।
গম্ভীরাপূজা
চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে উত্তরাঞ্চলের অনেক স্থানে, বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চলে গম্ভীরাপূজা বা শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হয়। এ উপলক্ষে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে। দিনাজপুর জেলার বিরামপুরে তিনশ’ বছরের বেশি সময় ধরে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এ মেলায় বাঁশ, বেত, কাঠ, মাটি ও ধাতুর তৈরি বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র ও খেলনা, বিভিন্ন রকমের ফল-ফলাদি ও মিষ্টি-মিষ্টান্ন ক্রয়-বিক্রয় হয়। এছাড়া যাত্রা, সার্কাস, বায়োস্কোপ, পুতুলনাচ, ঘুড়ি ওড়ানো ইত্যাদি চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা থাকে।
আমানি
এটি একটি প্রাচীন কৃষিভিত্তিক লোকাচার। বাড়ির কর্ত্রী আমগাছের কচি পাতার একটি ডগা রাতেরবেলায় একটি মাটির ঘটিতে ভিজিয়ে রাখেন এবং পহেলা বৈশাখ সকাল বেলায় হালচাষে যাওয়ার সময় স্বামী বা ছেলের গায়ে সেই পানি ছিটিয়ে দিতেন। এতে সারা বছরের জন্য কল্যাণ হবে বলে লোকবিশ্বাস প্রচলিত আছে।
প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন
বিভিন্ন জেলা-উপজেলা শহরগুলোতে প্রশাসনসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকি পাড়া-মহল্লায় উৎসাহী তরুণ-তরুণীদের উদ্যোগে নববর্ষের সূর্যোদয়ের সাথে সাথে বৈশাখকে বরণ করে নেয়া হয়। পাশাপাশি বের করা হয় বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা। এসব শোভাযাত্রায় সমাজের সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করে। পাশাপাশি আয়োজন করা হয় আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের।
বউমেলা
ঈশা খাঁর সোনারগাঁয়ে ব্যতিক্রমী এক মেলা বসে, যার নাম ‘বউমেলা’। এই মেলা পাঁচ দিনব্যাপী চলে। প্রাচীন একটি বটবৃক্ষের নিচে এই মেলা বসে, যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পুজা হিসেবে এখানে সমবেত হয়। সন্দেশ-মিষ্টি-ধান দূর্বার সঙ্গে মৌসুমি ফলমূল নিবেদন করে ভক্তরা।
ঘোড়ামেলা
সোনারগাঁ থানার পেরাব গ্রামের পাশে আরেকটি মেলার আয়োজন করা হয়। এর নাম ঘোড়ামেলা। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে স্মৃতিস্তম্ভে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা একটি করে মাটির ঘোড়া রাখে এবং এখানে মেলার আয়োজন করা হয়। এ কারণে লোকমুখে প্রচলিত মেলাটির নাম ঘোড়ামেলা। এ মেলার অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে নৌকায় খিচুড়ি রান্না করে রাখা হয় এবং আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই কলাপাতায় আনন্দের সঙ্গে তা ভোজন করে।
এসইউ/আরআইপি