করোনার দ্বিতীয় ধাপে যারা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি চীনের উহান প্রদেশের একটি হোলসেল এনিম্যাল, স্নেক ও ফিশ মার্কেটের বেশ কিছু দোকানি হঠাৎ করে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। প্রথমে স্বাভাবিক নিউমোনিয়ার মতোই মনে করা হয়েছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে এটি চীনের মধ্যাঞ্চলীয় এ প্রদেশ ছাড়াও চীনের অন্যান্য অঞ্চল, পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যেমন- হংকং, ম্যাকাউ, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ ১০০টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রথমদিকে দেখা গিয়েছিল, এসব দেশের আক্রান্ত নাগরিকগণ মোটামুটি সবাই চীনের উহান প্রদেশে ভ্রমণ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে অন্যান্য অনেকেই আক্রান্ত হন, যারা উপদ্রুত অঞ্চলগুলো ভ্রমণ করেননি। কিন্তু কোনো না কোনো ভাবে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসেছিলেন।
সেই ছিল শুরু। তারপর জল গড়িয়েছে অনেক দূর। শতবর্ষ পর পর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করা কালান্তক মহামারিগুলোর ইতিহাস কম-বেশি সবাই জানেন। সেদিনের সেই উহানে উৎপত্তি হওয়া নিউমোনিয়ার মতো রোগটিই ছিল বিশ্বব্যাপী ত্রাস সৃষ্টি করা হন্তারক করোনাভাইরাস ঘটিত কোভিড-১৯ বিশ্বমহামারি। পৃথিবীর এমন কোনো প্রান্ত আর অবশিষ্ট নেই, যেখানে এ মহামারির ভয়াল থাবা পৌঁছেনি। চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়া সর্বত্রই কোভিড-১৯ এর ছোবলে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। বিশ্বজুড়ে এ পর্যন্ত প্রায় ১৩ কোটি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং সংক্রমিত হয়ে মৃতের সংখ্যা ২৮ লাখেরও বেশি।
বিগত ২০২০ সালেই বিশ্বের ১০৪তম দেশ হিসেবে কোভিড-১৯ প্যান্ডেমিকের শিকার হয়েছিল বাংলাদেশ যার দ্বিতীয় ওয়েভ এখন চূড়ান্ত বিধ্বংসী রূপে বিপর্যস্ত করে তুলেছে আমাদের সামগ্রিক জনজীবনকে। করোনা সংক্রমণের প্রথম ধাপে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ সফলতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলেও বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে এ অবস্থা ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এখন প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা পূর্ববর্তী দিনের আক্রান্তের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বাস্তবিকই করোনার দ্বিতীয় ধাপ আমাদের ভয়াবহতার চূড়ান্ত দিকে ঠেলে দিচ্ছে। দেশে গতবছর জুন-জুলাই মাসে করোনার সংক্রমণের প্রথম ঢেউ ছিল বেশ তীব্র। এ বছর মার্চে শুরু হয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে এবার সংক্রমণ বেশি তীব্র। প্রথম ঢেউয়ের চূড়ার চেয়ে দ্বিতীয় ঢেউয়ের শুরুতেই দৈনিক রোগী শনাক্ত বেশি হচ্ছে। গত বছরের মার্চে সংক্রমণ শুরুর পর থেকে এতটা খারাপ পরিস্থিতি আর দেখা যায়নি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গতবছরের ২৫ জুন থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত ১০ দিন সংক্রমণ বেশি ছিল। সে সময় দৈনিক গড়ে ৩ হাজার ৭০১ জনের করোনা শনাক্ত হয়। গড়ে দৈনিক মৃত্যু হয় ৪১ জনের। এ বছরের ১০ মার্চ থেকেই দেশে আবার দৈনিক শনাক্ত রোগী বাড়ছে। কিন্তু সংক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে থাকলেও জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে এখনো উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে। সরকার সংক্রমণ ঠেকাতে কিছু নির্দেশনা দিয়েছে, আরোপিত হয়েছে লকডাউনও। বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে সংক্রমণ পরিস্থিতিতে গতবছরের জুন-জুলাইয়ের ধারা দেখা যাচ্ছে। পাঁচ সপ্তাহ ধরেই সংক্রমণে ঊর্ধ্বমুখী এ ধারা অব্যাহত রয়েছে।
করোনার প্রথম ধাপের সাথে দ্বিতীয় ধাপের মধ্যকার বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পার্থক্য বিদ্যমান। করোনাভাইরাস একটি আরএনএ ভাইরাস হওয়ায় স্বভাবতই এর মিউটেশনের ক্ষমতা ডিএনএ ভাইরাসের চেয়ে বহুগুণ বেশি। আমাদের দেশে করোনার দ্বিতীয় ধাপের সংক্রমণের জন্য দায়ী ভাইরাসের এ বিবর্তিত মিউটেটেড ব্রিটিশ, ব্রাজিলিয়ান কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকান রূপ। আসলে করোনাভাইরাসে যে কেউই আক্রান্ত হতে পারেন। তবে রিপোর্ট অনুযায়ী সংক্রমণের প্রথম ধাপে বিশ্বব্যাপী করোনায় আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে মাত্র ৫.৪% রোগী ছিল ১৮ বছরের নিচে। এই ৫.৪% রোগীর মধ্যে ০.২% মরণঘাতী তীব্র লক্ষণ প্রকাশ করেছিল। ফলে দেখা যাচ্ছে যে, সংক্রমণের প্রথম পর্যায়ে ১৮ বছরের নিচে করোনায় আক্রান্ত হওয়া ও আক্রান্ত হলে সেটি তীব্র অসুস্থতায় পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল একেবারেই কম।
অন্যদিকে ৬০ বছরের ঊর্ধ্বের ব্যক্তিদের কোভিড-১৯ এ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল বেশি। প্রথম ধাপে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুহার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে ৮০ বছরের উপরে রোগীদের মৃত্যুহার ১৫%, ৭০-৭৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ৮.০%, ৬০-৬৯ বছর বয়সীদের ৩.৬%, ৫০-৫৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ১.৩%, ৪০-৪৯ এর মধ্যে ০.৪% এবং ১০-৩৯ এর মধ্যে তা ছিল ০.২%। মৃত্যুহার থেকেও এটা স্পষ্ট, ৩৯ বছরের কম বয়সীরা করোনায় কম ক্ষতিগ্রস্ত ছিল সংক্রমণের প্রথম ধাপে। অপরদিকে নারী রোগীদের মধ্যে মৃত্যুহার ছিল ২.৮% এবং পুরুষ রোগীদের মধ্যে মৃত্যুহার ছিল ৪.৭%।
এতে বোঝা যাচ্ছে, নারীরা পুরুষদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত ছিলেন করোনার প্রথম ধাপে। আবার বিভিন্ন ক্রোনিক রোগযুক্ত শারীরিক অবস্থা করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে দেয়। যেসব করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির আগে থেকেই হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনিজনিত রোগ, ক্যান্সার কিংবা শ্বাসকষ্টজনিত রোগ ছিল, কিংবা দীর্ঘদিন যাবত স্টেরয়েড বা ইমিউনোসাপ্রেসিভ ওষুধ সেবন করছিলেন, তাদের ক্ষেত্রে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সম্ভাবনাও ছিল বেশি।
কিন্তু করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে দেখা যাচ্ছে, পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। অধিক বয়স্কদের পাশাপাশি বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণরাও অধিকহারে সংক্রমিত হচ্ছেন। কারণ মিউটেশনের ভেতর দিয়ে করোনাভাইরাসের বিবর্তিত রূপ তরুণদের আক্রান্ত করার এবং তীব্র মাত্রার সংক্রমণ সৃষ্টি করে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি করার সক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে। পাশাপাশি আরও একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, প্রথমদিকে সর্বসাধারণ প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে কমই বের হতেন। কিন্তু কয়েক মাসের সংক্রমণের গতির নিম্নমুখীতায় অনেকেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন এবং ভেবেছিলেন, করোনায় আসলে তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। এ ধরনের বাস্তবতা বিবর্জিত ভ্রান্ত ধারণায় অনেকেই কোনো বিধি-নিষেধ বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার তোয়াক্কা না করে শপিং মল, মেলা, পর্যটনকেন্দ্র, বিনোদন স্পট প্রভৃতি স্থানে ইচ্ছামতো ঘুরে বেড়িয়েছেন। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে এ প্রবণতা ছিল বেশি। ফলশ্রুতিতে স্বাস্থ্যবিধি না মানায় এবং জনসমাগমস্থলে অধিক মাত্রায় ঘোরাঘুরির কারণে অসচেতনতার জন্য ‘ড্যাম কেয়ার’ মনোভাবের দরুণ তাদের মধ্যে সংক্রমণের হারও করোনার দ্বিতীয় পর্যায়ে বেশি দেখা যাচ্ছে। এতে ক্ষয়ক্ষতিও হচ্ছে বেশি।
করোনার দ্বিতীয় পর্যায়ের এ ভয়ঙ্কর রূপ ঠেকাতে আসলে সচেতনতা ভিন্ন অন্য কোনো উপায় নেই। সরকার নির্দেশিত বিধি-নিষেধ এবং আরোপিত স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে চললে আসন্ন বিপদকে আমরা অনেকটাই শক্ত হাতে প্রতিহত করতে পারবো। এজন্য নিজে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি পরিবার এবং আশেপাশের সবাইকে সচেতন করে তোলার কোনো বিকল্প নেই।
এসইউ/জিকেএস