চীনের ‘চেটেপুটে খাও’ আন্দোলন যেভাবে শুরু হলো
বাসন বা প্লেট চেটেপুটে খাওয়া সুন্নত। রাসুল (সা.) নিজে চেটেপুটে খেতেন ও অন্যদেরও তা করতে নির্দেশ দিতেন। ছোটবেলায় মুরুব্বিদের কাছ থেকে এই শিক্ষা পেয়েছি। মুরুব্বিরা বলতেন, ‘খাওয়ার সময় যদি একটা দানাও নষ্ট হয়, তবে কাল হাশরের ময়দানে সেটি তোমার বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করবে।’ ছোটবেলায় অবশ্য খানা-দানা নষ্ট করার মতো অবস্থা ছিল না। আমার ছোটবেলা মানে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ। বিশেষ করে মনে আছে চুয়াত্তুরের কথা। সারা দেশজুড়েই তখন খাদ্যের সংকট। ছোট ছিলাম। সারাক্ষণ পেটে ক্ষুধা লেগেই থাকতো। খুব মনে আছে, সামান্য যেটুকু খাবার ভাগে জুটতো, অনেক সময় নিয়ে একটু একটু করে খেতাম। খাবার যে শুধু খেয়েই আনন্দ, তা নয়; দেখেও আনন্দ। তখন সেটা বেশ উপলব্ধি করতাম। বড় হওয়ার পর জানলাম, বাসন চেটেপুটে খাওয়ার স্বাস্থ্যগত সুবিধাও আছে। খাওয়ার শেষদিকে যখন আমরা বাসন চেটেপুটে খাই, তখন প্রচুর পাচকরস বের হয়। এটা হজমের জন্য সহায়ক। যে-কেউ বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
চেটেপুটে খাওয়া মানে অপচয় না-করাও বটে। অপচয় ভালো নয়। কুরআন বলছে, যা কিছু পবিত্র তা খাও, কিন্তু অপচয় করো না; অপচয়কারী শয়তানের ভাই। অপচয় কেন খারাপ, সেটা আমরা বুঝি যখন আশপাশে তাকাই। আমাদের আশেপাশেই কতো মানুষ প্রয়োজনীয় খাদ্যটুকু পর্যন্ত পায় না! আর বিশ্বে তো কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন অভুক্ত বা অর্ধভুক্ত অবস্থায় সময় কাটায়। এ কথা শুধু দরিদ্র দেশগুলোর জন্য নয়, উন্নত দেশগুলোর জন্যও প্রযোজ্য। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের ফুটপাতে এক ব্যক্তিকে দেখে আমি চমকে উঠেছিলাম। ভদ্রলোক শ্বেতাঙ্গ। কাটা কাটা চেহারা। তবে অভাবে সেই চেহারা মলিন হয়েছে। ফুটপাতে একটি ব্যানার নিয়ে বসে ছিলেন। ব্যানারে লেখা: আমি ক্ষুধার্ত!
চীনেও একসময় ভীষণভাবে ক্ষুধার উপস্থিতি ছিল। নয়াচীন প্রতিষ্ঠার পর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশটিতে লক্ষ-কোটি মানুষের পেটে ক্ষুধা ছিল। একবেলা পেটপুরে খেতে পারাটা ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। এক টুকরো রুটি খেতে পেলেও অনেকে তখন বর্তে যেতেন। শুনেছি, তখন পরস্পরের সঙ্গে দেখা হলে লোকে প্রথমেই যেই প্রশ্নটি করতেন, সেটি হচ্ছে: ‘আপনি খেয়েছেন?’ আপনি খেয়েছেন মানেই সবকিছু ঠিক আছে! চীনের প্রবীণরা আজও দেখা হলে প্রথমেই প্রশ্ন করেন: ‘আপনি খেয়েছেন?’ এখন অবশ্য সেই দিন নেই। নেতৃবৃন্দের সঠিক দিক-নির্দেশনায় এবং চীনাদের কঠোর পরিশ্রম আর মেধার জোরে, চীন আজ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। চীনে আজ ৪০ কোটি মধ্যবিত্তের বাস। অধিকাংশ মানুষের জীবনে ক্ষুধা শব্দটি অপরিচিত। এখন তারা জীবনের কোয়ালিটি কতো উন্নত করা যায়, তা নিয়ে ভাবে।
চীনে বিগত কয়েক দশকে প্রায় ১০০ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠেছে। চলতি বছরেই দেশকে সম্পূর্ণভাবে দারিদ্র্যমুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে চীনের সরকার ও জনগণ। চীনের যেই ট্র্যাক রেকর্ড, তাতে এই লক্ষ্য সহজেই অর্জিত হবার কথা ছিল। কিন্ত গোল বাঁধালো করোনাভাইরাস মহামারি। মহামারির কারণে সহজ লক্ষ্যটি কঠিন হয়ে গেল। কিন্তু সরকার ও চীনা জনগণ কঠিন লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রেও দক্ষ। সহজ লক্ষ্য কঠিন হয়ে গেলে যা করতে হয়, তা তারা করছে। গ্রহণ করা হয়েছে অতিরিক্ত বিভিন্ন ব্যবস্থা।
এমনি এক প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং খাদ্যের অপচয় রোধের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সমাজে খাদ্যের অপচয়কে নিরুৎসাহিত করতে হবে। সরকারি বিভিন্ন অফিস-আদালতে খাদ্যের অপচয় রোধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেন তিনি। আসলে ২০১৩ সালে তিনি প্রথম এ ধরনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এবার মহামারি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রেক্ষাপটে তিনি নতুন করে নির্দেশনা দিলেন। বিভিন্ন সরকারি অফিস-আদালতে খাদ্যের অপচয় রোধে ইতোমধ্যেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। স্কুলগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। শিক্ষার্থীদের খাদ্যের অপচয় বন্ধ করার গুরুত্ব বোঝাতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মোদ্দাকথা, সার্বিকভাবে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের নির্দেশনার আলোকে চীনে এখন চলছে একটি সামাজিক আন্দোলন, যার নাম: চেটেপুটে খাও।
এ আন্দোলনের ইংরেজি করা হয়েছে: ক্লিন প্লেট মুভমেন্ট। চীনা ভাষায় আন্দোলনটির নাম ‘কুয়াং ফান সিং তুং’। চীনা ভাষায় ‘কুয়াং’ মানে খালি; ‘ফান’ মানে বাসন বা প্লেট। সোজা বাংলায় এর অর্থ: ‘চেটেপুটে খাও’। এ সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে লোকজনকে পরিমিত খেতে ও অপচয় না-করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, প্লেটে ঠিক ততটুকু খাবার নাও, যতটুকু তুমি তৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে শেষ করতে পারবে; অতিরিক্ত খাবার নিয়ে সেটা নষ্ট করো না। হ্যাঁ, একথা সত্য যে, যেই চীনে কয়েক দশক আগে লক্ষ-কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন কাটাতো, সেই চীনে এখন প্রতিবছর যে-পরিমাণ খাবার নষ্ট হয়, তা দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের সারা বছরের খাবারের বন্দোবস্ত হয়ে যাওয়ার কথা। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। খাবার নষ্টের এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতেই চীনে এখন চলছে সামাজিক আন্দোলন ‘চেটেপুটে খাও’। মনে রাখতে হবে, চেটেপুটে আপনি তখনই খেতে পারবেন, যখন আপনি পর্যাপ্ত খাবেন এবং তৃপ্তির সঙ্গে খাবেন। ভরপেটে আর যাই হোক চেটেপুটে খাওয়া যায় না!
চীনে ‘চেটেপুটে খাও’ আন্দোলন বেশ জমে উঠেছে অনলাইনেও। দেশটির জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ওয়েইপো (weibo) এর ব্যবহারকারীদের খাবার খাওয়ার পর খালি বাসনের ছবি পোস্ট করতে আহ্বান জানিয়েছে। এটি এখন ওয়েইপো প্লাটফর্মের সবচেয়ে হট ইস্যু। গত শুক্রবার পর্যন্ত এ আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন প্রায় ৯ লাখ ব্যবহাকারী। আর এসব পোস্টের মোট ভিউর সংখ্যা প্রায় ৫৫ কোটিতে দাঁড়ায়। অনলাইনে এই আন্দোলনে শরিক হয়েছেন সেলিব্রেটিরাও। তরুণ চীনা অভিনেতা ওয়েই তাসুন এক পোস্টে তিনটি খালি বাসনের ছবি দিয়ে লিখেছেন: ‘আমি চেটেপুটে খেয়েছি; আমার বাসনে আর কিছু অবশিষ্ট নেই।’
চীনে সাধারণত রেস্টুরেন্টে খাবারের সময় প্রচুর খাদ্য নষ্ট হয়। যতটুকু খাবার অর্ডার করা হয়, ততটুকু আর খাওয়া হয় না। ফলে বাকিটা নষ্ট হয় (অনেকে অবশ্য খাবার প্যাকেট করে বাসায় নিয়ে যান)। বিশেষ করে যেসব রেস্টুরেন্টে ব্যুফে খাওয়ার সিস্টেম আছে, সেখানে বেশি খাবার নষ্ট হয়। আমি নিজেও এই দোষে দুষ্ট। যে কয়বার ব্যুফে খেয়েছি, কমবেশি খাবার নষ্ট করেছি (যারা ব্যুফের সঙ্গে পরিচিত নন, তাদের জন্য বলছি: এই সিস্টেমে নির্দিষ্ট অংকের টাকা দিয়ে যত ইচ্ছা খাওয়া যায়)। এখন ‘চেটেপুটে খাও’ আন্দোলনের কারণে, রেস্টুরেন্টগুলোও নিজেদের মতো করে খাবারের অপচয় বন্ধ করতে উদ্যোগ নিচ্ছে। এক্ষেত্রে এক-দুটি রেস্টুরেন্ট বাড়াবাড়িও করে ফেলেছে ইতোমধ্যে। হুনান প্রদেশের ছাংশা শহরের একটি গরুর মাংসের রেস্টুরেন্টকে তো ঘটা করে ক্ষমাই চাইতে হয়েছে! চায়না নিউজ সার্ভিসের খবর অনুসারে, গত শুক্রবারই রেস্টুরেন্টটি বিশেষ ব্যবস্থা চালু করে। ব্যবস্থা অনুসারে, কাস্টমারদের রেস্টুরেন্টে ঢোকার আগে একটি স্বয়ংক্রিয় মেশিনে দাঁড়িয়ে ওজন মাপতে হবে। ওজন একটি মোবাইল অ্যাপে ইনপুট দিলে সেই অ্যাপ সংশ্লিষ্ট কাস্টমারকে কোন কোন খাবারের অর্ডার দেওয়া উচিত—সে সম্পর্কে পরামর্শ দেবে! প্রতিবাদের মুখে খুব দ্রুতই রেস্টুরেন্টটি অবশ্য এ ব্যবস্থা বাতিল করে। তাদের বক্তব্য, খাবারের অপচয় রোধ করাই ছিল তাদের লক্ষ্য, কাস্টমারদের অপদস্থ করা নয়।
বাংলাদেশের মতো গরিব দেশেও খাবারের অপচয় হয়। এ অপচয় যেমন হয় ব্যক্তিগত ও পরিবার পর্যায়ে, তেমনি সামাজিক পর্যায়ে। বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানে প্রায়ই প্রচুর খাবার নষ্ট হতে দেখা যায়। শুনেছি, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন অনুষ্ঠানের উদ্বৃত্ত খাবার সংগ্রহ করে গরিবদের মাঝে বিলি করে দেয়। হোটেল-রেস্টুরেন্টে রান্নাকৃত খাবারের যেটুকু বেঁচে যায়, সেটুকুও তারা সংগ্রহ করে গরিবদের মাঝে বিলি করে। এটা ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ব্যক্তি বা পরিবার পর্যায়ে খাদ্যের অপচয় বন্ধ করা সম্ভব নয়। এটি বন্ধে চীনের ‘চেটেপুটে খাও’র মতো সামাজিক আন্দোলন বাংলাদেশেও গড়ে উঠতে পারে।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ।
এসইউ/এএ/এমকেএইচ