স্বপ্নভূমির অন্ধকার আগামী
ক্ষুধার মৌসুম নেই, শেষ হয়নি শিশুদের দুর্ভোগ
তখন ভরদুপুর। উত্তপ্ত সৈকতে খালি পায়ে হাঁটছিল একটি শিশু। ওর ঘর সৈকত থেকে খানিকটা দূরে। প্রতিদিন সকালে কাজের তাগিদে জাহাজঘাটে আসে। সকালে ট্রলার থেকে মাছ নামাতে হয়, দুপুরে ঘাটে জাহাজ ভিড়লে পর্যটকের বোঝা নামায় আর বিকেলে কাজ করে ফুচকার দোকানে। রাসেলের এসব কাজে সমস্যা হয়—পায়ে জুতা পরলে। সমাধান খালি পায়ে চলা। কিন্তু এত কাজের ভার বয়ে ওর পা দুটোর অবস্থা হয়েছে বেহাল। নোনা জলে ভিজে ভিজে কুঁচকে গেছে। পায়ের পাতা-গোড়ালি ফেটে যেন কষ্টের মানচিত্র এঁকেছে। প্রবালে কেটে যাওয়া ক্ষতগুলো সেরেছে ঠিকই তবে চিহ্ন থেকে গেছে। দু’পায়ে তিনটি নখের অস্তিত্বই নেই, আর বাকিগুলোতেও লাল-কালচে দাগ আটকেছে। ১২ বছরের শিশুটির পা দেখলে মনে হবে, এ যেন কোনো সত্তোরোর্ধ্ব বৃদ্ধের পা।
উপকূলের দ্বীপ-চরে জন্ম নেওয়া শিশুটিরও পাওয়ার কথা অন্যসব শিশুর মতোই সমান অধিকার। পর্যটন নগরী সেন্টমার্টিনে জন্মানো রাসেলেরও সেই অধিকারের অংশীদার হওয়ার কথা। অথচ বাস্তবতা ভিন্ন। প্রত্যন্ত জনপদের দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়াই কাল হলো ওর জীবনে। সে ছাড়াও এমন বাস্তব উদাহরণ সেন্টমার্টিনের শত শিশু।
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার ৬ নম্বর সেন্টমার্টিন ইউনিয়নটি দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। ৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দ্বীপটিতে প্রায় ১০ হাজার জনসংখ্যা, যার অধিকাংশই দরিদ্র। আর এই দরিদ্রতাই জনপদের শিশুদের স্বাচ্ছন্দ্যে বেড়ে ওঠার প্রধান অন্তরায়। অপর্যাপ্ত কর্মসংস্থান, পর্যটক নির্ভর অর্থনীতি, দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ব্যয়বহুল পণ্য পরিবহনের কারণে এই জনপদে জীবনযাত্রা চলে গরিবি হালে। এরই মধ্যে গত ১৪ মে ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় মোখার তাণ্ডবে এখানকার জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়েছে। জনপদজুড়ে এমন অর্থনৈতিক দুরবস্থার খেসারত দিচ্ছে শিশুরা।
সরেজমিনে জানা যায়, প্রতিদিন সেন্টমার্টিন সৈকতে শতশত শিশু কাঁকড়া ধরে, প্রবাল-শামুক-ঝিনুক কুড়ায়, জাল সেলাই করে, নৌকায় কাজ করে, ডাব বিক্রি করে, আবাসিক হোটেল-রিসোর্টে কাজ করে। মাছের আড়ৎ, সৈকতের ফিস ফ্রাইয়ের দোকান, রেস্তোরাঁয় কাজ করে। সমুদ্রে মাছ আহরণ, শুঁটকি তৈরি ও শুঁটকি বিক্রির সঙ্গেও যুক্ত তারা। মাত্র ২০-৪০ টাকার বিনিময়ে আগত পর্যটকদের গাইডের দায়িত্ব নেয়। সারাদিন পর্যটকদের বোঝা বহন করে। বাড়তি আয়ের আশায় পরিবারের সদস্যরাও এসব কাজে সম্মতি দিচ্ছেন।
স্থানীয়দের সাক্ষাৎকার সূত্রে জানা যায়, সেন্টমার্টিনে প্রতিদিন প্রায় ৩০০ শিশু খণ্ডকালীন শ্রমিকের কাজ করে, যাদের বয়স ৮-১২ বছর। আর বয়োজ্যেষ্ঠ শ্রমিকের মতোই ভারী ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে সরাসরি জড়িত ১২-১৮ বছর বয়সী ৩০০ শিশু। এছাড়া পর্যটন মৌসুমে নানা কাজে যুক্ত হয় কম-বেশি আরও ২০০ শিশু। পারিবারিক কৃষিকাজে পূর্ণ শ্রম দেওয়া শিশু আছে অন্তত ১০০। এসব শিশুর মধ্যে অনেকেরই স্কুলের খাতায় নাম আছে। কেউবা পরীক্ষার সময়ে গিয়ে পরীক্ষাটা দেয়। কেউ কাজে জড়ানোর ফলে আর কখনোই স্কুলে যায় না।
একাধিক শিশুর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পর্যটন মৌসুমে শিশুদের হাতেও কাজ থাকে। ওদের মধ্যে অনেকেই ভাবে, মৌসুম শেষে ফের স্কুলে ফিরবে। অথচ পেটের ক্ষুধার যে মৌসুম নেই, ফলে শেষ হয় না দুর্ভাগ্যের মৌসুম। একসময় স্কুলের গণ্ডি থেকে ওদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। নগদ কিছু আয়ের সুযোগ পেয়ে শিশুরা লেখাপড়ায় উৎসাহ হারায়। অবশেষে ঝরে পড়াদের তালিকায় ওদের জায়গা হয়।
এমন প্রমাণ মো. মিলন (১০)। দিনভর মাছের আড়তে কাজ করে সে। মিলন বলে, ‘ভাই-বোনদের মধ্যে আমি বড়। আমার ছোট আরও দুটি ভাই-বোন আছে। গরিব পরিবারের সবার লেখাপড়া সম্ভব হয় না। গত দুই বছর হলো লেখাপড়া ছেড়েছি। এখন আমি কাজ করি। তবে আমার ছোট ভাইটাকে এ বছর ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করে দিয়েছি।’
দ্বীপজুড়ে শিশুশ্রমের এমন দশার কারণ পারিবারিক অনটন। তবে শুধু অর্থনৈতিক সংকটই শিশুদের এমন অবস্থার জন্য দায়ী নয়। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের মধ্যে বিদ্যমান সংস্কার, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, বাল্যবিয়ের প্রবণতাসহ নানা কারণে নষ্ট হচ্ছে শিশুদের আগামী। জন্ম নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক পরিষ্কার ধারণা নেই এখানকার অধিকাংশ নারী-পুরুষের। জানা নেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির কুফল সম্পর্কেও। ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে পরিবারের সদস্য। পাশাপাশি বৃদ্ধি পাচ্ছে চাহিদা ও সংকট।
দ্বীপ ঘুরে দেখা যায়, এখানকার অধিকাংশ পরিবারে চার থেকে পাঁচজন সন্তান। খাদ্যচাহিদা পূরণের পর এত সন্তানের অন্যসব প্রয়োজনীয়তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। ফলে শিশুগুলো পরিবারের বোঝায় পরিণত হয়। তখনই নিজের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি পরিবারের দরকারে ওরা অর্থসংস্থান খোঁজে। জড়ায় কষ্টসাধ্য কাজে। শেষমেশ অন্ধকারেই বেঁচে থাকার চেষ্টা চলে।
দ্বীপের শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা থেকেও। স্থানীয় দোকান থেকে জ্বর-ঠান্ডায় নাপা-প্যারাসিটামল, কাশি হলে তুসকা, ডায়েরিয়ায় স্যালাইন, শরীর দুর্বল হলে সিনকারা পর্যন্তই ওদের স্বাস্থ্যসেবার দৌড়। এসব ওষুধের প্রতিক্রিয়া-পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া জানা নেই ওদের। তবুও ওষুধ খায়, যেন মুখস্থ ফার্মাসিস্টের অসুস্থ ডাক্তারি। অর্থাভাব, দুর্লভ চিকিৎসা ব্যবস্থা, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শের সুযোগ না থাকা, চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব, ওষুধের আকাশচুম্বী দাম ও অপর্যাপ্ততার কারণে চিকিৎসাবঞ্চিত হচ্ছে এ জনপদ। একজন চিকিৎসক ও দুজন নার্স দিয়েই চলছে দ্বীপের একমাত্র স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। উৎসব-পারিবারিক-ব্যক্তিগত-সাপ্তাহিক ছুটিসহ নানা কারণে সেই চিকিৎসকও উপস্থিত থাকেন না প্রায়ই।
যখন খুনসুটিতে সময় কাটানোর কথা, খেলাচ্ছলে মুখর হবে জীবন, তখন শিশুরা কেন টাকার খোঁজে নামছে? সেন্টমার্টিনের গলাচিপা বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম জানান, শিশুরা টুকটাক আয়ের আশায় সৈকতে ঘোরাঘুরি করে। ছোট ছোট কাজ করে পরিবারের জন্য রোজগার করে। এতে পরিবারও একটু উপকৃত হয়। দেশের অন্য অঞ্চলের মতো এখানে সারাবছর কাজ থাকে না। পর্যটন মৌসুম ছাড়া বাকি সময়ে ৫০ শতাংশ মানুষ কর্মহীন থাকে। ফলে পরিবারের সদস্যদের পেট চালাতে শিশুরাও কাজে জড়ায়। এজন্য আমরা নই, আমাদের পরিস্থিতি দায়ী।
সেন্টমার্টিনের সন্তানদের মধ্যে লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন এমন গুটিকয়েক উদাহরণের একজন অ্যাডভোকেট এম. কেফায়েত উল্লাহ খান। এ দ্বীপের বংশোদ্ভূতদের মধ্যে ঢাকা জজকোর্টের প্রথম ও একমাত্র আইনজীবী তিনি। কীভাবে একটি শিশুবান্ধব সেন্টমার্টিন গড়া যায়? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এখানকার জনপদকে জাপটে ধরেছে দরিদ্রতা। একটু বাড়তি আয়ের আশায় পরিবারের সদস্যরাও শিশুদের কষ্টসাধ্য কাজে সম্মতি দিচ্ছেন। তাই শিশুদের সুন্দর জীবনের নিশ্চয়তা আনয়নে প্রথমে তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা উন্নত করতে হবে। পারিবারিক সচ্ছলতা আনতে পারলেই শিশুদের নিয়ে তারা উন্নত চিন্তা করবে। হয়তো সেই উন্নত চিন্তাই একদিন এসব শিশুর জন্য সুন্দর ভবিষ্যৎ আনবে।
অ্যাডভোকেট কেফায়েত বলেন, ‘প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিন হাজারো পর্যটক সেন্টমার্টিনে আসেন। পর্যটককেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য করে অনেকে কোটিপতি বনে গেলেও দ্বীপের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে কারও মাথাব্যথা দেখিনি। দ্বীপের শিশুদের জীবনব্যবস্থা মারাত্মক পিছিয়ে পড়েছে। বিশেষ করে দ্বীপের দক্ষিণ পাড়ায় বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ-পরিবেশ থেকেই বঞ্চিত। দ্বীপের একটিমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অঞ্চলটি থেকে অনেক দূরে। ফলে সে পাড়ার শিশুরা পড়ালেখা থেকে ছিটকে যাচ্ছে। এতে সামগ্রিক শিক্ষায় পিছিয়ে যাচ্ছে সেন্টমার্টিন।
প্রাথমিক শিক্ষাই দুর্লভ, উচ্চশিক্ষা কেবল বিলাসিতা
কথায় বলে, ‘জ্বলন্ত প্রদীপের নিচে বসত করে অন্ধকার’। এর বাস্তব উদাহরণ সেন্টমার্টিন। পর্যটনের মাধ্যমে এ দ্বীপে প্রতি বছর কোটি টাকা রাজস্ব এলেও শিক্ষাবঞ্চিত থেকে যাচ্ছে শিশুরা। শিক্ষাক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনায় পিছিয়ে যাচ্ছে আগামীর সেন্টমার্টিন। বর্তমানে এ দ্বীপের শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষা যেন ‘স্বপ্ন’। দরিদ্র শ্রেণির মানুষের কাছে শিক্ষা এক প্রকার বিলাসিতা। ভাবতে অবাক লাগলেও সত্য, পর্যটন নগরীখ্যাত এ ভূখণ্ডের শিশুরা হারিয়ে যাচ্ছে শিক্ষাহীন অন্ধকার জগতে।
শিক্ষাক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সুযোগের অভাব ও সীমাহীন বৈষম্যের শিকার সেন্টমার্টিনের শিশুরা। সমগ্র দেশের তুলনায় শিক্ষাক্ষেত্রে বহুগুণ পিছিয়ে পড়েছে দ্বীপটি। দ্বীপে লেখাপড়ার উপযোগী শিশু-কিশোরের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। এর মধ্যে তিন-চতুর্থাংশ শিশুই বিদ্যালয়ে যায় না। সব মিলিয়ে এখানকার চারটি বিদ্যালয়ে পড়ছে কমবেশি ৭০০ শিক্ষার্থী। অবশিষ্ট দুই থেকে আড়াই হাজার শিশু-কিশোর শিক্ষাবঞ্চিত।
বর্তমানে দেশের প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় খুঁজে পাওয়া যাবে একাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়। তবে সেন্টমার্টিনের প্রেক্ষাপট পুরোটা ভিন্ন। আট কিলোমিটারের এত বড় দ্বীপে প্রাথমিক বিদ্যালয় মাত্র তিনটি। একটি সরকারি, একটি বেসরকারি ও অন্যটি এনজিও পরিচালিত। জিঞ্জিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কোনাপাড়া বেসরকারি প্রাথমিক ও দক্ষিণপাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামক তিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩৫০জন।
প্রকট শিক্ষক সংকট এখানকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে। বলতে গেলে, শিক্ষকের অভাবেই বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর প্রাথমিকেই ঝরে যায়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে আটটি পদের বিপরীতে শিক্ষক আছেন মাত্র তিনজন। তাদের একজন আবার দাপ্তরিক কাজে টেকনাফে থাকেন। এছাড়া ৯ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণপাড়ার এনজিও পরিচালিত স্কুলটির বরাদ্দ শেষ। তাই স্বেচ্ছাসেবী একজন শিক্ষকের স্বেচ্ছাশ্রমে সপ্তাহে দুই-একদিন খোলা হয়। কোনাপাড়ার বেসরকারি প্রাথমিকটিতেও মাত্র ২-৩ জন শিক্ষক। দরিদ্র জনপদ থেকে প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় আয় হয় না, শিক্ষকদের বেতনের টাকাও ওঠে না। ফলে কর্মরত শিক্ষকরাও এখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
সেন্টমার্টিনের একাধিক শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জীবনযাত্রায় অতিরিক্ত ব্যয়ভারের কারণে শিক্ষকরা এখানে স্থায়ী হতে চান না। শিক্ষকের যে বেতন, তা দিয়ে কুলোয় না। পর্যটকের উপচেপড়া ভিড়ের কারণে এখানে সবকিছুর দাম বেশি। টেকনাফে যে পণ্যটির দাম ২০০ টাকা, সেই পণ্যটি সেন্টমার্টিনে ৪০০ টাকা। এ কারণেই এখানকার শিক্ষকতা পেশাটি এখন ঝুঁকিতে।
শুধুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর শিক্ষক স্বল্পতাই নয়। শিক্ষাসুলভ পরিবেশ থেকেও বঞ্চিত দ্বীপের শিশুরা। শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান আরেকটি সমস্যার কথা জানালেন স্থানীয় দক্ষিণপাড়া সাত নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মোহাম্মদ জলিল। তিনি জানান, সেন্টমার্টিনের স্কুলগুলো দূরবর্তী হওয়ায় বেহাল রাস্তা আর যানবাহন সংকটের কারণে যাওয়া কষ্টকর। বর্ষাকালে কোনোভাবেই শিশুরা স্কুলে যেতে চায় না। এসব কষ্টের কারণে শিশুরা স্কুলে যেতে আগ্রহ হারাচ্ছে। প্রতিনিয়ত স্কুলের প্রতি অবহেলা বাড়ছে। স্কুলের সময়ে স্কুলে না গিয়ে সৈকতে কিংবা বনে-জঙ্গলে ঘোরাফেরা করে।
মোট ৯টি গ্রামের এত বড় দ্বীপে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সুযোগ। এ দ্বীপের মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ালেখার একমাত্র অবলম্বন শিক্ষাঙ্গনটি। সেন্টমার্টিন বিএন ইসলামিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামের শিক্ষাঙ্গনটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯০ সালে। এখানে বর্তমান শিক্ষার্থী ৩৬৩ জন। এর মধ্যে মেয়ে ১৭৯ জন। সূত্র বলছে, এই বিদ্যালয় থেকে ২০২৩ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ৪২ শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে পাস করে ২৪ জন, যার ১০ জন ছেলে, ১৪ জন মেয়ে। ২০২২ সালে এসএসসি দিয়েছে ৬৩ জন। এদের মধ্যে ৫৭ শিক্ষার্থী পাস করেছে। যার মধ্যে ৩৪ জন ছেলে, ২৭ জন মেয়ে। ২০২১ সালেও এসএসসিতে অংশ নিয়েছে ৫৭ জন। এদের মধ্যে পাস করেছে ৪৩ জন। যার ২৮ জন ছেলে ও ১৫ জন মেয়ে। তবে তাদের অনেকেরই লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। ২০২২ ও ২০২১ ব্যাচে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানটিতে যথাক্রমে ১৭ ও ১৩ জন শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়। আবার গুটিকয়েক শিক্ষার্থী দ্বীপের বাইরে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছে। বাকিরা কে-কোথায় ভর্তি হয়েছে কিংবা পড়ালেখা করছে কি না তার সঠিক তথ্য মেলেনি।
শিক্ষক স্বল্পতার চিত্র এখানেও। শিক্ষাঙ্গনটিতেও মাধ্যমিক শিক্ষকের পদ ১৭টি হলেও নিয়োগপ্রাপ্ত আছেন ১৪ জন। এদের মধ্যে পরিবার নিয়ে দ্বীপে বাস করেন মাত্র ৫-৬ জন শিক্ষক। বাকিরা টেকনাফ থেকে এসে পাঠদান করেন। পাশাপাশি কলেজ শাখায় শিক্ষক মাত্র একজন, অধ্যক্ষ নিজেই। ফলে উচ্চ মাধ্যমিকে মানবিক শাখা ছাড়া অন্য শাখায় শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ নেই।
এছাড়া আছে একটি কওমি মাদ্রাসা। সেখানেও নামকাওয়াস্তে লেখাপড়া করে কয়েকজন। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি-এইচএসসি রেজিস্ট্রেশন করেও অনেকেই আর পরীক্ষা দেয় না। কারণ দ্বীপে কোনো পরীক্ষা কেন্দ্র নেই। যারা এ দুটি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে, তাদের ৯ কিলোমিটার সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে সুদূর টেকনাফে যেতে হয়। আবার পরীক্ষা চলাকালে কেউ কেউ টেকনাফে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকছেন। ফলে অনেকেই এসব খরচের অভাবে বিড়ম্বনায় পড়ে। যাদের সামর্থ্য নেই, তারা এসএসসি পরেই লেখাপড়ায় উৎসাহ হারায়। শেষমেষ অধরাই রয়ে যায় উচ্চশিক্ষা।
অর্থনীতির কষাঘাতে পিষ্ট হয়ে কোনোমতে টেনেটুনে হাইস্কুলের বা কলেজের গণ্ডি পাড় হওয়া শিক্ষার্থী আর উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায় না। সবচেয়ে বড় বিপত্তির মধ্যে পড়ে দরিদ্র পরিবারের মেয়েশিশুরা। দ্বীপে অনার্স বা ডিগ্রি পর্যায়ে পড়ালেখার সুযোগ না থাকায় দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা আর লেখাপড়া করে না।
শিক্ষাব্যবস্থার করুণ দশার কারণ জানতে চাইলে সেন্টমার্টিন বিএন ইসলামিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহজালাল সরকার বলেন, ‘দ্বীপের শিক্ষাব্যবস্থায় আশানুরূপ উন্নয়ন হচ্ছে না। মূলত দ্বীপের প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্র অপূর্ণ-অগোছালো থাকায় এ অবস্থা। দেখা যায়, বয়স কিংবা বাস্তব বুদ্ধিমত্তার কারণে হলেও একজন মাধ্যমিক শিক্ষার্থী দূরপথ পাড়ি দিয়েও স্কুলে আসে। তবে স্কুল দূরে হলে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য যাতায়াত সম্ভব হয় না। এতে আস্তে আস্তে প্রাথমিকে থাকাকালীন অবস্থাতেই শিশুরা ঝরে যাচ্ছে।’
অধ্যক্ষ যোগ করেন, ‘শিক্ষক স্বল্পতার কারণেও দ্বীপের শিশুদের পড়ালেখার মানোন্নয়ন হচ্ছে না। এমনও শিক্ষার্থী ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হতে আসে—যারা বানান না করে পড়তে পারে না, কেউ কেউ স্বাভাবিক পাঠ্য বিষয়গুলো সস্পর্কেও ধারণা রাখে না। এছাড়া স্থানীয়দের অধিকাংশ পরিবার দরিদ্র হওয়ায় শিক্ষকদের বেতন-খরচের টাকাও আসে না। ফলে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থসংকটে ধুকে ধুকে মরে।’
এ বিষয়ে সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, ‘ইউনিয়নের প্রায় তিন হাজার ছেলেমেয়েকে শিক্ষিত করতে দ্বীপের দক্ষিণপাড়া, পূর্বপাড়া ও ডেইলপাড়ায় আরও তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন জরুরি। না হলে সরকারের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমের সফল বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। পাশাপাশি শিক্ষক সংকট নিরসনসহ অন্য অসুবিধা নিরসনে যথাসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছি। তবে শেষমেষ সমস্যা হয়ে সামনে দাঁড়ায় অভিভাবকদের অসচেতনতা আর অর্থহীনতা। সেন্টমার্টিনের শিশুদের জীবনব্যবস্থার পরিবর্তন চাইলে অনেক চিত্রের পরিবর্তন করতে হবে। বিষয়গুলো সমাধানে আমরা কাজ করছি।’
স্থানীয় সুশীল সমাজের একাধিকজন মনে করেন, আগামী দিনের সেন্টমার্টিনকে আধুনিক বাংলাদেশের একটি অংশ হিসেবে পরিণত করতে চাইলে, এখানকার শিক্ষাক্ষেত্রে নজর দিতে হবে। শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ বিনির্মাণ ও সামাজিক সচেতনতা আনয়নে দেশের সরকারের পাশাপাশি সবাইকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। এমন উদ্যোগ এখনই না নেওয়া হলে আমাদের স্বপ্নদ্বীপ শিক্ষাহীন অন্ধ নগরীর উদাহরণে পরিণত হবে।
এসইউ/জিকেএস