প্যাঁচাকে নিয়ে মানুষের যত কুসংস্কার!
বেনজীর আহমেদ সিদ্দিকী
নিশাচর পাখি প্যাঁচাকে নিয়ে মানুষের মাঝে নানা কুসংস্কার এবং অলৌকিক চিন্তা-ভাবনা থাকলেও উপকারী হিসেবে পৃথিবীজুড়েই এর সুনাম আছে। প্যাঁচা প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পৃথিবীজুড়ে প্রায় ২০০ প্রজাতির প্যাঁচা দেখা গেলেও বাংলাদেশে রয়েছে ১৬ প্রজাতির প্যাঁচা। এরমাঝে লক্ষ্মীপ্যাঁচা, কোটরে প্যাঁচা, নিম প্যাঁচা, কুপোখ বা কালো প্যাঁচা, ভুতম প্যাঁচা, পাহাড়ি প্যাঁচা, ঘাসবনের প্যাঁচা, ভুমা প্যাঁচা, বন্ধনিযুক্ত নিমপোখ প্যাঁচা, বনের বড় প্যাঁচা উল্লেখযোগ্য।
খাবার নিয়ে প্যাঁচার তেমন কোন বাছবিচার নেই। ছোট ইঁদুর, শুঁয়োপোকা, ছোট পাখি, টিকটিকি, ঢোঁড়া সাপ, ব্যাঙ ইত্যাদি খেয়ে প্যাঁচা জীবনধারণ করে থাকে। প্যাঁচা পাখিদের দলের হলেও এরা অন্যান্য পাখির সাথে একত্রে না থেকে একাকী নির্জনে বড় গাছের কোটর, বন-জঙ্গল, দালানের ফাঁক-ফোকর কিংবা গাছ-গাছালির ঘনপাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে। দিনের বেলা সহজে চোখে পড়ে না। কারণ দিনের বেলা গাছের পাতার আড়ালে বা গর্তে লুকিয়ে এরা বিশ্রাম নেয়। অনেকে মনে করে প্যাঁচা দিনের বেলা দেখতে পায় না। এটি একধরনের ভুল ধারণা। আসলে প্যাঁচা দিনের বেলা দেখতে পায়। তবে এদের বড় আইরিশযুক্ত চোখের কারণে রাতে এদের দেখতে বেশি সুবিধা হয়।
বাংলাদেশে প্যাঁচা চেনে না এমন মানুষ নেই বললেই চলে। তবে শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষেরা প্যাঁচার ডাকের সাথে বেশ ভালোভাবেই পরিচিত। খানিকটা ভিন্ন রকমের ডাক এবং নিশাচর স্বভাবের কারণে প্যাঁচাকে অনেকেই কুসংস্কার বশত ‘অশুভ পাখি’ বলে মনে করে থাকে। তাই নিশাচর এ পাখিকে নিয়ে রয়েছে রূপকথার মতো নানা গল্প ও কুসংস্কার-
১. ভারতের কোনো কোনো এলাকায় প্যাঁচাকে বাদুড়ের স্ত্রী হিসেবে বিশ্বাস করা হয়। প্রাচীনকালে উত্তর ভারতের মানুষ বিশ্বাস করত, কেউ যদি প্যাঁচার চোখ খেয়ে নেয়। তবে সে রাত্রে ভালো দেখতে পাবে। এমনকি বাতের ব্যথা সারাতে ও হজমের ওষুধ হিসেবে প্যাঁচার মাংস ব্যবহার করা হতো। উত্তর ভারতে কালো রঙের প্যাঁচাকে মৃত্যুর প্রতীক হিসাবে ধরা হতো।
২. মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে যাওয়ার আগে রাস্তায় যদি কোনো প্যাঁচা দেখা যেত; তবে ধরে নেওয়া হতো সেই যুদ্ধের ফল হবে রক্তাক্ত।
৩. জাপানের এইনু সম্প্রদায়ের মানুষ যেকোনো অভিযানে যাওয়ার আগে প্যাঁচাকে বিশেষ মদ উৎসর্গ করত। তাদের বিশ্বাস ছিল, এর ফলে কোনো বিপদ হলে তারা সেই বিপদ থেকে রক্ষা পাবে।
৪. কেনিয়ার কিকুয়ু উপজাতিগোষ্ঠী বিশ্বাস করে, প্যাঁচা মৃত্যুর আগমনের কথা জানিয়ে দেয়। যদি কেউ একটি প্যাঁচা দেখে থাকে কিংবা তার আওয়াজ শোনে, তাহলে সে মৃত্যুমুখে পতিত হবে।
৫. মধ্য আফ্রিকার বানটু জাতির কাছে জাদুকরের প্রতীক ছিল প্যাঁচা এবং দক্ষিণ আফ্রিকার জুলুক জাতির কাছে প্যাঁচা হলো একটি জাদুকরী পাখি।
৬. পূর্ব আফ্রিকার সোয়াহিলি জাতির লোকেরা বিশ্বাস করত, ছোটো শিশুর অসুস্থতার সংকেত বহন করে নিয়ে আসে প্যাঁচা। পশ্চিম আফ্রিকায় প্যাঁচাকে জাদুকরী ও পিশাচিনীর বার্তা বাহক মনে করা হতো। প্যাঁচা তাদের খারাপ সময়ের আগাম অবস্থা জানাত।
৭. অস্ট্রেলিয়ায় আদিবাসীরা বিশ্বাস করে, বাদুড় পুরুষ আত্মার বাহক আর প্যাঁচা নারী আত্মার বাহক।
৮. পোল্যান্ডের মানুষের ধারণা ছিল, মৃত্যুর পর অবিবাহিত নারীরা কবুতর হয় ও বিবাহিত নারীরা প্যাঁচা হয়ে জন্ম নেয়।
৯. জার্মানিতে বিশ্বাস ছিল, যদি সন্তান জন্মের সময় প্যাঁচা ডাকে তবে সেই সন্তানের ভাগ্য ভালো হয় না।
১০. ফ্রান্সের লোকেরা বিশ্বাস করত, অন্তঃসত্ত্বা নারী যদি প্যাঁচার ডাক শোনেন, তাহলে তার কন্যা সন্তান হবে।
১১. বেলজিয়ামের মানুষ বিশ্বাস করত, গির্জায় ইঁদুরের উৎপাত বন্ধ করার জন্য প্যাঁচাকে গির্জায় থাকার জন্য আদেশ দিয়েছিলেন যিশুখ্রিস্ট।
১২. স্পেনে প্রাচীনকালে মানুষের বিশ্বাস ছিল, যিশুর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্যাঁচা একটি সুরেলা পাখি ছিল। এরপর এক রাতে ডাকার সময় প্যাঁচার ডাক বদলে গেছে।
প্রচলিত বিশ্বাসে প্যাঁকে মন্দ ভাগ্য, শারীরিক অসুস্থতা অথবা মৃত্যুর প্রতিচ্ছবি হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রাচীনকাল থেকেই এ বিশ্বাস প্রচলিত। এখনো অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে বিশ্বাস আছে, রাতে প্যাঁচা ডাকলে না কি গৃহস্থের অমঙ্গল হয়। কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মেই রাতে প্যাঁচা ডাকে।
মূল কথা হচ্ছে- এ সময় ইঁদুর ধরতে প্যাঁচা মাটিতে নেমে আসে এবং ডাকে। তাই গভীর রাতে প্যাঁচার ডাক শুনতে পাওয়াটা অতি সাধারণ ও স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। আর এভাবেই প্যাঁচা বিভিন্ন কুসংস্কার এবং অলৌকিক চিন্তা-ভাবনা নিজের সাথে নিয়েই প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষায় ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে।
একসময় বাংলাদেশের শহর ও গ্রামে অনেক প্যাঁচা দেখা গেলেও এখন আর তেমন দেখা মেলে না। নির্বিচারে বন উজাড়, ফসল আবাদ করতে জমিতে বিভিন্ন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগ, শিকারিদের দৌরাত্ম্য, খাদ্যের অভাব, অশুভ পাখি বলে মেরে ফেলাসহ নানা কারণে প্রকৃতি থেকে দিনদিন প্যাঁচার সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
লেখক: ফার্মাসিস্ট ও সমাজকর্মী।
এসইউ/এএ/এমকেএইচ