করোনায় ধসে গেছে চিকিৎসাসেবা
ওয়াসিম ফারুক
আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন বহুদিনের। আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে কতজন যে সন্তুষ্ট, তা দেখা যায় ভারতের কিছু কিছু হাসপাতালে গেলে। ভারতের কলকাতা, চেন্নাই, দিল্লি, বোম্বের অনেক হাসপাতালেই বাংলাদেশের সাধারণ রোগীদের দীর্ঘ লাইন। আর সিঙ্গাপুর কিংবা থাইল্যান্ডের অনেক হাসপাতালেই আমাদের ধনী রোগীদের আনাগোনা। প্রায়ই আমাদের শুনতে হয়, অমুককে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিশেষ বিমানে সিঙ্গাপুর নেওয়ার কাহিনি। এমনকি আমাদের অনেক বড় বড় হাসপাতালের খ্যাতনামা চিকিৎসক ও মালিকরা চিকিৎসার জন্য পাড়ি জমান উন্নত বিশ্বের উন্নত কোনো হাসপাতালে।
কিছুদিন আগে আমাদের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের যখন হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন; তখন তার উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা আমরা দেখেছি। আমাদের দেশের সব বিজ্ঞ চিকিৎসকের সাথে জরুরি ভিত্তিতে যোগ দেন ভারত তথা বিশ্ববিখ্যাত হৃদরোগ চিকিৎসক দেবী প্রসাদ শেঠী। তারপরও ওবায়দুল কাদেরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিশেষ বিমানে নিয়ে যাওয়া হয় সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে। সেখানকার খ্যাতনামা চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে উন্নত চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসেন তিনি। অথচ আমার মতো একজন সাধারণ মানুষের চিকিৎসার পর্যায় কোনটা, সেটা করোরই জানার বাকি নেই।
সমগ্র বিশ্বের মত করোনার কড়াল গ্রাসে আক্রান্ত আমাদের বাংলাদেশ। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতারেসের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ববাসীকে সবচেয়ে বড় যে সংকট মোকাবিলা করতে হচ্ছে, তা হলো বর্তমান সময়ের এ বিশ্ব মহামারী করোনাভাইরাস। এ করোনা যুদ্ধে যারা প্রথম লাইনের সৈনিক, তারা হলেন ডাক্তার, নার্সসহ বিভিন্ন চিকিৎসাকর্মী। আমাদের বাংলাদেশের করোনা মোকাবেলার প্রথম সারির যোদ্ধাও আমাদের স্বাস্থ্য সৈনিকরা। কিন্তু সম্প্রতি কিছু ঘটনা সত্যিই আমাদের অনেকটা হতাশ করেছে।
অ্যাম্বুলেন্সে টানা ষোলো ঘণ্টা রাজধানীর ছয়টি হাসপাতালে ছোটাছুটি করে অবশেষে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করতে হয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলমাছ উদ্দিনকে। ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হলেও করোনা সন্দেহে বিনা চিকিৎসায় মারা যান তিনি। এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাজধানীর রাবডেম, সোহরাওয়ার্দী, পপুলার, কুয়েত মৈত্রী- কোনো হাসপাতালেই ভর্তি করেনি শুধু করোনায় আক্রান্ত সন্দেহে। পরে রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করলেও তার কিছুক্ষণ পরেই মারা যান এই জাতীয় বীর।
গত কয়েক দিনে আমাদের প্রতিটি হাসপাতালের চিত্র প্রায় একই। এক বাবা ছয় দিনে পাঁচ হাসপাতাল ঘুরেও কোনো হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারেননি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার স্কুলছাত্রী সানজিদা ইসলাম সুমাইয়াকে। পরে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সুমাইয়াকে করোনা পরীক্ষা করে ফলাফল নেগেটিভ এলেও কোনো হাসপাতালে ভর্তি করা সম্ভব হয়নি। এমন চিত্র আজ সমগ্র বাংলাদেশের প্রায় প্রতি হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রের। এমনকি করোনার ভয়ে ডাক্তাররা আজ ঠিকভাবে উপস্থিত থাকছেন না। তাদের নিজস্ব চেম্বারেও বসছেন না ঠিকভাবে। কোনো কোনো ডাক্তার নিজের অসুস্থতার অজুহাতে বাসায় অবস্থান করছেন। তাই চিকিৎসাসেবা না পেয়েই হতাশ হয়ে ফিরতে হচ্ছে রোগীদের। মৃত্যু পথযাত্রী রোগীকে ডাক্তারের চেহারা না দেখে দেখতে হচ্ছে জমদূতের চেহারা।
সংবাদ মাধ্যম থেকে যতটুকু জানতে পেরেছি, আমাদের হাসপাতালগুলোতে এখন আর পার্সনাল প্রটেক্টিভ ইক্যুইপমেন্ট অর্থাৎ পিপিইর কোনো অভাব নেই। এমনকি প্রচুর উদ্বৃত্তও আছে। তবে কেন আমাদের হাসপাতালগুলোর এমন অবস্থা? গত ডিসেম্বরে চীনের উহানে যখন করোনা আক্রমণ করে; তখন উহানের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের অক্লান্ত পরিশ্রম উদাহরণযোগ্য। মাত্র কয়েক দিনে একটি হাসপাতাল নির্মাণ করে ফেললেন। সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যমে দেখেছি, ওখানকার স্বাস্থ্য সৈনিকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ছবি ও ভিডিও। দিনের পর দিন মাস্ক ও অন্যান্য প্রতিরোধমূলক সামগ্রী ব্যবহারে তাদের মুখের বিভিন্ন স্থানে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে।
দিনের পর দিন বিরামহীন পরিশ্রমের মধ্যে সামান্য সময়ের জন্য চেয়ারে হেলান দিয়ে বা মেঝেতে বসে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বিশ্রামের দৃশ্য। বর্তমানে ইতালি, স্পেন ও আমেরিকার দৃশ্যও চীনের মতই। সেখানেও অনেক স্বাস্থ্য সৈনিককে জীবন দিতে হয়েছে আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে। আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধু নিউইয়র্কের একটি হাসপাতালে মেডিকেল টেকনিশিয়ান হিসাবে কাজ করছেন। গত দুই সপ্তাহ নাওয়া-খাওয়া ভুলে জীবন বাজি রেখে দেশের ক্রান্তিলগ্নে হাসপাতালেই অবস্থান করছেন শুধু মানবতার সেবায়।
বাংলাদেশ করোনায় আক্রান্ত হলেও অবস্থা এখনো তেমন ভয়াবহ রূপ নেয়নি। যে যা-ই বলুক, আজ (৪ এপ্রিল) পর্যন্ত সরকারি হিসাব মতে, করোনায় আক্রান্ত ৭০ জনের মধ্যে ৮ জন মারা গেলেও ৩০ জন সুস্থ হয়েছেন। আমাদের হাসপাতালগুলোর যে অরাজক অবস্থা চলছে, তার জন্য দায়ী কে জানি না। তবে চিকিৎসাসেবায় যারা নিয়োজিত আছেন; তারা অবশ্যই অবগত আছেন এটি একটি মহৎ পেশা। চিকিৎসক ও নার্সরা নিজের জীবন উৎসর্গ করে অপরের জীবন বাঁচাতে প্রস্তুত- এবার করোনা যুদ্ধই তার একটি বড় প্রমাণ। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেও নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন অসুস্থ মানুষের সেবায়। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে তারই সেবায় সুস্থ হয় হাজারও ব্রিটিশ যুদ্ধাহত সৈনিক। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনেক ডাক্তার ও নার্সের নাম লেখা থাকবে।
২০২০ সালে এসে যদি আমাদের স্বাস্থ্য সৈনিকরা করোনার ভয়ে গৃহবন্দি হয়ে থাকেন। তাহলে আমাদের অসহায় মানুষগুলো চিকিৎসাসেবার জন্য কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন? করোনা একটি ছোঁয়াচে ভয়ঙ্কর ভাইরাস। এর কোনো প্রতিষেধক নেই। এর জন্য কি অন্যান্য রোগে আক্রান্তরা বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে? না, এমনটি হয় না।
সরকারি তথ্যমতে, আমাদের করোনার জন্য বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ও ইউনিট করা হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত সন্দেহভাজনরা সে সব হাসপাতাল ও ইউনিটগুলোতে চিকিৎসার জন্য যাবেন। কেউ করোনার লক্ষণ গোপন করে অন্য ডাক্তার বা চিকিৎসাকেন্দ্রে যাবেন না। কারণ আপনার জন্য অন্য কেউ আক্রান্ত হোক বা অন্য কারো স্বাস্থ্যসেবার বিঘ্ন ঘটুক, এটা করোরই কাম্য নয়। আমাদের যারা স্বাস্থ্য সৈনিক অর্থাৎ চিকিৎসাসেবার সঙ্গে যারা জড়িত আছেন; তাদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা সাধারণ চিকিৎসা প্রার্থীদের প্রতি সদয় হোন। আমাদের জীবন-মরণ অনেকটা আপনাদের ওপর নির্ভর করে। একজন মানুষ বিভিন্ন হাসপাতলে ঘুরে ন্যূনতম চিকিৎসাসেবা না পেয়ে যখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, এর চেয়ে অমানবিক আর কী হতে পারে?
হ্যাঁ, ভয়াবহ এ সংক্রমণের মুহূর্তে আপনাদেরও নিরাপত্তা খুবই জরুরি। কিন্তু কেন জানি এ গুরুত্বটা মোটেও মূল্যায়ন করা হয়নি। আপনাদের পুরোপুরি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়েছিল তারা। এ জন্যই হয়তো আজ আমাদের এমন বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। যেহেতু সরকার কিছুটা হলেও আপনাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে বলে আমরা শুনছি। তাই আশা করি স্বাস্থ্যখাতের গত কয়েক দিনের এ চরম হতাশা ও বিশৃঙ্খলা কাটিয়ে একটি সুস্থ পরিবেশে আমাদের সেবায় উৎসর্গ করবেন- এমনটাই কামনা করছি।
লেখক : কলামিস্ট
এসইউ/এমকেএইচ