‘দিল্লি কা লাড্ডু’ খেলে পস্তাবেন নাকি না খেলে!
‘দিল্লি কা লাড্ডু জো খায়া ও পস্তায়া জো নেহি খায়া ও ভি পস্তায়া’- প্রচলিত প্রবাদটি যেন আমাদের অস্থি-মজ্জায় মিশে আছে। বিশেষ করে বিয়ের প্রসঙ্গ এলেই প্রবাদটি চলে আসে ঠোঁটের ডগায়। কিন্তু কী সেই রহস্য! গত দুবারের দিল্লি সফরে তা ভেদ করার সুযোগ হয়নি। এবার প্রথম দিনের মিশন ছিল এর খোল নলচে খোঁজা।
যে যার মতো করে ব্যাখ্যা দিয়েছেন প্রবাদটির। অন্তত উইকি কিংবা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন ফিচার তাই বলে। দিল্লির সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক সাবেক সহকর্মী শরিফুল ইসলামের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে যথারীতি লাড্ডু প্রসঙ্গ সামনে এলো। সন্ধ্যা গড়িয়ে তখন রাত নেমেছে। ইউনিভার্সিটি এলাকার শান্ত পরিবেশ, সবুজ গাছগাছালি ঘেরা সড়ক ধরে এগিয়ে নিলো শরীফ। পূর্ণ চাঁদও সঙ্গ দিলো মেঘ আর গাছের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে। গন্তব্য লাড্ডুর দোকান।
নাম বিকানিরওয়ালা। বেশ নামকরা পুরোনো মিষ্টির দোকান। অনেকগুলো শাখা আছে এদের। ইউনিভার্সিটির পাশে হওয়ায় শিক্ষার্থীদের প্রিয় জায়গা। নানা পদের মিষ্টি, কেক, পেস্ট্রির পাশাপাশি এখানেও দিল্লি স্পেশাল, দিল্লি কা লাড্ডু। প্রায় বিশ রকমের লাড্ডুর সমাহার। সুবিধা হলো চাইলে আপনি একটি বা দুটিও কিনে খেতে পারবেন। আগে স্বাদ নেওয়া তারপর কথা! দোকানির কাছে জেনে জনপ্রিয় দুটি পদ নিয়ে চেখে দেখা হলো। দুই বাঙালির লাড্ডু খাওয়া দেখে চোখে তৃপ্তির চাহিন দোকানির। বুঝলাম এটাই তাদের ব্যবসার মূলধন! পেট আগে থেকেই ভরা ছিল, তাই খেয়ে বা না খেয়ে পস্তানোর বিষয়টি ঠাহর করা যাচ্ছিল না ঠিক। আর লাড্ডু প্রিয় আগে থেকেই। লাড্ডু মানেই কম মিষ্টি। তবে বাংলাদেশের লাড্ডুর সঙ্গে ঘিয়ের স্বাদ আর মিষ্টির পরিমাণে বেশ পার্থক্যটা বোঝা গেলো।
মিহিদানা লাড্ডু, শাহি যোধপুরি, বেসন, লাড্ডু আটা, শাহি বেসন ড্রাইফ্রুট, ছুরমা, গুড় লাড্ডু বেসন, মিল্ক কেক, লাড্ডু গন্ড, লাড্ডু পানজিরি প্রভৃতি বিচিত্র নাম ও ধরনের লাড্ডু তাকে সাজানো। দামও নেহায়েত কম নয়, ৫৮০ রুপি থেকে শুরু করে আছে ১৮শ রুপি পর্যন্ত।
কথা হচ্ছিল বিকানেওয়ালার একজন অভিজ্ঞ কর্মী সঞ্জিব কুমার মেহতার সঙ্গে। তিনি বলেন, ভারতীয়রা লাড্ডুকে তাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য মনে করে। লাড্ডু, বুন্দিয়া এগুলো উৎসবের অংশ। আর লাড্ডুর ভ্যারাইটি নিয়ে আসা হয়েছে, কারণ কারও ডায়াবেটিস আছে, কেউ মিষ্টি কম পছন্দ করেন কিংবা একেকজনের পছন্দ একেকরকম। আগের আমলে মায়েরা হাতে তৈরি বুন্দিয়ার লাড্ডু আর পানি দিতেন নাস্তায়।
‘তবে বুন্দিয়া লাড্ডু, বেসন লাড্ডু, মিহিদানার মতিচুর লাড্ডু এগুলো বেশি চলে। দিল্লির বাংলাদেশ দূতাবাস তাদের অনুষ্ঠানে আমাদের কাছ থেকে মতিচুর লাড্ডু নেয়। মোটা দানারগুলোও টেস্টি। বিদেশিরা এলে সব ধরনের লাড্ডু একটি একটি করে টেস্ট করতে পছন্দ করে।’
সদাহাস্য সঞ্জিব আরও বলেন, লাড্ডু সাধারণত ছানা ছাড়া তৈরি হয়। উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয় সুজি, গম, ছোলা, ময়দা, ঘি, বুন্দিয়া ইত্যাদি। হাতে তৈরি লাড্ডু বেশ জনপ্রিয়। পূজার প্রসাদ থেকে শুরু করে যে কোনো অনুষ্ঠানে ভারতীয়রা বিভিন্ন পদের লাড্ডু রাখতে পছন্দ করে।
প্রবাদটির ঠিকঠাক কোনো ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারেননি। উত্তর খুঁজতে তাই অপেক্ষা বাড়লো। ইন্ডিয়ান প্রেস ক্লাবে বসে আড্ডা হচ্ছিল সেখানকার সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে। বলে রাখা ভালো দিল্লির দাপুটে মিডিয়াগুলোর বড় একটি অংশ কলকাতার বাঙালিদের দখলে। সেই আড্ডায়ও এলো দিল্লি কা লাড্ডু। এলো নানা ধরনের ব্যাখ্যাও। কেউ বললেন বেশি খেয়ে বদ হজমের কথা, কেউ অল্পতে তুষ্টির কথা কেউ আবার মেলালেন গত কয়েকশ বছরের রাজনীতির প্রসঙ্গ।
ইন্ডিয়ান প্রেস ক্লাবের সাবেক সেক্রেটারি, সিনিয়র সাংবাদিক গৌতম লাহিড়ী বলেন, লাড্ডুর সঙ্গে ভালো ঘিয়ের যোগ আছে। হরিয়ানায় খুব ভালো ঘি হয়। মহিষের দুধের ঘি। সব অঞ্চলে এটা পাওয়ায় যায় না। দিল্লিতেও হয়। এই ঘি স্বাদের দিক থেকে অনেক কিছু বদলে দেয়। এটা স্বাস্থ্যকরও। মজা পেয়ে বেশি খেলে পরে আর কিছু খাওয়া যায় না, আবার না খেলে মিস হয় মজার এ মিষ্টান্ন। সেখান থেকেই প্রবাদটি তৈরি।
আবার আরেকজন বললেন, মোঘল-ব্রিটিশ কিংবা তারও আগে যারা দিল্লি শাসন করেছে, পরে যারা করছে তার সঙ্গেও একটি প্রতীকী যোগ আছে এই দিল্লি কা লাড্ডু প্রবাদের।
আবার অনেকের মতে, যে খেলো মুখে দিতেই শেষ হয়ে গেলো, আবার খেলো শেষ হয়ে গেলো- এভাবে পকেট ফাঁকা হওয়ার পাশাপাশি বদ হজমও হয় লাড্ডু খেয়ে। আর যে খেতে পারলো না সে তো পুরোটাই মিস করে ফেললো। এটা তার জীবনের একটা আফসোস। এখান থেকে এসেছে প্রবাদটি।
এএসএ/জেডএইচ/জিকেএস