ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

‘রাতের রানি’ কারওয়ান বাজারের ইতিহাস

খায়রুল বাশার আশিক | প্রকাশিত: ০১:০৯ পিএম, ১৫ মে ২০২২

 

হাজারো মানুষের হাঁকডাক, রেডিয়েট আলোয় দর কষাকষি, ঘাম ঝরানো মানুষের পদচারণা আর লাভ ক্ষতির হিসাবে এখানে মুখর হয় রাত। রাতের ব্যস্ততাই এখানকার চিরাচরিত স্বাভাবিকতা। রাতই যেন দিন। দিনভর ব্যস্ত ঢাকা যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে, ঠিক তখন এ রাজ্যটি ব্যস্ত হয়ে ওঠে। যেন ব্যস্ত রাজধানীর ক্লান্তিতেই গতি পায় এক বাজার। কারওয়ান বাজারের কথা বলছিলাম। রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রীয় পাইকারি ও খুচরা বাজার এটি।

জানা যায়, ১৮শ শতাব্দীর শেষের দিকে কারওয়ান সিং নামের একজন মারোয়াড়ী ব্যবসায়ী এখানে প্রথম বাজার বসান। ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে ফল এনে পাইকারি বিক্রি করতেন তিনি। তার কাছ থেকে ফল কিনে নিতেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। সে সময় ক্রেতারা কারওয়ান সিংয়ের ফল নিতে উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। ধীরে ধীরে মানুষ ওই বাজারকে ডাকতে শুরু করেন কারওয়ান সিংয়ের বাজার। কালক্রমে তা রূপান্তর হয়ে কারওয়ান বাজার হিসেবে খ্যাতি পায়।

তবে বাজারের নামের উৎপত্তি বা ইতিহাস নিয়ে আরও অনেক মত প্রচলিত রয়েছে। জনশ্রুতি আছে, এখানে কোনো একসময় গরু দৌড়ের আয়োজন হতো। যা তখনকার আমলে বেশ আলোচিত ছিল। সেই ‘কাউ (গরু)’ ও ‘রান (দৌড়)’ থেকে জায়গাটির নাম হয় কাওরান বাজার। মৌখিকভাবে আজও অনেকেই কাওরান বাজারই বলে। রাজধানীতে নতুন আগন্তুকরা বলে ‘কারুণ বাজার’। তবে বইপত্র ও সংবাদমাধ্যমে এ বাজারের নাম লেখা হয় ‘কারওয়ান বাজার’।

karwan

ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার হিসেবে পরিচিত এটি। এ বাজারের রয়েছে ভিন্নধর্মী কিছু বৈশিষ্ট্য। আলাদা আলাদা পণ্যের নির্ধারিত আড়তগুলোই এ বাজারের প্রধান চালিকাশক্তি। রয়েছে মাছের বিশাল পাইকারি বাজার। দেশীয় যাবতীয় ফল সব সময় পাওয়া যায় এখানে। মাছ, মুরগি, শুঁটকি, সবজি, মসলা, মুদি পণ্য থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই পাইকারি বিক্রি হয় এ বাজারে। এসব পণ্য আসে সারাদেশ থেকে। আবার সারা দেশে চলে যায় পাইকারের হাত হয়ে। হাত বদলের এ কর্মযজ্ঞ চলে পুরো রাত জুড়ে।

রাত ১০টার পর থেকে আড়তগুলোতে জ্বলতে শুরু করে ভারি ভারি বাতি। অনেকেই জ্বালান ধুপকাঠি। মহাজনরা আসেন। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে বাজারের ব্যস্ততাও। রাত ১১টার পর থেকেই সারা দেশ থেকে আসতে থাকে নানারকম পণ্যবোঝাই ট্রাক। কাঁচামালে ভরে ওঠে কারওয়ান বাজার এলাকা।

পণ্যগুলো ট্রাক থেকে নামানো, কেনা বেচা ও পরিবহন নিয়ে ব্যস্ত হয় হাজারো মানুষ। ক্রেতা, বিক্রেতা, পাইকার, আড়তদার, পরিবহন ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের কর্মব্যস্ততায় সরগরম হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। প্রতিরাতে এখানে কত টাকার কেনা বেচা হয় তার সঠিক হিসাব কারো জানা নেই। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মতে, প্রতিরাতে এখানে আনুমানিক কয়েক কোটি টাকার কেনা বেচা হয়।

রাত ১২টার দিকে ফল, সবজি, মাছ, মুরগি ইত্যাদি পণ্যে বোঝাই হয়ে ওঠে কারওরান বাজার। সবজি বোঝাই ট্রাক এসে ভিড়ে মহাসড়ক ঘেঁষে। ফল, চাল ইত্যাদি বহনকারী ট্রাকগুলো থাকে পেট্রোবাংলা বিল্ডিংয়ের আশেপাশের গলিগুলোতে। আর মাছ বহনকারী ট্রাকগুলো পণ্য নামায় এফডিসি রেলক্রসিংয়ের গলিতে। ভ্যানগুলো ঘিরে ধরে ওইসব ট্রাককে। মাল নামানো হয় ভ্যানে। তারপর ভ্যানগুলো বাজারের ভেতরে যার যার নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে যায়। কারওয়ান বাজারের ভ্যানগুলোও নজরকাড়া। কারণ, এই ভ্যানগুলোতে থাকে না কোনো চেইন, প্যাডেল, বেল। এসব ভ্যান শুধু চাকা গড়ানোর কাজেই ব্যবহার হয়।

karwan

বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যগুলো এনে আড়তে দেয়। মিষ্টিকুমড়ার স্তূপ দেখে মনে হয় যেন একেকটি পাহাড়। লাল শাক, লাউ শাক, পুঁই শাক, লাউ, করলা, গাজর, টমেটো, কলাসহ সবই আসে এ বাজারে। আড়তদারের কর্মীরা সেগুলো সাজিয়ে রাখে। পণ্যগুলোর আকার ও মান অনুসারে আলাদা করে। আড়তদার সেগুলো বিক্রির ব্যবস্থা করে। সেখান থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা কিনে নেয়। আর মাছ বাজারে আসে দেশি বিদেশিসহ সব ধরনের মাছ।

এখানের মুরগি বাজারের নাম কিচেন মার্কেট। চিকেন মার্কেটের বিবর্তিত রূপ এই কিচেন মার্কেট। মুরগি, হাঁস, রাজহাঁস, টার্কি, কবুতর আনা হয় এই মার্কেটে। এসব কাজের পরিধি আড়তের গণ্ডি ছাড়িয়ে রাস্তাঘাট পর্যন্ত চলে যায়। হাজারো মানুষের ভিড়ে কারওয়ান বাজারে জমে ওঠে কেনাকাটার উৎসব। কাজের কথা ছাড়া অন্যের সঙ্গে কোনো কথা বলার সময় নেই। প্রত্যেকে ব্যস্ত নিজ কাজে। সত্যিই এ যেন মুগ্ধকর এক কর্মযুদ্ধ।

কারওয়ান বাজারের সপ্তাহে অন্তত দুদিন তরকারি সরবরাহ করে আতিকুর রহমান। গত সাতবছর ধরে এ কাজে যুক্ত সে। কথা হলে তিনি বলেন, মফস্বলের বাজার যখন ক্রেতাশূন্য থাকে, তখন কৃষকরা তাদের পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রি করলে সঠিক দাম পায় না। তবে কারওয়ান বাজারে দাম একটু কম বেশি যাই হোক, ক্রেতা সংকট হয় না। এখানের আরতগুলো থেকে দেশের নানা স্থানে পণ্য যায়। তাই কৃষকদের থেকে পণ্য কিনে কারওয়ান বাজারে নিয়ে আসি, যাতে মুনফাসহ সহজে বিক্রি হয়।

মুন্সীগঞ্জ থেকে আগত পাইকারি ক্রেতা হাদিসুর রহমান জানান, যে ধরনের, যে মানের পণ্যে পাইকারি ক্রেতাদের চাহিদা থাকে, তা পাওয়ার অন্যতম ভরসার জায়গা কারওয়ান বাজার। মৌসুম অনুসারে অনেক কিছুই অনেক জায়গায় পাওয়া যায় না। তবে কারওয়ান বাজারে এলে সেসব পণ্যেরও হদিস মেলে। তাই আমার মতো ক্রেতাদের ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে বাজারটি।

karwan

কারওয়ান বাজারের সবজির আড়তদার হাফিজ উদ্দিন জানান, দেশের যে কোনো প্রান্তে শাকসবজির দাম নিয়ন্ত্রণ ও ওঠা নামা করে কারওয়ান বাজারের সরবরাহ-যোগান ও পাইকারি দামের ওপর ভিত্তি করে। তাই সারা দেশের কাঁচামাল ব্যবসায়ীদের কাছে এ বাজারের গুরুত্ব অপরিসীম। সারা বছর কৃষক থেকে খুচরা ব্যবসায়ী পর্যন্ত সেতুবন্ধনের জায়গা এই বাজার।

রাতভর বাজারে পাইকারি ক্রয় বিক্রয় চলে। দিনেও চলে বাজার। কারওয়ান বাজারের কামারপট্টি, ইলেকট্রনিকস, জুতা, জামাকাপড়, কাঠের পণ্য দিনেই চলে বেশি। এছাড়া খোলা বাজারের সব পণ্য খুচরা বিক্রি হয় সকাল থেকে। এসব কারণেই কারওয়ান বাজার ভোগ্য পণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার হিসেবে জনশ্রুতি কুড়িয়েছে দেশের বাণিজ্যিক অর্থনীতিতে।

ভোরের সূর্য যতটা কাছে আসে ততটাই কমে আসে কারওয়ান বাজারের ব্যস্ততা। সকালে মহাজনরা টাকা পয়সার হিসাব করে বাড়িতে ফিরলেই যেন ছুটি মেলে রাতের বাজারের। বহুবছর আগে গড়ে ওঠা কারওয়ান বাজার আজ ঢাকার অন্যতম অফিস পাড়াও। এ বাজারকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট যানজট এড়াতে বাজারটিকে যাত্রাবাড়ী, আমিনবাজার ও মহাখালীতে স্থানান্তরের জন্য গত কয়েক বছর ধরে দাবি উঠলেও, আদতে তা সম্ভব হয়নি।

কারওয়ান বাজার অতীতের ঐতিহ্য আজও ধরে রেখেছে। কবিদের উপমার মতোই, এ যেন এক রাতের রানি। সেই রাতের রানি সূর্যের আলোতেও ঢাকার বাজারের রাজা হয়ে ওঠে। নিত্যদিনের নিত্যপণ্যের প্রয়োজন মেটায় দেশবাসীর। দিনশেষে রাতে ফের জেগে উঠবে কারওয়ান বাজার। ফের ফিরবে চির চেনা ব্যস্ততায়।

কেএসকে/এমএস

আরও পড়ুন