উৎসবে বাজি-পটকা কতটা ক্ষতিকর?
প্রতিবছর ৩১ ডিসেম্বর রাতে ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ উদযাপনকে ঘিরে বাজি-পটকা ফাটানোর প্রচলন রয়েছে। নতুন বছর উদযাপনকে ঘিরে বাজি-পটকা নিয়ে আমজনতার মনে উৎকণ্ঠা প্রকাশ হয়। এবার শব্দবাজির দাপট কি আরও বাড়বে? পরিবেশকর্মীরা সচেতন করেন। বাজি-পটকার শব্দবাজি কতটা ক্ষতি করতে পারে? বলে চলেন। বোঝান। তবুও শব্দ চমকাতেই থাকে। বাজি-পটকা ফাটতেই থাকে থার্টি ফার্স্ট’র আগে এবং পরের রাতে। যদিও থার্টি ফার্স্ট নাইটে মানুষ একটু আনন্দ করতে চায়। কিন্তু ঘরে ঘরে বৃদ্ধ, করোনা, হৃদরোগী এবং সাধারণ পাবলিক অসহায়।
বাজি-পটকার বিজ্ঞান রহস্য: বাজি-পটকায় কী থাকে? বাজি-পটকার মধ্যে থাকে একটি সহজদাহ্য মিশ্রণ। যা বাতাসের সাহায্য ছাড়াই জ্বলতে পারে। এজন্য প্রধানত ব্যবহার করা হয় পটাশিয়াম ক্লোরেট। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় পটাশিয়াম নাইট্রেট অথবা সোডিয়াম নাইট্রেট। এছাড়া দাহ্যপদার্থ হিসেবে থাকে কাঠ-কয়লার গুঁড়ো, সালফার বা গন্ধক ইত্যাদি। আগুন লাগলে, পটাশিয়াম ক্লোরেট থেকে প্রচুর অক্সিজেন বেরিয়ে আসে। আর তারই সাহায্যে অন্য পদার্থগুলো জ্বলতে থাকে। এ হলো নানা রকম আতশবাজির আসল বিজ্ঞান রহস্য।
আমাদের জানা সবচেয়ে প্রাচীন বিস্ফোরক পদার্থ হলো বারুদ। পুরোনো দিনে বিস্ফোরক পদার্থ হিসেবে, কামান-বন্দুকে এটিই সর্বত্র ব্যবহার করা হতো। বারোশ পঞ্চাশ সালে রজার বেকন সর্বপ্রথম বারুদের বর্ণনা করেন। তখন বারুদের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হতো- সোরার সঙ্গে অপেক্ষাকৃত বেশি পরিমাণে কাঠ কয়লার গুঁড়ো এবং সালফার বা গন্ধক। পরবর্তীকালে আরও উন্নতমানের যে বারুদ ব্যবহৃত হয়, তার উপাদান ছিলো এ রকম-পটাশিয়াম নাইট্রেট বা সোরা-পঁচাত্তর শতাংশ, কাঠ-কয়লার গুঁড়ো-পনেরো শতাংশ এবং সালফার (গন্ধক)-দশ শতাংশ। ঊনবিংশ শতাব্দির শেষভাগে অনেক উন্নতমানের বিস্ফোরক পদার্থ আবিষ্কৃত হয়, যেমন-নাইট্রোগ্লিসারিন, গান-কটন, কর্ডাইট প্রভৃতি। সেজন্য কামান-বন্দুকে এখন আর বারুদ ব্যবহৃত হয় না। বর্তমানে বারুদ ব্যবহার করা হয় প্রধানত আতশবাজি, পটকা, তুবড়ি, হাওয়াই বাজি প্রভৃতি প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে।
বানানো হয় কিভাবে: বাজি-পটকা তৈরির কলা-কৌশল প্রথম দিকে খুবই গোপন রাখা হতো। অতীত যুগে এ বিদ্যা ছিলো সম্পূর্ণরূপে পরিবারকেন্দ্রিক। বাবা শিখিয়ে দিতো ছেলেকে, আর ছেলে শিখিয়ে দিতো তার ছেলেকে। এভাবে এ বিদ্যা বংশপরম্পরায় প্রবাহিত হতো। সাধারণত তুবড়ির খোলের মধ্যে বারুদ ঠেসে ভর্তি করে নেওয়া হয়। বারুদের সঙ্গে অবশ্য খানিকটা লোহার গুঁড়ো, অথবা অ্যালুমিনিয়াম-পাউডার মিশিয়ে নেওয়া হয়। তুবড়ির মুখে আগুন ধরিয়ে দিলে, বারুদ জ্বলে ওঠে এবং জ্বলন্ত আগুন ফোয়ারার মতো করে উপর দিকে উঠে যায়। আর সেই সঙ্গে নানা রকম আলোর ফুলকি ছিটকে বেরুতে থাকে। তখন দেখতে খুব মজা লাগে।
আতশবাজির মাথায়, নিচের দিকে থাকে বারুদ, আর তার উপরে থাকে নানারকম আতশবাজির মসলা। হাওয়াইয়ের সলতেয় আগুন ধরিয়ে দিলেই তা প্রচণ্ড বেগে আকাশের দিকে ছুটে যায়। কিন্তু কেন এমন করে ছুটে যায়? বিজ্ঞানী নিউটন বলেছেন, প্রতিটি ক্রিয়ার বিপরীতমুখী এবং সমপরিমাণে প্রতিক্রিয়া রয়েছে। হাওয়াইয়ের সলতেয় আগুন ধরিয়ে দিলে, সঙ্গে সঙ্গে বারুদে আগুন ধরে যায়। এর ফলে হাওয়াইয়ের তলা দিয়ে প্রবল বেগে গ্যাস বেরুতে থাকে। এ গ্যাস বেরুনোটা হলো ক্রিয়া। কাজেই এর সমান এবং বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া নিশ্চয়ই দেখা দেবে?
অর্থাৎ ওই গ্যাস যত জোরে তলা দিয়ে বেরুতে থাকবে, প্রতিক্রিয়া ঠিক তত জোরে হাওয়াইটিকে উপরের দিকে ঠেলে তুলতে থাকবে। যে হাওয়াইয়ের বারুদ ভালো এবং বেশি পরিমাণে থাকবে, তা আকাশে তত বেশিদূর পর্যন্ত উঠে যাবে। এভাবে হাওয়াই বাজি উপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে উপরদিকে অবস্থিত বাজির মসলায় আগুন ধরে যায়। তাই তখন তা পটকার মতো, সশব্দে ফেটে যায়। সেই সঙ্গে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে আলোর রোশনাই। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, হাওয়াইয়ের নিচের দিকে একটা কাঠি লেজের মতো লাগানো থাকে। এটি অনেকটা নৌকার হালের মতো কাজ করে গতি-বিধি নিয়ন্ত্রণ করে। উপরের দিকে ঠিক পথে চালনা করে।
আলোর রং রহস্য: বাজি-পটকার রং-মশালে থাকে প্রধানত ম্যাগনেসিয়ামের গুঁড়ো। বাতাসের সংস্পর্শে ম্যাগনেসিয়াম যখন জ্বলে, তখন খুব উজ্জ্বল আলোক উৎপন্ন হয়। চারিদিক আলোয় ছেয়ে যায়। তারাবাতি যখন জ্বলে, তখন ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে যায়। এর কারণ ফুলঝুড়ি বা তারাবাতিতে স্ফুলিঙ্গ বা আলোর ফুলকি সৃষ্টি করার জন্য সীসার যৌগ, লোহার গুঁড়ো বা অ্যালুমিনিয়ামের গুঁড়ো ইত্যাদি মিশিয়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে বাজারে রয়েছে, রং-বেরঙের আলো সৃষ্টি করার হরেকরকম আতশবাজি। এসব আতশবাজিতে, বিভিন্ন রঙের আলো সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন রকম ধাতব লবণ ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যেমন-অ্যান্টিমনি বা আর্সেনিকের যৌগ থাকলে উৎপন্ন হয় উজ্জ্বল সাদা রং। তেমনি বেরিয়াম লবণ থাকলে পাওয়া যায় সবুজ আলো। স্ট্রনসিয়াম লবণ থেকে উজ্জ্বল লাল আলো। তামার লবণ থেকে নীল। সোডিয়াম লবণ থেকে সোনালি হলুদ। আর পটাশিয়াম লবণ থেকে উজ্জ্বল বেগুনি আলো। তাই রং-বেরঙের আতশবাজি পোড়ালে, উৎসব খুব জমে ওঠে। সবাই আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে যায়।
বাজি-পটকা কেন ক্ষতিকর: এতে জ্বালানী হিসেবে কার্বন ও সালফার ব্যবহৃত হয়। এগুলো পুড়ে গেলে কার্বন মনোঅক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড প্রভৃতি গ্যাস উৎপন্ন হয়। এগুলো স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক। কার্বন মনোঅক্সাইড গ্যাস ফুসফুসের মাধ্যমে রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। তার ফলে সুস্থিত কার্বক্সিহিমোগ্লোবিন উৎপন্ন হয়। ফলে রক্তের অক্সিজেন পরিবহন করার ক্ষমতা বিনষ্ট হয়। তাছাড়া মাথাধরা, ক্লান্তি ভাব এবং আরও নানারকম উপসর্গ দেখা দেয়। সালফার ডাই অক্সাইড গ্যাস, শ্বাসনালী এবং ফুসফুসে ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া এ গ্যাস বাতাসে থাকলে তা বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে তৈরি করে সালফিউরাস ও সালফিউরিক অ্যাসিড। এসব অ্যাসিড ত্বকের ক্ষতি করে।
স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের মতে, বাজি-পটকা থেকে উৎপন্ন লেড বা সীসার অক্সাইডের বিষক্রিয়ায় রক্ত শূন্যতা, দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অসাড়তা প্রভৃতি রোগ হতে পারে। অ্যান্টিমনি দূষণের ফলেও অনেকটা এরকম হয়ে থাকে। আর্সেনিক দূষণের ফল দুরারোগ্য চর্ম রোগ (চুলকানি) এবং যকৃতের রোগ হতে পারে। শরীরবিদদের মতে, আর্সেনিকের বিষক্রিয়া শরীরের প্রভূত ক্ষতি সাধন করতে পারে। ম্যাগনেসিয়াম প্রভৃতি ধাতু আমাদের জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়া চালানোর জন্য খুবই প্রয়োজন। একথা সত্য, তবে এদের মাত্রা বেশি হয়ে গেলে শরীরে দেখা দেয় নানা রকম বিপত্তি। বলা বাহুল্য, আতশবাজি-পটকা থেকে নির্গত ধোঁয়ার সঙ্গে এসব পদার্থ প্রথমে ফুসফুসে যায়। তারপর রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। তাই তখন নানা রকম বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
আগুন নিয়ে খেলা: মনে রাখতে হবে, বাজি-পটকা পোড়ানো মানেই আগুন নিয়ে খেলা করা আর ক্ষতিকর শব্দদূষণ ঘটানো। সব রকমের আতশবাজিই অনেক ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। আতশবাজি পোড়ানোর সময় অসাবধানতায় হঠাৎ কোথাও আগুন লেগে যেতে পারে। বাড়ি-ঘর পুড়ে যেতে পারে এবং তার ফলে প্রভূত ক্ষতি হতে পারে। সেজন্য ওই সময় প্রয়োজনীয় সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার। এবারের করোনাকালীন বছরের প্রথম প্রহর বা থার্টি ফার্স্ট নাইটে আতশবাজি যেন খারাপ সময়টাকে আরও খারাপ করে না দেয়, সে প্রত্যাশার পাশাপাশি সচেতন থাকা জরুরি। থার্টি ফার্স্ট নাইটে সরকারও যথেষ্ট সতর্ক ও সচেষ্ট থাকেন। কোনো ধরনের নিরাপত্তা হুমকি, জঙ্গি হামলা বা নাশকতার পরিকল্পনা রুখতে র্যাব সদা সতর্ক কাজ করেন। এবার ঘরে বসে নিজের পরিবার-পরিজনদের সাথে আনন্দ-উল্লাস উপভোগ করার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে। যা সত্যিই প্রশংসনীয়।
এবারের থার্টি ফার্স্ট নাইট যেকোনো বছরের চেয়ে ব্যতিক্রম। করোনা বিশ্ববাসীর ঘুম কেড়েছে। অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছেন। ধুঁকছে অর্থনীতি। মানুষ চাপের মধ্যে রয়েছে। এরই মধ্যে সিঁদুরে মেঘ দেখছে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ। চলে এসেছে ব্রিটিশের নতুন করোনা। ভরা এ করোনাকালে নতুন বছরকে গ্রহণ করতে যাচ্ছি। তাই এ বছর বাজি-পটকা ফাটানো হয়তো উচিত নয়। এবারের মহামারী পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সব রকমের বাজি-পটকা পোড়ানো, আতঙ্কজনক শব্দদূষণ থেকে মানুষকে বিরত রাখা প্রয়োজন। থার্টি ফার্স্ট নাইটে শব্দবাজি নেই, বাজি-পটকা নেই, এতে সন্তুষ্ট থাকবে জনগণ।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এসইউ/এমকেএইচ