ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

প্রধানমন্ত্রী সংগ্রহালয়: এক ছাদের নিচে নেহেরু থেকে মোদী

আসিফ আজিজ | ভারত থেকে | প্রকাশিত: ১১:৫০ এএম, ২০ অক্টোবর ২০২৩

গেট দিয়ে ঢুকেই বিশাল একটি মাঠ। চারপাশে বড় বড় গাছ। মাঠ থেকে ঠিকরে বের হচ্ছে সবুজ আভা। দুটো ময়ূর সামনে দিয়ে ছুটে ঢুকে গেলো পাশের ঘন জঙ্গলে। একদল বানরও কোথা থেকে যেন দৌড়ে এসে ঝগড়া শুরু করলো পাকড়া গাছের ডালে ঝুলে। মাঠ পেরিয়ে যে পুরোনো ভবনটি দেখা যাচ্ছিল সেটি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর বাড়ি। যেটি তার মৃত্যুর পর নেহেরু সংগ্রহশালা হিসেবে ব্যবহার হতো। এ মাঠেই একসময় ছিল ভারতের মহান এ নেতার পদচারণা।

চলতি বছর নতুন নাম পেয়েছে এ সংগ্রহশালা। এখন একক কোনো ব্যক্তি নয়, এটি পরিচিত হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী সংগ্রহালয় হিসেবে। নরেন্দ্র মোদী পর্যন্ত ভারতের ১৫ জন প্রধানমন্ত্রীর জীবন, কর্ম, অবদান, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের দেওয়া তাদের উপহার সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে এখানে। ২৭১ কোটি রুপি ব্যয়ে নতুন করে সাজানো এ সংগ্রহালয়ে পরতে পরতে ব্যবহার করা হয়েছে প্রযুক্তি।

jagonews24

ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের প্রতিকৃতি

কলকাতার যাদবপুরের মেয়ে প্রতিভা ভারত সফররত সাংবাদিক প্রতিনিধিদলের সদস্যদের দুই ভাগে বিভক্ত পুরো সংগ্রহালয়টি ঘুরিয়ে দেখালেন। পুরোনো ভবন, মানে দিল্লির চানক্যপুরীর তিনমূর্তি ভবন হিসেবে যেটা পরিচিত সেখানেই থাকতেন নেহেরু। এখানেই তার মৃত্যু হয়।

আরও পড়ুন: ব্যস্ত শহরে আদি গ্রাম ‘ভিলেজ মিউজিয়াম’

প্রথম কক্ষে স্মরণ করা হয়েছে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদকে। ঢুকলেই মনে হবে তিনি টেবিলে বসে কাজ করছেন। রয়েছে বিভিন্ন ভাষায় লেখা ভারতের সংবিধান ও মূল সংবিধানের একটি কপি। দ্বিতীয় তলায় সংরক্ষণ করা হয়েছে নেহেরুর শয়নকক্ষ। সাধারণ জীবনযাপন করা নেহেরুর ব্যবহৃত আসবাব থেকে শুরু করে প্রায় সব জিনিসেই রাখা হয়েছে সাজিয়ে। দিল্লির এ বাড়িতে তিনি ছিলেন প্রায় ১৬ বছর।

jagonews24

জওহরলাল নেহেরুর পড়ার টেবিল

অপর একটি কক্ষে নেহেরুর রিডিং রুম। যে রুমের টেবিলে বসা ছবি সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। টেবিল, চেয়ার, বইপত্র এমনভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে মনেই হয় না এখানে কেউ থাকেন কিংবা ব্যবহার করেন না। স্বল্প আলোয় এখনো বেশ জীবন্ত সেসব স্মৃতি। ড্রয়িংরুমে সোফা, টেবিল, ওয়ালম্যাট, বেড টেবিল সেভাবেই সংরক্ষিত। খুব জাঁকজমকপূর্ণ জীবন যে তিনি কাটাতেন না তা তার ঘর দেখলেই অনেকটা স্পষ্ট হয়।

এর পরের কয়েকটি কক্ষজুড়ে রাশিয়া, নেপাল, ওমান, মরিশাস, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ব্রিটেনসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছ থেকে নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী, অটল বিহারী বাজপেয়ী ও নরেন্দ্র মোদীর পাওয়া বিভিন্ন স্মারক সংরক্ষণ করা হয়েছে। রয়েছে ভারতের প্রথম ডিজাইন করা জাতীয় পতাকা।

jagonews24

বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছ থেকে পাওয়া উপহার

আরও পড়ুন: বাংলাদেশে সৌরশক্তির ব্যবহার বাড়াতে কাজ করছে ভারত

জওহরলাল নেহেরুর মেয়ে ভারতের দুইবারের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও ছিলেন এ বাড়িতে। সংরক্ষণে রাখা হয়েছে তার কক্ষটিও। তার কক্ষটি পেরিয়ে আবার সংরক্ষিত বেশ কিছু স্মারক উপহার।

নিচে নেমে ঘর পেরিয়ে পেছনে তৈরি করা হয়েছে অত্যাধুনিক নতুন ভবন। সব মিলে প্রায় ১০ হাজার বর্গমিটার জমিতে এ জাদুঘর বা সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠিত। ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রীদের অবদানও যেন এখানে সংরক্ষণে রাখা হয় সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। দ্বিতীয় ভবনটি বেশ নান্দনিক, খোলামেলা। এসব ভবন কোনো গাছ না কেটেই করা হয়েছে বলে জানানো হয়। প্রকৃতিকে প্রকৃতির মতো থাকতে দিয়ে গড়া হয়েছে ভবন।

jagonews24

ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের প্রতিকৃতি

নতুন ভবন মানেই প্রযুক্তি। ভারত যে প্রতিদিন প্রযুক্তিখাতে কত বেশি এগিয়ে যাচ্ছে তার সংক্ষিপ্ত ধারণা পাওয়া যাবে এ ভবনে গেলেও। ঢুকেই প্রথমে বামে চোখে পড়বে ভারতের জাতীয় প্রতীক অশোকের সিংহ স্তম্ভ। তবে এখানকার বিশেষত্ব হলো প্রতীকটি ভালো করে দেখলে বুঝতে পারবেন এটি শূন্যে ভাসছে। ম্যাগনেটিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এটি করা হয়েছে। এবং ভারতবর্ষে এটি প্রথম।

আরও পড়ুন: যে কারণে ইভিএমে আস্থা ভারতের মানুষের

ডানে চলে গেছে একটি ছোটখাটো টানেল। সেখানে দুপাশজুড়ে ১৫ জন প্রধানমন্ত্রীর বিশালাকৃতির ছবি শোভা পাচ্ছে। ওপরেও ব্যবহার করা হয়েছে বিশেষ প্রযুক্তি। ঘুরতে ঘুরতে যেন ক্লান্ত না হোন সেজন্য ফাঁকে ফাঁকে রাখা হয়েছে বেঞ্চ। কিছু ভিডিও ডকুমেন্টারিও দেখা যায় তাতে বসে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি ভিডিও সেখানে প্রদর্শিত হয় নিয়মিত।

jagonews24

জওহরলাল নেহেরুর শয়নকক্ষ

দোতলায় উঠে তাক লাগাবে ওপর থেকে নিচে ঝুলতে থাকা কিছু কাচের বল। খালি চোখে বুঝতে একটু সমস্যা হলেও মোবাইলে ছবি তুলতে গেলেই বুঝতে পারবেন এটি আসলে মুরারি দেশাইয়ের প্রতিকৃতি। এত নিখুঁতভাবে এভাবেও প্রতিকৃতি তৈরির কথা ভাবা যায় ভাবতেই অবাক লাগে।

গুলজারি লাল নন্দা দুইবারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ১৩ দিন করে। ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তাকেও স্মরণ করতে ভোলেনি কর্তৃপক্ষ। রাখা হয়েছে তার ছোট একটি গ্যালারি। পরের গ্যালারিটা লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর। তার মৃত্যুর পর বিভিন্ন পত্রিকায় কীভাবে খবর বেরিয়েছিল তার কাটিং ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে দেওয়ালে। শ্বশুরবাড়ি থেকে বিয়ের সময় দেওয়া একটি চরকাও রয়েছে সংরক্ষিত। বলা হয় এটি শ্বশুরবাড়ি থেকে নেওয়া তার একমাত্র উপহার।

jagonews24

মুরারি দেশাইয়ের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি

এর পরেই ইন্দিরা গান্ধী গ্যালারি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে আছে, থাকবে। ইন্দিরা গান্ধীর বিভিন্ন রাজনৈতিক পদক্ষেপ, কাজ অডিও ভিজ্যুয়াল ও স্থিরচিত্রে দেখানো হয়েছে। তার মৃত্যু হয় আততায়ীর হাতে। সেই চিত্র ভিডিওর মাধ্যমে সারাক্ষণ চলে। মৃত্যুর পর রাহুল ও প্রিয়াঙ্কাকে দেখা যায় রাজীব গান্ধীর সঙ্গে কান্নায় ভেঙে পড়তে।

আরও পড়ুন: সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মূলমন্ত্র ‘বিশ্বাস’

এর পরেই রাজীব গান্ধী গ্যালারি। মা ইন্দিরা গান্ধীর মতো তারও স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। রয়েছে সে ইতিহাস। এখানেই মাথার ওপরে নিয়ন আলোয় ভাসছে বিশাল এক অশোক চক্র। নিচে প্রায় ১০ ফুটের বেশি উঁচু দুটি হাত। এই দুই হাত দেশের প্রধানমন্ত্রীর হাত। যার ওপর নির্ভর করে গোটা ভারতবর্ষ।

jagonews24

মিলখা সিং

নিচে নেমে অনেকটা প্যাঁচানো এক গ্যালারি দিয়ে নিচের দিকে নামতে হয়। তার আগে রয়েছে বেশ কিছু অ্যাক্টিভিটিসের সুযোগ। যেমন কোনো প্রধানমন্ত্রীর পাশে বসে ছবি চাইলে প্রযুক্তি জীবন্ত রাজীব কিংবা নেহেরুকে পাশে বসিয়ে ছবি তুলে দেবে। তবে সময়ের স্বল্পতায় সে সুযোগ হয়নি আমাদের। নিচে নামার পুরো পথজুড়ে বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিকভাবে ভারতকে সম্মান এনে দেওয়া মিলখা সিং থেকে শুরু করে পণ্ডিত রবিশঙ্কর কিংবা কপিল দেবকেও, স্মরণ করা হয়েছে ছবির মাধ্যমে। একপাশে আবার রয়েছে ইন্দিরা গান্ধীর বিভিন্ন বয়সের ছবি।

jagonews24

অশোক চক্র

এভাবেই অসাধারণ দর্শনে ভর করে সাজানো হয়েছে গোটা সংগ্রহালয়। দেশের নতুন প্রজন্ম যেন এক ছাদের নিচে দাঁড়িয়ে দেশ গড়া নেতাদের জানতে পারে, বুঝতে পারে সেজন্য নেহেরু সংগ্রহশালা থেকে একে রূপান্তর করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী সংগ্রহালয়ে।

এএসএ/বিএ/এমএস