লাখো মানুষের প্রাণ নেওয়া গুটিবসন্ত যেভাবে নির্মূল হয়
বর্তমানে করোনার প্রাদুর্ভাব কিছুটা কমলেও দেখা দিয়েছে নতুন আতঙ্ক মাঙ্কিপক্স। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘ স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞদের দেওয়া তথ্য মতে, আফ্রিকার বাইরে বিশ্বের ১৫টি দেশে মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।
মাঙ্কিপক্স আসলে একটি জুনোটিক ভাইরাস। যা প্রাণী থেকে মানুষের শরীরে ছড়ায়। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রেইনফরেস্টের কাছাকাছি এলাকায় এ ভাইরাসের সংক্রমণ বেশি ঘটে। নাম ‘মাঙ্কিপক্স’ হলেও একাধিক বন্যপ্রাণীর মাধ্যমে ছড়াতে পারে এ ভাইরাস। এ ভাইরাস সবচেয়ে বেশি ছড়ায় ইঁদুরের মাধ্যমে।
এটি অনেকটা গুটিবসন্তের মতো হলেও আদতে এর লক্ষণ, উৎস সবই আলাদা। গুটিবসন্ত শেষবার দেখা দেয় ইউরোপে ১৯৭২ সালে তৎকালীন ইয়োগোস্লাভিয়ায়। সংক্রামক এই রোগটি ছড়ায় ভ্যারিওলা নামের এক ভাইরাসের মাধ্যমে। ১৯৮১ সালে গুটিবসন্ত নির্মূলের আগের শতকগুলোতে এই রোগে বিশ্বে লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে।
গুটিবসন্ত ছিল বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম পুরোপুরি নির্মূল হওয়া কোনো সংক্রামক রোগ। এই সাফল্য ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং জনস্বাস্থ্যের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। পুরোপুরি নির্মূল হওয়ার আগে এটি ১৯৭২ সালের বসন্তকালে শেষ বারের মতো ইউরোপে ধাক্কা দিয়েছিল। সেসময় মারা গিয়েছিল কয়েক লাখ মানুষ।
এই ভাইরাস ইউরোপে ছড়িয়েছিল এক ব্যক্তির মাধ্যমে। তবে তাকে শনাক্ত করতে তিন হাজার লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। সবার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল এর সঙ্গে সম্পর্ক আছে মক্কায় হজ করতে গিয়েছিল, এমন কিছু লোকের।
১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে সেই ব্যক্তি ইয়োগোস্লাভিয়ার কসোভো প্রদেশে এসেছিলেন। তার নাম ছিল ইব্রাহিম হথি। ইব্রাহইম এখানকারই বাসিন্দা ছিলেন। সেসময় বিশ্বে অনেক দেশেই গুটিবসন্ত ছড়িয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে ইরাকে। এজন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে বাসে করে মক্কায় হজে যাওয়ায় ছিল নিষেধাজ্ঞা। তবে ইব্রাহিম হথি আরও ২৪ জনের সঙ্গে বাসে করেই মক্কায় হজ করতে গিয়েছিলেন।
দেশে ফেরার পথে এরা ইরাকের পবিত্র স্থানগুলোও পরিদর্শন করেন তারা। তারা বিভিন্ন বাজার ঘুরেছেন, কেনাকাটা করেছেন সেখান থেকে। ঠিক সেসময়ই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হুঁশিয়ারি দিচ্ছিল, ইরাকে গুটি বসন্তের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে।
এদিকে ইয়োগোস্লাভিয়া ইব্রাহীম হথি ও আরও ২৪ জন তখন বাড়ি ফিরে এসেছেন ইরাক ঘুরে। বাড়ি ফিরেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন ইব্রাহিম। তবে তিনি হয়তো ভাবছিলেন, এটা ভ্রমণের ক্লান্তি। কয়েকদিন পর ইব্রাহীম হথি তার পরিবার পরিজন এবং বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করলেন। তিনি যে হজ করে এখন হাজী হয়েছেন, সেটা উদযাপন করতে।
ইব্রাহীম হথি যেহেতু টিকা নিয়েছিলেন, তাই তার গুটি বসন্ত তেমন মারাত্মক রূপ নেয় নি। তার লক্ষণ ছিল খুব মৃদু। কিন্তু লোকজন যখন হাজি হওয়ার জন্য তাকে অভিনন্দন জানাতে তার বাড়িতে আসে, তখনই ঘটে ভয়ংকর ঘটনা।
ইব্রাহীম হথি যখন তার বাড়িতে হাজি হওয়ার আনন্দে অনুষ্ঠান করছিলেন, তখন সেখানে আরেক শহরের এক শিক্ষকও যোগ দিয়েছিল। লোকটি যখন নিজের শহরে ফিরে গেল, সে অসুস্থ হয়ে পড়লো। এরপর তার মাধ্যমে আরও ৩৮ জনের মধ্যে গুটিবসন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
ওই শিক্ষক বেলগ্রেডের হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে তার চিকিৎসা করছিলেন ড. আনা গ্লিগিচ। তিনি তখন সাবেক ইউগোস্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডের সেই ল্যাবরেটরির প্রধান। তিনি ওই শিক্ষককে দেখেই বুঝে গিয়েছিলেন তিনি গুটিবসন্তে আক্রান্ত। কিন্তু এ কথা বাইরে কাউ কে বলতে পারছিলেন না। কেননা ইউরোপে ৪২ বছর ধরে এই রোগে আক্রান্ত কোনো রোগী কেউ দেখেনি। তাই তিনি মুখ বন্ধ রাখলেন।
আসলে ইয়োগোস্লাভিয়ায় গুটি বসন্তের সর্বশেষ সংক্রমণ ধরা পড়েছিল ১৯৩০ সালে। কাজেই এত দশক পরে গুটি বসন্তের সংক্রমণ শনাক্ত করতে ডাক্তারদের সময় লাগছিল। তবে ইলেকট্রনিক মাইক্রোস্কোপে পর্যবেক্ষণ করে এবং অন্যান্য পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শনাক্ত করতে পারেন রোগটি। আটটি নমুনার আটটিতেই ছিল গুটিবসন্তের ভাইরাস।
তখন ড. আনা গ্লিগিচ বুঝে গিয়েছিলেন যে, ইউরোপ এক মহামারির মুখোমুখি পড়তে যাচ্ছে। কারণ যদি এরই মধ্যে ৮ জনের দেহে এই ভাইরাস ছড়িয়ে গিয়ে থাকে, তারা আরও বহু মানুষের মধ্যে এই ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়েছে।
এর পরের কয়েকদিন ড. আনা গ্লিগিচকে বেলগ্রেডের ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়। সেখানেই তার জন্য খাবার নিয়ে আসা হতো। তাকে একরাত কাটাতে হয় ল্যাবরেটরিতে নার্সদের ইউনিফর্মের এক স্তূপের ওপর। সেসময় তারা আরও নমুনা আসার অপেক্ষায় আছেন।
তখনো পর্যন্ত কেউ জানেন না, কীভাবে এই ভাইরাস ইয়োগোস্লাভিয়ায় ঢুকেছে। ড. আনা এবং কর্তৃপক্ষ তখনো পর্যন্ত কেবল এটুকুই জানেন যে, এই আটটি পজিটিভ কেসের সবগুলোই ধরা পড়েছে দক্ষিণাঞ্চলীয় কসোভোতে। শিগগির ড. আনা গ্লিগিচ এবং তার সহকর্মীদের ডাক পড়ে বেলগ্রেডের হাসপাতালগুলোতে।
কারণ কর্তৃপক্ষ তখন সন্দেহ করছে, হাসপাতালের কর্মীদের মধ্যেও গুটিবসন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। হাসপাতালের এক নারী নার্সকে তিনি পরীক্ষা করলেন। তিনি বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, এই নারী গুটিবসন্তে আক্রান্ত হননি। কিন্তু তারপরই তিনি শুনলেন, কেউ একজন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।
কোয়ারেন্টিন বক্সে ঢুকে তিনি দেখতে পান বিশের কাছাকাছি বয়সের এক সুন্দরী নারী। তার পুরো মুখ লাল হয়ে আছে। মেয়েটি যে সবচেয়ে খারাপ ধরনের গুটিবসন্তে আক্রান্ত, এটা ছিল তার প্রথম লক্ষণ। খুবই মারাত্মক ধরনের গুটি বসন্ত। তার মুখ থেকে রক্ত পড়ছিল তখন।
মেয়েটিও ছিল হাসপাতালের নার্স। মেয়েটির রক্ত পরীক্ষার ফল আসার আগেই সে ড. আনার সামনে মারা গেল। পরে নিশ্চিতভাবে জানা গিয়েছিল যে, মেয়েটির গুটিবসন্ত হয়েছিল। তাকে গোপনে কবর দেওয়া হয়। কারণ কর্তৃপক্ষের বিশ্বাস ছিল, জনগণকে না জানিয়েও গুটি বসন্তের বিস্তার রোধ করা যাবে। পর্যটন মৌসুমে যেন এর কোনো প্রভাব না পড়ে, সেজন্যে কর্তৃপক্ষ এটি গোপন রাখতে চেয়েছিল। তাদের আশংকা ছিল, এই প্রাদুর্ভাবের কথা জানাজানি হলে পর্যটকরা অ্যাড্রিয়াটিক অঞ্চলে আসবে না।
এই খবরটিকে ধামাচাপা দিতে হয় তাদের। কিন্তু এভাবে কতদিন। সংক্রমণের হার বেড়েই চলেছে। বেশিদিন চেপে রাখা গেলো না এ খবর। ঘটনা জানাতে হলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে। এরপর ইয়োগোস্লাভিয়ায় এরপর সামরিক আইন জারি করা হলো। নানা রকম বিধিনিষেধ জারি করা হলো, জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করা হলো। সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হলো। কেবল জরুরি কাজ ছাড়া অন্য প্রয়োজনে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হলো। হোটেলগুলোকে কোয়ারেন্টিনের কাজে ব্যবহারের জন্য ঠিক করা হলো।
তারপরও বেড়েই যাচ্ছে সংক্রণের হার। একে একে ছোড়িয়ে যাচ্ছিল ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। মারা যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। কোনো প্রতিষেধক তৈরি হয়নি। দিনরাত এক করে কাজ করছে বিজ্ঞানীরা। অবশেষে ১৮৮১ সালে ইউরোপে আবিষ্কার হয় গুটিবসন্তের টিকা। যার মাধ্যমে ইউরোপ রুখতে পেরেছিল এই রোগের সংক্রমণ।
তবে গুটিবসন্তের ইতিহাস হাজার হাজার বছরের পুরোনো। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে গুটি বসন্ত ছিল এই পৃথিবীতে। সিডিসির তথ্য মতে, তিন হাজার বছর আগের মিশরীয় মমিতে গুটি বসন্তের প্রমাণ পাওয়া যায়।
গুটি বসন্তের সঙ্গে মিলে যায় এমন রোগের সবচেয়ে পুরোনো লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় চীনে, চতুর্থ শতকের। এছাড়া ভারতে সপ্তম শতকে এবং এশিয়া মাইনরে (বর্তমান তুরস্ক) দশম শতকে এই রোগের লিখিত বিবরণ পাওয়া গেছে। ষষ্ঠ শতক থেকে অষ্টাদশ শতক নাগাদ বিশ্বজুড়ে এই রোগের দাপট ছিল।
সিডিসি বলছে, গুটি বসন্ত ছিল ধ্বংসাত্মক এক ব্যাধি। গড়ে আক্রান্তদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে তিনজনের মৃত্যু ঘটে। যারা বেঁচে যেতেন তাদের শরীরের ক্ষতচিহ্ন তার আক্রান্ত হওয়ার কথা মনে করিয়ে দিত।
শতকের পর শতক বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রাণহানি ঘটিয়ে চলা এই রোগ নিয়ে গবেষণা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা কলেজ অব মেডিসিনের সহকারী ডিন এবং প্রফেসর অব মেডিসিন হিসাবে কর্মরত সেজান মাহমুদ লিখেছেন, “খ্রিষ্টপূর্ব ১০ হাজার বছর থেকে মানুষের মধ্যে অস্তিত্ব ধরলে বলা যায়, এই রোগ ১২ হাজার বছর ধরে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন (৫০ কোটি) লোকের মৃত্যু ঘটিয়েছে। এখন এটি পৃথিবী থেকে একেবারে বিদায় নিয়েছে টিকার কারণে।”
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ১৯৭৭ সালে গুটিবসন্তের শেষ রোগী সোমালিয়াতে পাওয়া যায়। তবে তার পরে গবেষণাগারের দুর্ঘটনায় ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে এক ব্যক্তি আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ১৯৭৯ সালে বিশ্বকে গুটিবসন্ত মুক্ত ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
সূত্র: বিবিসি
কেএসকে/জিকেএস