অভিজাত খাবারের আড়ালে হারাচ্ছে পিঠাপুলি
কবি সুফিয়া কামাল তার ‘পল্লী স্মৃতি’ কবিতায় বলেছিলেন, ‘পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসে খুশীতে বিষম খেয়ে,/ আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি খেয়ে।’ কবিতার চরণ দুটি আজ যেন ফিকে হয়ে আসছে। আমরা যেন পল্লির সেই স্মৃতি হারাতে বসেছি। শহরের অভিজাত খাবারের আড়ালে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে সেসব ঐতিহ্যবাহী পিঠাপুলি।
সংগীতশিল্পী কিশোর কুমারের ‘পৃথিবী বদলে গেছে, যা দেখি নতুন লাগে’র মতো বর্তমান বাস্তব জীবনের অবস্থাও যেন তেমন। পাল্টে গেছে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর মানুষের শিল্প-সংস্কৃতি। একসময় ক্যালেন্ডারে পৌষ মাস এলেই গ্রামবাংলার মা-বোনেরা পৌষ পার্বণকে উপলক্ষ্য করে মেতে উঠতেন।
গোলাভরা ধান থেকে চাল সংগ্রহ করে পৌষসংক্রান্তির দিন বাড়ি বাড়ি তৈরি হতো পিঠাপুলি। যেন গ্রামজুড়ে এক মহা উৎসব। খেজুর গুড় বা রসের সহযোগে নারকেল আর নতুন চালের গুঁড়ার মিশ্রণে তৈরি হতো মুখরোচক কতসব পিঠা। সেসবের নাম না হয় না-ই নিলাম। এসবই তো ছিল পৌষ পার্বণের অন্যতম অনুষঙ্গ।
সেসব যেন আজ ঠাঁই পেয়েছে ইতিহাসের পাতায়। আমরা এখন ভুলে যাচ্ছি সেসব উৎসবের কথা। মেতে উঠেছি বার্গার, মোমো, পিৎজা, বিরিয়ানিতে। তবে কিছু কিছু জায়গায় পিঠাপুলির দেখা মিললেও সেখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ব্যবসার ছোঁয়া। গ্রামীণ সেই উদারতা মোটেই চোখে পড়ে না।
এখন বাড়িতে তৈরি পিঠা খাওয়া হয় না। অনলাইন বা সুপারশপে পাওয়া পিঠায় মায়ের হাতের ছোঁয়া তো নেই। নেই গ্রামের সেই চিরচেনা স্বাদও। এসবের মধ্যে পুরোনো দিনের সংস্কৃতির কোনো ছোঁয়া নেই। নেই ভালোবাসার পরশ। কিংবা পারিবারিক বন্ধনও।
একসময় গ্রামে গ্রামে শিউলিরা খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে জ্বাল দিয়ে তৈরি করতো সুগন্ধে ভরপুর গুড়। সেই গুড় দিয়েই খাওয়া হতো পিঠা। অথচ এখন অন্য পেশার দিকে ঝুঁকছেন গ্রামবাংলার শিউলিরা। কারণ মানুষের হাতে এখন সময় কম। এখন যা কিছু করতে হয়, দ্রুততম সময়েই করতে হয়।
এসব যেন আজ কবিতা কিংবা ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছে। নগর সভ্যতায় এখন গ্যাসের চুলায় ননস্টিক কড়াইয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে তৈরি হচ্ছে পিঠা। খাঁটি গুড়ের বদলে এখন খেজুর রসের ফ্লেভার মেশানো সুগন্ধি তরল। সব মিলিয়ে আজ সেই পৃথিবী আর আগের মতো নেই। হারাচ্ছে সবই। হারাচ্ছি সবাই।
এসইউ/এমকেএইচ