চুলের প্রসাধনী বিক্রি করে কোটিপতি হন যে নারী
কোটিপতি হওয়া সহজ- শিরোনাম পড়ে নিশ্চয়ই এমনটি ভেবেছেন! আসলে কোটিপতি হতে ভাগ্যের প্রয়োজন হয়। সঙ্গে কঠিন পরিশ্রমও কিন্তু করতে হয়। জন্মসূত্রে হয়তো অনেকেই ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় কোটিপতি হতে পারেন। তবে দরিদ্রতার কষাঘাতে প্রতিনিয়ত জরাজীর্ণ হয়েও অনেকে কোটিপতি হয়েছেন। সেটিই জীবনের সার্থকতা। তেমনই এক উদাহরণ হিসেবে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন ম্যাডাম সি জে ওয়াকার।
তিনিই আমেরিকার প্রথম নারী; যিনি গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে কোটিপতি হিসেবে নাম লিখিয়েছিলেন। চুলের প্রসাধনী বিক্রির মাধ্যমে তিনি কোটিপতি হন। শুনলে অবাক হবেন, তার বাবা-মা ক্রীতদাস হিসেবে আমেরিকায় আসেন। তার আসল নাম সারা ব্রেডলভ। ম্যাডাম সি জে ওয়াকার ১৮৬৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন লুজিয়ানার ডেল্টায়। তার বাবা-মা ওভেন এবং মিনার্ভা। তাদের পঞ্চম সন্তান ছিলেন সারা। দাসত্ব মুক্তির ঘোষণার পর তাদের পরিবার মুক্ত হয়।
মাত্র ৬ বছর বয়সে এতিম হয়ে যান সারা। এরপর ১৪ বছর বয়সে মুসা ম্যাক উইলিয়ামসের সঙ্গে তার ১৮৮৫ সালে বিয়ে হয়। তবে দুর্ভাগ্যবশত মাত্র ৬ বছরের মাথায় তিনি বিধবা হন। তখন তার কোলে ২ বছর বয়সী এক মেয়ে। সারা এবং ২ বছর বয়সী আলিয়া সেন্ট লুইতে চলে যান ভাগ্যের সন্ধানে। সেখানে সারার ৩ ভাই বাস করতেন। তাদের সহযোগিতায় সারা একটি সেলুনে কাজ শুরু করেন। সেখানে অনেক নারীই চুলের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আসতেন।
বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের চুল বেশি কোঁকড়ানো হওয়ায় তাদের মাথায় ময়লা জমে বিভিন্ন চর্মরোগ হয়ে থাকে। তখন আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে পানি, বিদ্যুতের সরবরাহ ছিল অনেক কম। এসব কারণে মাথা নোংরা থাকায় অনেক নারীরই চুল পড়ে যেত। সারা যেহেতু সেলুনে কাজ করতেন, তাই এসব দৃশ্য তিনি রোজই দেখতেন।
সারাও চুলের বিভিন্ন সমস্যায় ভুগতেন। তখন চুলের যত্ন নেওয়ার মতো তেমন কোনো ভালো প্রসাধনীও ছিল না বাজারে। এরপর হঠাৎই সারা চুলের প্রসাধনী তৈরি করবেন বলে ঠিক করেন। ভাইদের সহযোগিতায় সারা প্রাকৃতিক উপায়ে বিভিন্ন ভেষজ দিয়ে তৈরি করে ফেলেন ‘ওয়াকার সিস্টেম’। চুলে ব্যবহৃত শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, লোশন, ভেষজ তেলসহ যাবতীয় প্রসাধনীই পরবর্তীতে ওয়াকার সিস্টেম হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
সেলুনে আসা নারীদের প্রাথমিক অবস্থায় সারা এসব প্রসাধনী ব্যবহারের পরামর্শ দিতেন। এরপর নারীরা সারার প্রসাধনী ব্যবহার করে সুফল পেতে থাকেন। চারদিকে নাম-ডাক ছড়িয়ে পরে সারার। কেমিক্যাল বা প্রসাধনী সম্পর্কে সারার তেমন কোনো জ্ঞান ছিল না; তবুও নিজের চেষ্টা আর পরিশ্রমে সারা নিজের মেধা প্রমাণ করেন।
১৯০৫ সালে ওয়াকার তার পকেটে মাত্র ১ ডলার নিয়ে কলোরাডোর ডেনভারে চলে যান। এরপর তিনি চুল গজানোর তেল, ভেজিট্যাবল শ্যাম্পুর মতো প্রাকৃতিক চুলের প্রসাধনী তৈরির কাজে নেমে পড়েন। সেখানেই সারার সঙ্গে পরিচয় হয় চার্লস জোসেফ ওয়াকারের। যিনি ছিলেন সেন্ট লুইসের একজন সংবাদপত্র বিজ্ঞাপন বিক্রয়কারী।
এ বিয়ের মাধ্যমেই ম্যাডাম সি জে ওয়াকার নামে পরিচিতি লাভ করেন সারা। প্রথমে তার স্বামী তাকে বিপণন, বিজ্ঞাপন এবং মেল অর্ডারগুলোয় ব্যাপকভাবে সহায়তা করেছিলেন। ১৯০৮ সালে পেনসিলভেনিয়ার পিটসবার্গে সারা তার স্বামীর সহযোগিতায় একটি বিউটি সেলুন এবং কারখানা চালু করেন।
কারখানাটি সারা তার মেয়ের নামানুসারে করেন। ১৯১০ সালে সারার ব্যবসায়িক পরিধি বাড়তে শুরু করে। ১৯১১ থেকে ১৯১৯ সালের মধ্যেই কোটিপতি ব্যবসায়ী হিসেবে নিজের পরিচয় গড়েন। তার নাম হয়ে যায় ম্যাডাম সি জে ওয়াকার। তার কারখানা তখন বেশ বড় হয়ে ওঠে। ১৯১৭ সালের মধ্যে তার কারখানায় ২০ হাজার নারী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে চুলের প্রসাধনী তৈরির কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
১৯১২ সালে ম্যাডাম সি জে ওয়াকার তার তৃতীয় স্বামীর কাছ থেকেও বিচ্ছেদ ঘটান। এর ৫ বছর পরই চার্লস জোসেফ ওয়াকার মারা যান। মৃত্যুর আগেই সারা তার কন্যা আলিয়াকে সব সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করেন। অন্যদিকে সারা বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে আত্মনিয়োগ করেন। একজন উদ্যোক্তা হিসেবেই নয়, সারা একজন দানবীর নারী ছিলেন।
তিনি কর্মীদের জন্য ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাদের বিভিন্ন সময় বোনাস দিয়ে পুরস্কৃত করতেন সারা। তখনকার সময় কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের চাকরির ক্ষেত্রে অনেক বৈষম্য ও সীমাবদ্ধতা ছিল। তিনি নারী শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষভাবে অবদান রেখেছেন। টাস্কিজি ইনস্টিটিউটের নারীদের জন্য বৃত্তি অর্থায়নসহ বিভিন্ন কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের প্রতিষ্ঠানে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন ম্যাডাম সি জে ওয়াকার।
হাইপারটেনশনের কারণে ১৯১৯ সালের ২৫ মে মাত্র ৫১ বছর বয়সে মারা যান ওয়াকার। তার মৃত্যুর পরে ১৯২০ সালের দিকে ওয়াকারের নামটি আরও বেশি পরিচিত হয়ে ওঠে। কারণ তার ব্যবসায়ের পরিধি বাড়তেই থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও কিউবা, জ্যামাইকা, হাইতি, পানামা এবং কোস্টারিকা পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল তার কোম্পানি।
ইতিহাস বদলে দিয়েছিলেন এতিম এ নারী। ছোটবেলা থেকে বাবা-মায়ের ভালোবাসা না পেলেও বিশ্ববাসী তাকে ভালোবেসেছে। প্রচুর খ্যাতি আর জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন তার জীবনকালে। আজ তিনি বিশ্ববাসীর কাছে রোল মডেল। বিশেষ করে নারীদের জন্য দৃষ্টান্ত গড়েছেন ম্যাডাম সি জে ওয়াকার। তার জীবন অবলম্বনে সম্প্রতি টিভি সিরিজ নির্মিত হয়েছে ‘সেলফ মেড’ নামে।
হিস্টোরি/জেএমএস/এসইউ/এমকেএইচ