মৃত্যুর ১১০ বছর পরও কবরে ঠাঁই হয়নি, রয়েছেন মমি হয়ে
সময়টা ১৬৮৮ সাল। গ্রেটার ম্যানচেস্টারের এক বিত্তশালী পরিবারে জন্মেছিলেন হান্না বেসউইকের। বিত্তশালী পরিবারের সন্তানরা যেভাবে বিলাসিতার মধ্যে বড় হয় হান্নাও তেমনি বেড়ে উঠছিলেন। তবে এর মধ্যে তার বড় ভাই জন বেসউইক বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর কোমায় চলে যান।
সেই সময়টা অর্থাৎ ১৭ শতকের শেষ ভাগ থেকে ১৯ শতকের শেষ পর্যন্ত কোমায় যাওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল অনেক। সেসময় চিকিৎসকরা খুব বেশি পরীক্ষা না করেই কোমায় থাকা রোগীকে মৃত ঘোষণা করে দিতেন। কোমায় চলে যাওয়া বহু রোগীকেই মৃত ভেবে কবর দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে সেসময়। চিকিৎসক জে.সি ওসেলি ১৮৯৫ সালে তার এক লেখায় দাবি করেন যে, ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে প্রতি বছর প্রায় ২৭০০ মানুষকে জীবিত সমাধি দেওয়া হত। তবে জে. স্টেনসন হুকার মনে করেন এই সংখ্যা ছিল ৮০০এর কাছাকাছি।
এই তালিকার মধ্যে ছিলেন হান্নার বড় ভাইও। হান্নার ভাইকেও মৃত ভেবে কফিনবন্দি করা হয়েছিল। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আগে শোকার্ত আত্মীয়স্বজনদের নজরে পড়ে, কফিনবন্দি জনের চোখের পাতা নড়ছে। পরীক্ষার পর জনকে জীবিত বলে ঘোষণা করেন বেসউইক পরিবারের চিকিৎসক চার্লস হোয়াইট। তবে এর কিছুদিন পর স্বাভাবিকভাবেই জনের মৃত্যু হয়েছিল।
তবে এই ভয় ঢুকে গিয়েছিল ছোট্ট হান্নার মনে। ভাইয়ের মতো তাকেও ভুল করে জীবন্ত অবস্থায় কফিনবন্দি করা হবে। এমনই দুঃস্বপ্ন দেখতেন হান্না। তবে হানাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়নি। বরং তাকে মমি করে রাখা হয়েছিল। মৃত্যুর ১১০ বছর তিনি মমি হতে জমিনের উপরেই ছিলেন।
১৭০৬ সালে জন বেসউইকের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অগাধ সম্পত্তির মালিক হন তার বোন হান্না। সে সময় থেকেই হলিউডের বারচেন বাওয়ান নামের এক প্রাসাদোপম বাড়িতে থাকতেন তিনি। তবে ভাইয়ের ওই ঘটনার পর জীবন্ত কফিনবন্দি হওয়ার ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতেন হান্না।
তার সঙ্গে যেন কেউ এমন কিছু করতে না পারে সেজন্য একটি বুদ্ধি বের করে হান্না। একটি দলিল তৈরি করেন। ১৭৫৭ সালের ২৫ জুলাই, তার মৃত্যুর বছরখানেক আগে পারিবারিক চিকিৎসক চালর্সের তত্ত্বাবধানে দলিলটি করেন তিনি। চার্লসের কাছে হান্নার আবেদন ছিল, মৃত্যুর পর যেন তার শরীর জমির উপরে রাখা হয়। দেহটির নিয়মিত পরীক্ষা করার আর্জিও জানিয়েছিলেন হান্না। যেন কোনোভাবেই তাকে ভুল করে জীবন্ত কবর না দেওয়া হয়।
নিজের দলিলে তিনি লিখিতভাবে এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন চার্লসের উপরই। খুবই সোজাসাপ্টা অনুরোধ হলেও অর্থের লোভেই নাকি ফায়দা তুলেছিলেন চার্লস। ১৭৫৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে মৃত্যুর বছরখানেক আগে ওই দলিলের মাধ্যমে নিজের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার খরচ হিসাবে ৪০০ পাউন্ড (বর্তমান বাজারমূল্যে প্রায় ৫৩ লাখ টাকা) রেখে গিয়েছিলেন হান্না। সেই সঙ্গে চালর্সের জন্য ১০০ পাউন্ডও (বর্তমান বাজারমূল্যে প্রায় ১৩ লাখ টাকা) বরাদ্দ করেছিলেন। দলিলটি কার্যকর করার জন্য আরও ৪০০ পাউন্ড রাখা ছিল চার্লসের জন্য। অন্ত্যেষ্টির খরচ মিটিয়ে বেঁচে যাওয়া অর্থ চার্লস নিতে পারবেন বলে লিখে গিয়েছিলেন হান্না।
দলিল তৈরির পর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার খরচের পুরো অর্থই হাতানোর ছক কষেছিলেন চার্লস। মৃত্যুর পর হান্নাকে তিনি মমি করে রেখে দিয়েছিলেন। যদিও হান্নার দলিলে কোথাও তাকে মমি করে রাখা হোক এমন কিছুর উল্লেখ নেই। আর্থিক কারণ ছাড়াও হান্নাকে মমি করে রাখার পেছনে চার্লসের আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল। চার্লসের সংগ্রহে একাধিক মমি ছিল। সেই সংগ্রহে আরও একটি মমি রাখার লোভ সামলাতে পারেননি তিনি।
মনে করা হয়, অঙ্গব্যবচ্ছেদে দক্ষ উইলিয়াম হান্টারের কাছে মমি তৈরির খুঁটিনাটি শিখেছিলেন চার্লস। মমি তৈরির প্রক্রিয়ায় প্রথমে মৃতের শিরা ও ধমনীতে তার্পিন তেল এবং সিঁদুরের মিশ্রণ ইঞ্জেকশন দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হত। এরপর কয়েকবার দেহের ভেতরের অঙ্গগুলো পরিষ্কার করে নিতেন। মৃতের রক্ত যথাসম্ভব বের করে পুরো শরীরটিকে মদ দিয়ে পরিষ্কার করে নিতেন।
এরপর পরিষ্কার- করা দেহের যাবতীয় খোলা অংশ বন্ধ করে ফেলা হত। এজন্য কর্পূর, পটাশিয়াম নাইট্রেটের খনিজ রূপ বা নাইটার এবং ধূপ দিয়ে এক প্রকারের মিশ্রণ কাজে আসত। এরপর মৃতদেহটি সেলাই করে কর্পূর মাখিয়ে বাকি খোলা অংশগুলো বন্ধ করে দেওয়া হত।
শেষ পর্যায়ে মৃতদেহে সুগন্ধি তেল মাখিয়ে সেটিকে বাক্সবন্দি করা হত। যে বাক্সে দেহটি রাখা হত, তাতে আগে থেকে প্লাস্টার অব প্যারিস ভরা থাকত। যাতে দেহটি শুষ্ক থাকে। এটি সংরক্ষণের জন্য মাঝেমধ্যে আলকাতরাও ব্যবহার করা হত। হান্নার দেহটিও এভাবে মমি হিসেবে সংরক্ষিত ছিল।
তবে হান্নার মৃত্যু কিন্তু স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল। আসলে অন্ত্যেষ্টির অর্থ আত্মসাতের জন্যই চার্লস হান্নার শরীরটি মমি করে রাখে। অনেকের দাবি, হান্নার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ নিয়েছিলেন চার্লস। অন্ত্যেষ্টির পর যা শোধ করতে হত। তবে মমি হিসেবে হান্নার দেহ সংরক্ষণের ফলে সেই দায়ভার এড়াতে পেরেছিলেন চার্লস। যদিও হানার মৃত্যুর ১০০ বছর পর এখনো এ নিয়ে বিতর্ক চলছে।
প্রথম দিকে হান্নার মমিটি রাখা হয়েছিল অ্যানকোটস হলে বেসউইক পরিবারের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। তবে পরে ম্যানচেস্টারের সেল এলাকায় নিজের বাড়িতে তা নিয়ে যান চার্লস। সেখানে একটি ঘড়ির বাক্সে মমিটি রেখে দেন তিনি। চার্লসের মৃত্যুর পর মমিটি হাতবদল হয়ে যায় ওলিয়ার নামে এক চিকিৎসকের কাছে।
১৮২৮ সালে ওই চিকিৎসকের মৃত্যুর পর মিউজিয়াম অব দ্য ম্যানচেস্টার ন্যাচরাল হিস্ট্রি সোসাইটিতে জায়গা হয় হান্নার মমির। সেখান থেকেই সেটি ‘ম্যানচেস্টার মমি’ নামে পরিচিতি পায়। মিশর এবং পেরুর বহু মমির পাশাপাশি এটিও বেশ ভিড় টানত। এরমধ্যে পেরিয়ে গেছে ১০০ বছর।
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, হান্নার জীবিত অবস্থার কোনো ছবি পাওয়া যায়নি কোথাও। তবে ফিলিপ ওয়েন্টওয়র্থ নামে ম্যানচেস্টারের এক ইতিহাসবিদের লেখনীতে তার মমির বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, ‘দেহটি বেশ ভালোভাবেই সংরক্ষণ করা হয়েছিল। তবে গোটা মুখটি কালো হয়ে কুঁচকে গিয়েছিল। অঙ্গপ্রত্যঙ্গসহ পা দু’টি এমন কষে কাপড় দিয়ে বাঁধা হয়েছিল যেন এটি একটি ছোটখাটো আকারের বৃদ্ধার দেহ। কাচের কফিনে তা পোরা ছিল।’
বহু বছর পর সংগ্রহালয় থেকে কবরে জায়গা পেয়েছিলেন হান্না। ১৮৬৭ সালে ওই সংগ্রহালয়টি ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানাধীন হয়। সে সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মনে হয়েছিল, এভাবে মমি করে রাখাটা আসলে হান্নার মতো খ্রিস্টান নারীকে অসম্মান করার সমতুল। তারপর অনেকে বলেছিলেন, হান্না তো কবরে যেতে ভয় পাননি। শুধুত্র জীবন্ত অবস্থায় কবরে যেতে চাননি তিনি।
শেষমেশ মৃত্যুর ১০০ বছর পর ম্যানচেস্টারের হার্পারহে সমাধিস্থলে কবর দেওয়া হয় হানাকে। দিনটি ছিল ১৮৬৮ সালের ২২ জুলাই। হান্নাই একমাত্র নারী যাকে কোনো কারণ ছাড়াই মমি করা হয়েছিল। তার সময়টাতে মৃতদেহ মমি করার চলও তেমন ছিল না। মিশরের ইতিহাসে হাজার হাজার মমির দেখা মিলেছে। তবে তারা বেশিরভাগই ছিলেন কোনো ফারাও বা তার বংশের কেউ।
এছাড়াও বিভিন্ন শতাব্দীতে বিভিন্ন জাতি মৃতদেহ মমি করে রাখত। তবে ১৭ শতকে মমি করে রাখার চল একেবারে ছিল না বললেই চলে। হান্নার মমি নিয়ে তেমন গবেষণারও সুযোগ হয়নি গবেষকদের। ২০০ বছর আগে মমি নিয়ে গবেষণা খুব একটা হয়নি। তবে এই শতকে হলে হান্নার মমি নিয়ে হয়তো নানান গবেষণা হত গবেষণাগারে।
সূত্র: অ্যামিউজিং প্ল্যানেট, হিস্টোরিক ইউকে
কেএসকে/জিকেএস