ভুটানের যে ১০ তথ্য আপনাকে অবাক করবে
ইফতেখার হায়দার
ভুটানের সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিবছর হাজারও পর্যটক সেখানে ভিড় জমায়। ভুটান ভারতীয় উপমহাদেশে হিমালয় পর্বতমালার পূর্বাংশে অবস্থিত। সাড়ে ৪৬ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট দক্ষিণ এশিয়ার বৌদ্ধ রাজ্য হলো ভুটান।
বিভিন্ন ধরনের মঠ, দুর্গ (বা জজং) ও নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য সুপরিচিত দেশটি। ভুটান শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘ভূ-উত্থান’ থেকে যার অর্থ ‘উঁচু ভূমি’। ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী, ভুটানের জনসংখ্যা প্রায় ৭ লাখ ৯৭ হাজার ৭৬৫ জন।
ভুটান এখনও বিশ্বের সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর একটি। ভুটানের ঐতিহ্যবাহী নাম হলো ‘দ্রুক ইউল’ যার অর্থ হলো স্বর্গের ড্রাগন। ভুটানের জাতীয় প্রতীক হলো ড্রাগন।
ভুটানের বেশ কিছু রীতিনীতি সম্পর্কে জানলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। জেনে নিন ভুটান সম্পর্কিত তেমনই আশ্চর্যজনক কিছু তথ্য-
গৃহহীন মানুষ নেই
ভুটানে কোনো গৃহহীন মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়না। অর্থাৎ কেউই রাস্তা বা ফুটপাতে বাস করেন না। যদি কেউ প্রাকৃতিক দুর্যোগে গৃহহীন হয়ে পড়েন তাহলে রাজার তাকে গৃহনির্মাণ ও চাষাবাদের জন্য এক খণ্ড জমি দান করেন।
শতভাগ বিশুদ্ধ খাবার
ভুটানের মোট আয়তনের ৭২ শতাংশ বনভূমি আছে। ২০১৫ সালে ভুটানিরা মাত্র এক ঘণ্টায় ৫০ হাজার গাছের চারা রোপনের মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা শূন্যের কোটায় নামিয়ে এনেছেন।
সেখানকার অধিকাংশ মানুষের পেশা কৃষিকাজ হলেও তারা ফসলাদিতে কোনো প্রকার সার, কীটনাশক কিংবা রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করেন না। সেই অর্থে ভুটানে শতভাগ বিশুদ্ধ খাবার মেলে।
ট্রাফিক লাইট নেই
ভুটান পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে কোন ট্রাফিক লাইট ব্যবহার করা হয় না। তবে ট্রাফিক পুলিশকে গুরুত্বপূর্ণ চৌরাস্তাগুলোর মাঝখানে নির্মিত ট্রাফিক বক্সে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। এছাড়াও সেখানে গাড়ির হর্ণ খুব কমই শুনতে পাওয়া যায়।
বিয়ের পর বর যায় শ্বশুরবাড়ি
ভুটানে নারীদেরই ঘর কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে দেখা যায়। তারা নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। এর পেছনে তাদের যুক্তি হলো, তাদের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য নারীর ক্ষমতায়ন অপরিহার্য।
ভুটানের রীতি হলো বিয়ের পর পুরুষরা যায় শ্বশুরবাড়ি। সাধারণত নারীরা বিয়ে করে স্বামীকে ঘরে তুলে আনে। শুধু তাই নয়, অভিভাবকের সম্পত্তির সম্পূর্ণ ভাগ কন্যাসন্তানেরাই পেয়ে থাকেন। এ কারণে ভুটানে নারীদেরই রাজত্ব চলে।
টেলিভিশন প্রচলনে সর্বকনিষ্ঠ
১৯৭৪ সালের আগে ভুটানের সঙ্গে সারাবিশ্বে কোনো যোগাযোগ ছিল না। এমনকি ১৯৯৯ সালের আগ পর্যন্ত ভুটানিরা টেলিভিশনের দেখাই পায়নি। এর কারণ ছিল ভুটান সরকার ধর্মভিত্তিক জীবনব্যবস্থা। তবে ১৯৯৯ সালের পর থেকে ভুটান পৃথিবীর সর্বশেষ দেশ হিসেবে টেলিভিশন ও ইন্টারনেট এর প্রচলন ঘটায়।
বিনামূল্যে শিক্ষা ও চিকিৎসা
অনুন্নত দেশ সত্ত্বেও ভুটানের শিশুরা নবম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। এমনকি ভুটানিরা যে কোনো চিকিৎসা সেবাই সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পান।
অভিন্ন ঐতিহ্যবাহী পোশাক
প্রায় ৪০০ বছর ধরে একই ধরনের পোষাক পরিধানে অভ্যস্ত ভুটানিরা। পুরুষদের পোষাকের নাম ‘গ’ ও নারীর পোশাকের নাম ‘কিরা’। তবে এই পোশাকের সঙ্গে তারা কাঁধ থেকে হাঁটু পর্যন্ত এক টুকরো কাপড় জড়িয়ে রাখেন।
যা তাদের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে নির্দেশ করে। যেমন- সাধারণ জনগণের ক্ষেত্রে এই কাপড়ের রং হবে সাদা, আবার পুরোহিতদের ক্ষেত্রে তা হবে হলুদ অথবা সরকারি উচ্চ পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তার ক্ষেত্রে তা হবে সবুজ।
বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক বিমানবন্দর
ভুটানের পারো নদীর তীরে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি বেশ চমৎকার। তবে এটি বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দর। কারণ এর আশেপাশের ১৮ হাজার ফুট উচ্চতার পাহাড় আছে। ওই পাহাড় ঘেঁষেই সরু রানওয়ে ধরে অতিক্রম করে বিমানগুলো।
রাতে আকাশপথে চলাচল অত্যন্ত বিপজ্জনক বিধায় শুধু দিনের বেলায় বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের অনুমতি পাওয়া যায়। আরও আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, সারাবিশ্বের মাত্র আটজন পাইলটের এই বিমানবন্দরে বিমান পরিচালনার সনদ আছে। যারা বছরে প্রায় ৩০ হাজার যাত্রী পরিবহন করেন।
মিনিস্ট্রি অব হ্যাপিনেস
ভুটানই একমাত্র দেশ যেখানে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীসভা রয়েছে যার নাম ‘মিনিস্ট্রি অব হ্যাপিনেস’। জনগণের সামগ্রিক সুখের গড় হিসাব নির্ণয় করে তারা।
২০১৫ সালে করা এই মন্ত্রিসভার এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৩৫ শতাংশ মানুষ অত্যন্ত সুখী, ৪৭.৯০ শতাংশ মানুষ মোটামুটি সুখী ও মাত্র ৮.৮ শতাংশ মানুষ সুখী নয়।
এই সুখের মাপকাঠি হলো তাদের সামগ্রিক জীবনযাত্রার মান। এই সূচক প্রমাণ করে অর্থ আসলে কখনওই সুখ বয়ে আনতে পারে না।
ধূমপান করলেই জেল-জরিমানা
ভুটানে উন্মুক্ত স্থানে ধূমপান করা নিষিদ্ধি। এমনকি তামাকের চাষবাদ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণও আইনগতভাবে নিষিদ্ধ। ২০১০ সালে এই বিষয়ে একটি আইন পাশ করা হয়। আইন অমান্যকারীকে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়।
একই ভবনে থাকে প্রাণী ও মানুষ
ভুটানের বাড়িগুলো বেশ নান্দনিক। তাদের অধিকাংশ বাড়িগুলোই ৩ তলা হয়। বাড়ির নিচতলায় বাস করে গৃহপালিত প্রাণী, দ্বিতীয় তলায় মানুষ ও তৃতীয় তলায় রাখা হয় শস্যদানা ও খড়কুটো।
জীবজন্তুর প্রতি তাদের অগাধ ভালবাসা। তাইতো ভুটানে নেই কোনো কসাইখানা। কারণ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জীব হত্যা মহাপাপ।
ভুটানিরা বেশ আন্তরিক ও অতিথি পরায়ণ। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ না হলেও তারা নিজের দেশকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখেন। যা অনেক উন্নত দেশেও দেখা যায়না। তাইতো ভুটানিরা সর্বাধিক সুখী জাতি!
জেএমএস/এমএম