ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত যত স্মৃতিস্তম্ভ
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’- ফেব্রুয়ারি মাস এলেই গানটির মর্মবোধ জেগে ওঠে বাঙালির হৃদয়ে। এ ফেব্রুয়ারি মাসেই রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ নাম না জানা ভাষা সৈনিকরা।
১৯৫২ সালে বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার দাবি জানায় ছাত্ররা। ২১ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টায় পুলিশের গুলিবর্ষণে একের পর এক তরুণ তাজা প্রাণ রাজপথে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। সেদিন কতজন তরুণ শহীদ হয়েছিলেন, সে হিসাব আজও অজানা।
তবে সে সময় প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য ও মতামত নিয়ে জানা গেছে, আহতদের সংখ্যা ন্যূনতম পক্ষে প্রায় ১০০ জন হবে। এদের মধ্যে সালাম, শফিক, রফিক, বরকত, জব্বার অন্যতম। ভাষা শহীদদের স্মরণে ও তাদের প্রতি সম্মান জানাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মিত হয়েছে ভাস্কর্য ও স্মৃতিস্তম্ভ।
বলা হয়ে থাকে, ভাস্কর্য বুদ্ধিমত্তার শিল্প। বাংলা ভাষার ইতিহাসকে তুলে ধরতে দেশের খ্যাতনামা অনেক ভাস্কর্যশিল্পীই তৈরি করেছেন ভাস্কর্য ও স্মৃতিস্তম্ভ। সেগুলোর মধ্যে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু ভাস্কর্য ও স্মৃতিস্তম্ভ নিয়ে আজকের আয়োজন-
শহীদ মিনার
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে পরিকল্পনা ছাড়াই একটি শহীদ মিনার তৈরি করেন। যা একদিনের মধ্যেই সম্পন্ন হয়েছিল। শহীদ মিনারটি ছিল ১০ ফুট উঁচু ও ৬ ফুট চওড়া। ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে শহীদ শফিউরের পিতা অনানুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন।
অবশেষে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার পর ১৯৫৭ সালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। মূল শহীদ মিনারের নকশা করেন ভাস্কর হামিদুর রহমান। তবে ১৯৫৮ সালে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান পাকিস্তানে সামরিক আইন জারির পর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
পরবর্তীকালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল আযম খানের আমলে এর নির্মাণ কাজ পুনরায় শুরু করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটি শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ তত্ত্বাবধায়ন করে।
এর মূল নকশা কেটে দ্রুত নির্মাণ কাজ শেষ করা হয়। মূল নকশার ফোয়ারা ও নভেরা আহমেদের ম্যুরাল ইত্যাদি বাদ পড়ে। নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতে। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ ব্যক্তিত্ব আবুল বরকতের মাতা হাসিনা বেগম নতুন শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন।
অমর একুশ ভাস্কর্য
এক মায়ের কোলে শায়িত ছেলে এবং তার পেছনে স্লোগানরত এক ব্যক্তি। এমনই প্রতিকৃতি ‘অমর একুশ’ ভাস্কর্যে। শিল্পী জাহানারা পারভীন ভাস্কর্যটি তৈরি করেন। এর অবস্থান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ার পাশে।
১৯৯১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাস্কর্যটি প্রথম উদ্বোধন করা হয়। অনেক বছর ধরে অসম্পূর্ণ থাকার পর শেষ পর্যন্ত ২০১৮ সালে এর কাজ সম্পন্ন হয়। ‘অমর একুশ’ ভাস্কর্যটি বাঙালিকে স্মরণ করিয়ে দেয় বাংলা ভাষা আন্দোলন। ভাস্কর্যটি বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিমূলক ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে অন্যতম।
মোদের গরব
রাজধানীর বাংলা একাডেমির আঙিনায় ‘মোদের গরব’ ভাস্কর্যটি অবস্থিত। ভাষা শহীদদের সম্মানে ভাস্কর্যটি তৈরি করা হয়। ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারির ১ তারিখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ড. ফখরুদ্দীন আহমদ অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন।
ভাস্কর্যটির নকশা ও নির্মাণকারক খ্যাতিনামা ভাস্কর শিল্পী অখিল পাল। ভাষা শহীদ আবদুস সালাম, রফিকউদ্দিন আহমদ, আবদুল জব্বার, শফিউর রহমান এবং আবুল বরকতের ধাতব মূর্তিতে এটি গড়ে তোলা হয়েছে। মূর্তিগুলোর পেছনে একটি উঁচু দেয়াল রয়েছে।
যার দু’পাশেই টেরাকোটা নকশা করা। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন ঘটনাচিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে টেরাকোটায়। ‘মোদের গরব’ ভাস্কর্যটি তৈরি করতে মোট ১৩ লাখ টাকা খরচ হয়।
জননী ও গর্বিত বর্ণমালা
একজন মা তার গুলিবিদ্ধ সন্তানের মৃতদেহ কোলে নিয়ে হাসিমুখে প্রতিবাদ করছেন। ভাস্কর্যটি মনোযোগ সহকারে দেখলে যে কারও চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়বে। মা ও ছেলেকে ঘিরে আছে লাল ও সবুজ রঙের দুটি বৃত্ত।
এর মাধ্যমে লাল-সবুজের বাংলাদেশের জন্ম হওয়ার বিষয়টি প্রতীকী অর্থে বোঝানো হয়েছে। ভাস্কর্যটির নাম ‘জননী ও গর্বিত বর্ণমালা’। ১৬ ফুট উচ্চতার এ ভাস্কর্যে আরও আছে বাংলা বর্ণমালা এবং সংখ্যা। রাজধানীর পরীবাগের মাথায় বিটিসিএলের প্রধান কার্যালয়ের সামনে ভাস্কর্যটির অবস্থান। ভাস্কর মৃণাল হক ভাস্কর্যটি তৈরি করেছেন।
জেএমএস/এসইউ/এমকেএইচ