৩৩ হাজার ফুট উপর থেকে পড়েও বেঁচে ছিলেন যিনি
দিনটি ১৯৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি। স্টকহোম থেকে বেলগ্রেড যাবে ফ্লাইট ৩৬৭। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নেওয়া হয়েছিল। এই ফ্লাইটের একজন বিমানবালা ছিলেন ভেসেনা ভুলোভিচ। কিন্তু সেদিন তার কর্মবিরতি ছিল। আসলে ভেসনা নামক আরেক বিমানবালার সঙ্গে তার নাম নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ায় ভুলে তাকে তলব করা হয়েছিল।
এরপর নির্দিষ্ট সময়ে ফ্লাইটটি ছেড়ে যায়। মাঝপথে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে যাত্রাবিরতি। এরপর পরদিন বেলা ৩:৪৫ মিনিটে কোপেনহেগেন বিমানবন্দরে পুনরায় উড্ডয়ন করে ডিসি-৯। এর ঠিক ৪৬ মিনিটের মাথায় বিমানের ব্যাগেজ কম্পার্টমেন্টে প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে।
সেই বিস্ফোরণে ডিসি-৯ বিমান আকাশে প্রায় ৩৩,৩৩০ ফুট উচ্চতায় উড্ডয়নরত অবস্থায় বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এরপর ভগ্ন বিমান প্রায় ২৮ জন যাত্রীসমেত ভূমির দিকে প্রচণ্ড বেগে পতিত হতে থাকে। তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়ার স্রস্কা কামেনিচ নামক এক গ্রামে বিধ্বস্ত বিমানটি পতিত হয়। সেই ২৮ জনের একজন ছিলেন ভেনেসা। তার ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
তবে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান ভেনেসা। ঘটনাস্থলে ব্রুনো হঙ্ক নামক এক কাঠুরে ভেসনার আর্তচিৎকারে সাড়া দিয়ে তাকে উদ্ধার করেন। পতনের ফলে তার দুই পায়ের হাড় ভেঙে গিয়েছিল। মেরুদণ্ড ও পাঁজরের হাড় ভাঙা ছাড়াও তার করোটিতে ফাটল দেখা দিয়েছিল। তিনি মস্তিষ্কে বেশ গুরুতর আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
মুমূর্ষু ভেসনাকে দ্রুত প্রাগের একটি হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। সেখানে ২৭ দিন কোমায় ছিলেন তিনি। ধীরে ধীরে তার অবস্থার উন্নতি হতে থাকে। প্রায় এক মাস পর কথা বলার ক্ষমতা ফিরে পান তিনি। কিন্তু তাকে যখন ফ্লাইট সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলো, তিনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন। ফ্লাইটে যাত্রীদের অভ্যর্থনা পর্বের পর থেকে তার কিছুই মনে নেই।
এরপর ১৬ মাস হাসপাতালে কাটিয়ে বাড়ি ফেরেন ভেনেসা। তবে পায়ের হাড় ভেঙে যাওয়ায় চিকিৎসকরা সাফ জানিয়ে দেন আর কখনো হাঁটতে পারবেন না ভেনেসা। সেই ভবিষ্যতবাণীও মিথ্যা হয়। সাড়ে চার বছর পর স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেন ভেনেসা। এমনকি এরপর তিনি তার পুরোনো কাজেও ফিরে আসেন।
তবে ভেনেসার নাম শুধু বিমান দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ভাগ্যবানদের একজনের তালিকাতেই নয়, রয়েছে গিনেস বুক অফ রেকর্ডেও। ভেসেনা ভুলোভিচ বিশ্বের একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে গিনেস রেকর্ডটি করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বোচ্চ স্থান থেকে প্যারাসুট ছাড়া পতনের বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী হন। তিনি প্যারাসুট ছাড়াই ৩৩ হাজার ৩৩০ ফুট উপর থেকে পড়েও বেঁচে ছিলেন। এই ঘটনার ১৩ বছর পর ১৯৮৫ সালে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড কর্তৃক ভেসনা ভুলোভিচকে সম্মানিত করা হয়।
বিমানটির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায় চেকোস্লোভাকিয়ার সার্বস্কা কামেনিস গ্রামের কাছে। এক কিলোমিটারের বেশি ছড়িয়ে পড়েছিল বিমানের ধ্বংসাবশেষ। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করবেন যে বিমানটি সন্ত্রাসী হামলার ফলে বিধ্বস্ত হয়েছে, তবে অপরাধীদের কখনো খুঁজে পাওয়া যায় নি।
১৯৬২ থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে যুগোস্লাভিয়ার বিরুদ্ধে ক্রোয়েশিয়ান জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা মোট ১২৮টি সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়েছিল। এ কারণেই এই বিমান দুর্ঘটনাকে সন্ত্রাসী হামলা বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল।
ভেনেসা ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এয়ারলাইন্সে কাজ করেছেন। এরপর সরকার বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেওয়ায় তিনি বরখাস্ত হন। এরপর রাজনীতিতেও বেশ সরব ছিলেন। ২০১৬ সালে ৬৬ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি।
সূত্র: গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস
কেএসকে/এএসএম