করোনা প্রতিরোধে শরীর ঠিক রাখবেন যেভাবে
কাজী তাহসীন আহমেদ
করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। তাই শরীরকে ফিট রাখতে হবে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। থাকতে হবে সচেতন। কিছু কাজ রয়েছে, যেগুলো করলে শরীরকে ফিট রাখা সম্ভব। আসুন জেনে নেই সেসব কাজ সম্পর্কে--
প্রথম কাজ হচ্ছে সুস্থ থাকা। আপনার যদি ইতোমধ্যেই কোন রোগশোক থাকে, তাহলে সবার আগে সেটা চিকিৎসা করে ঠিক করে নিন। ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেশার ইত্যাদি থাকলে কন্ট্রোল করুন। অ্যালার্জি, অ্যাজমা বা সাইনাস জনিত সমস্যা থাকলে এখন থেকেই কেয়ারফুল থাকুন। ঠান্ডা, হাঁচি, কাশির প্রবণতা থাকলে এখন থেকেই ঠান্ডা থেকে দূরে থাকুন। অর্থাৎ আগে শরীর একদম রোগমুক্ত রাখুন। মনে রাখবেন, করোনাভাইরাস বিপজ্জনক তাদের জন্য; যাদের শরীর আগে থেকেই বিপদে আছে।
তারপর আপনার কাজ হচ্ছে- প্রতিদিন পর্যাপ্ত এবং প্রশান্তির ঘুম। সহজ ভাষায় বললে কোয়ালিটি স্লিপ। সুন্দর গোছানো বিছানা, মশারি টানানো। বিছানায় মোবাইল বা অন্যকিছু নেই। ঘুমানোর দুই-তিন ঘণ্টা আগেই খাওয়া-দাওয়া শেষ। বিকেলের পর কোন চা-কফি নয়। চেষ্টা করুন রাত ৯টার মাঝেই ঘুমিয়ে পড়তে। সর্বোচ্চ রাত ১০টার ভেতর ঘুমিয়ে পড়া উত্তম। ঘুমহীন শরীর মানে ভাঙাচোড়া ইমিউনিটি। মনে রাখবেন, শরীর তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পুনর্গঠন করতে পারে তখনই; যখন আপনি ঘুমে মগ্ন থেকে শরীরকে তার নিজের কাজ নিজের মতো নিশ্চিন্তে করতে দেন।
মনকে সব ধরনের টেনশন এবং স্ট্রেস মুক্ত করে ফেলুন। কোন টেনশন নয়, কোন স্ট্রেস নয়। মেজাজ একদম ফুরফুরে করে ফেলুন। টেনশন হচ্ছে আপনার শরীরের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর। এ টেনশন থেকেই শরীরে রোগের বাসা বাঁধা শুরু হয়। আর মানসিক স্ট্রেসের কারণে যেসব জঘন্য হরমোন আপনার শরীরের শিরায় শিরায় ধাবিত হয়, তা আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একদম দুর্বল করে ফেলে।
প্রচুর পানি পান করুন। ফ্লুইড পান করুন। সাদা পানি যথেষ্ট। সাথে ফলের জুস, শরবত, ডাবের পানি- এসব খেলে তো কথাই নেই! তবে চা-কফি ইত্যাদি পানি দিয়ে বানানো হলেও তা আপনার শরীরে পানি বাড়ায় না বরং পানি শুষে ফেলে। তাই চা-কফি অর্থাৎ ক্যাফেইন জাতীয় পানীয় পান করতে হিসেবি হোন।
শাক-সবজি, ফল-মূল প্রচুর খেতে হবে। একেক রঙের শাক-সবজি, ফল-মূলে একেক রকম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে। অনেক রঙের শাক-সবজি খেতে পারলে অনেক রকম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা লাভ করবেন। যেমন- লাল, হলুদ আর সবুজ রঙের ক্যাপসিকাম, লাল শাক, গোলাপি রঙের গাজর, কমলা রঙের কমলা, কালো আঙুর ইত্যাদি নানা রঙের শাক-সবজি আর ফল-মূল খেতে থাকুন। ভিটামিন সি ও এন্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ফল ও সবজি খান। যেমন- লেবু, আমলকি, কাঁচা মরিচ ইত্যাদি প্রতিদিন খেতে হবে।
বিষপান ছেড়ে দিতে হবে। সামনের কয়েকটি দিন রাস্তা-ঘাটের পোড়া তেলের ভেজাল স্ন্যাক্স বা ইফতারি আইটেম, হজম গণ্ডগোল করে এমন অখাদ্য রিচ ফুড, অতিমাত্রায় চিনি, চর্বি এসব মুখ দিয়ে ঢুকিয়ে শরীরকে বিষাক্ত আর কাহিল করা যাবে না। ঘরে তৈরি পুষ্টিকর খাবার খান। রান্নায় ভালো মানের তেল ব্যবহার করুন।
ওষুধি খাবারকে এমনি এমনি ওষুধি বলা হয় না। এসব সায়েন্টিফিক্যালি প্রমাণিত অবশ্যই। তাছাড়া পবিত্র কোরআন শরীফেও কিছু খাদ্যদ্রব্যকে শেফা বা রোগমুক্তির উপায় বলা আছে। শরীরকে বুস্ট আপ করতে সহজলভ্য কিছু রোগ প্রতিরোধী খাবার হচ্ছে:
১. মধু
২. কালোজিরা
৩. গরম পানিতে গোল মরিচ গুড়োর সাথে কাঁচা হলুদ বাটা বা গুড়ো
৪. গরম দুধ আর রসুন
৫. গরম পানি দিয়ে লেবুর রস
৬. গরম পানি আর আদা
৭. গরম পানি, দারুচিনি ইত্যাদি।
মনকে পজিটিভ রাখুন। একদম ভালো মানুষ হয়ে যান। সবাইকে মাফ করে দিন। ইবাদত করুন। জায়নামাজে বসে তওবা করুন। রাগ, ক্ষোভ, উত্তেজনা বাদ দিন। সবার সাথে ভালো ব্যবহার করুন। সেবা করুন, দান করুন। এতে আপনার মন স্ট্রেসমুক্ত হবে, নির্ভার হবে, ভালো ফিলিংস বা গুড মুড আসবে। তাতে কী লাভ? স্ট্রেস হরমোন যেমন শরীরকে ধ্বংস করে ফেলে, ঠিক তেমনই মনের ভেতর ‘ভালো ফিলিংস’ শরীরে ভালো হরমোনের জোয়ার বাড়িয়ে দেয়। ভালো ফিলিংসের কারণে যদি শরীরে ভালো হরমোনের জোয়ার আসে; তখন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিকঠাক কাজ করতে পারে। শরীরে রোগ জীবাণুর আক্রমণ করা তখন অনেক কঠিন হয়ে যায়। ভালো চিন্তা করুন, ভালো কাজ করুন, হৃদয়ে ভালোবাসা রাখুন। এতে শরীরে ভালো হরমোন প্রবাহিত হবে। শরীর-মন প্রফুল্ল থাকবে। রোগ প্রতিরোধের জন্য সতেজ থাকবে।
অলস থাকবেন না। নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করুন। কাদের ক্ষেত্রে সাবধান থাকবেন? প্রত্যেকের ক্ষেত্রে সাবধান থাকবেন। তবে শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ, দুর্বল, যেকোন শ্বাসকষ্টের রোগী, ক্যান্সার বা কেমোথেরাপি নিচ্ছে বা নিয়েছিল এমন রোগী, দীর্ঘদিন ধরে রোগাক্রান্ত, প্রচণ্ড শারীরিক ধকলের, জটিল রোগের ভেতর যাবার ইতিহাস আছে; এমন মানুষের ক্ষেত্রে সাবধানতা আরও বেশি প্রয়োজন।
আপনার পরিবারে এমন যারা আছেন, বিশেষ করে অসুস্থ বা বৃদ্ধ বাবা-মা, তাদের এখনই সব সুবিধাসহ একটি রুমে আলাদা করে থাকতে দিন। তাদের রুম থেকে বের হওয়ার দরকার নেই। আপনারাও একদম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে মাস্ক পড়ে নিরাপদ দূরত্ব থেকেই তাদের সাথে যোগাযোগ রাখুন। কয়েক সপ্তাহ এমন এক্সট্রিম সাবধানতার বিকল্প নেই। প্রফুল্ল থাকুন, বিশ্রামে থাকুন, সাবধান থাকুন, আত্মবিশ্বাসী থাকুন, সঠিক খাবার খান, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থেকে রোগ সংক্রমণ এড়িয়ে চলুন। সাথে চলুক সৃষ্টিকর্তার প্রতি আশ্রয় প্রার্থনা। আশা করা যায়, করোনাযুদ্ধে আপনি জয়ী থাকবেন।
লেখক: কোভিড-১৯ ফ্রন্টলাইনার মলিকুলার বায়োলজিস্ট, ইলেক্টিভ ফেলো (এক্স)-আইসিডিডিআরবি।
এসইউ/জিকেএস