সুঁই-সুতায় বদলেছে ২ শতাধিক অসহায় নারীর জীবন
মাত্র ২০ গজ কাপড় আর একটি সেলাই মেশিন নিয়ে ১৫ বছর আগে কাজ শুরু করেছিলেন রোমেনা বেগম। সুঁই-সুতাই বদলে দিয়েছে তারসহ শতাধিক অসহায় নারীর জীবন। আজ তার ঝিনাইদহ শহরে একটি বাড়ি হয়েছে, আছে বিশাল শো-রুম। ঢাকা, খুলনা ও বরিশালসহ নানা স্থানে তার হাতের কাজের বিভিন্ন পণ্য সরবরাহ হচ্ছে। তার অধীনে কাজ করে কমপক্ষে দুইশ অসহায় নারী সংসারে স্বচ্ছলতা এনেছেন। এটি সম্ভব হয়েছে সমবায় অফিসের পরামর্শ, প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতার কারণে।
জানা যায়, রোমেনা বেগম (৪৬) ঝিনাইদহ শহরের গীতাঞ্জলি সড়কের বাসিন্দা মো. ইয়াসিন আলী বিশ্বাসের স্ত্রী। ১৯৮৬ সালে তাদের বিয়ে হয়। এরপর এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে পাস করে সংসারী হয়ে যান। বিয়ের পর তাদের সংসার ভালোভাবে চলছিল না। সে কারণে ২০০৫ সালে স্বামী-স্ত্রী শহরে চলে আসেন। এখানে স্বামী ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু তেমন পুঁজি না থাকায় ব্যবসাও ভালো চলছিল না।
এ অবস্থায় তিনি সিদ্ধান্ত নেন, নিজে কিছু একটা করবেন। ছোটবেলা থেকেই হাতের কাজের প্রতি তার ঝোঁক ছিল। তাই বেছে নেন হাতের কাজ। শুরু করেন নকশী কাঁথা, থ্রি পিস, কুশন, বেডসিট, বালিশের কভারসহ নানা পণ্য তৈরির কাজ। তাতেও সফলতা আসেনি। ২০১৪ সালে জেলা সমবায় অফিসের কর্মকর্তারা তার পাশে দাঁড়ান। প্রথমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এরপর নানা পরামর্শ দেন। তারা রোমেনার তৈরি বিভিন্ন মালামাল মেলার স্টলে প্রদর্শন করেন। এভাবেই তার পণ্যগুলো জনপ্রিয়তা পায়। মেয়ে রুবিনা ইয়াসমিনকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে রিয়াজ আহম্মেদ পড়াশোনা করছে। স্বামীর শহরে ছোট একটি কসমেটিক্সের দোকান আছে।
রোমেনা বেগম জাগো নিউজকে জানান, যখন এ কাজ শুরু করেন; তখন সেলাই মেশিন কেনার পর পুঁজি ছিল মাত্র ২০ গজ কাপড় কেনার টাকা। তা দিয়ে শুরু করেন কাঁথা সেলাইয়ের কাজ। ২ বছর পর তার কাছে প্রতিবেশীরা আসতে শুরু করেন। যারা সমাজে অসহায়। অনেক নারী আছেন; যাকে স্বামী তালাক দিয়েছে। আবার অনেকে আছেন, স্বামী আরেকটি বিয়ে করেছেন।
রোমেনা জানান, এসব অসহায় নারীদের কথা শুনে তিনি তাদের কাজে যুক্ত করেন। একসঙ্গে কাজ দেন ৮-১০ জন নারীকে। কাজের পরিধি বেড়ে গেলে তিনি প্রতিষ্ঠানের নাম দেন ‘সেল্টার সমাজকল্যাণ সংস্থা’। ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি বাড়িতে বসে অসহায় নারীদের নিয়ে কাজ করেছেন। এরপর ঝিনাইদহ সমবায় অফিসের কর্মকর্তারা তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি সমবায় থেকে নিবন্ধন নেন। বর্তমানে তার সংগঠনের সদস্য ৩৮ জন। তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এ সংগঠনের মাধ্যমে বর্তমানে কালীগঞ্জে ২০ জন, যশোরে ৫০ জন, খাজুরায় ৩০ জন, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক নারী কাজ করছেন।
তিনি আরও জানান, সমবায় অফিস থেকে এ পর্যন্ত ৩০ জন নারী সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বর্তমানে তিনি মাসে ৩ লক্ষাধিক টাকার পণ্য বিক্রি করছেন। এ থেকে তার আয় হচ্ছে ২০-২৫ হাজার টাকা। যা স্বামীর আয়ের পাশাপাশি সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে সহায়ক হচ্ছে। তাছাড়া এখানে কাজ করে অনেক নারীর সংসারে স্বচ্ছলতা এসেছে। তাদের সমিতির বর্তমান মূলধন ২০ লাখ টাকা। সঞ্চয় আমানতের পরিমাণ প্রায় ৮০ হাজার টাকা।
লক্ষ্মীকোল গ্রামের সখিনা খাতুন জানান, ১০ বছর আগে বিয়ে হয়েছিল তার। দুই বছর সংসার করার পর স্বামী তাড়িয়ে দেয়। এরপর আশ্রয় হয় বৃদ্ধা মা মোমেনা খাতুনের সংসারে। এ কাজ করে মাসে ৪-৫ হাজার টাকা আয় হয়। এ আয়ে সংসার চালিয়ে ৪ শতক জমিও কিনেছেন তিনি। সেখানে টিনের ঘর করে মাকে নিয়ে থাকেন।
দশম শ্রেণির ছাত্রী সার্থী কর্মকার জানায়, হতদরিদ্র বাবা বিশু কর্মকার তার পড়ালেখার খরচ দিতে পারেন না। এখন পড়ার ফাঁকে ফাঁকে কাজ করে সে। এতে পড়ালেখার খরচ জোগাড় হয়ে যায়।
ঝিনাইদহ জেলা সমবায় কর্মকর্তা মো. আহসান হাবিব জানান, শুধু রোমেনা নয়; তারা জেলার বিভিন্ন এলাকায় অনেককে এভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে সাবলম্বী করে গড়ে তুলেছেন।
আব্দুল্লাহ আল মাসুদ/এসইউ/এমকেএইচ