স্কুবা ডাইভার শরীফ সারওয়ার দেশের জন্য বিলিয়ে দিচ্ছেন নিজেকে
অন্যরকম এক চ্যালেঞ্জের নাম আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফি। পানির নিচে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই তা করতে হয়। তবে পানির নিচে যাওয়ার জন্য সবার আগে দরকার স্কুবা ডাইভিং প্রশিক্ষণ। এই স্কুবা ডাইভিং প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজন কিছু যোগ্যতা। কারণ একটু ভুলেই চলে যেতে পারে মূল্যবান জীবন।
এত সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই ২০১২ সাল থেকে দিনের পর দিন সাগরের তলদেশে প্রাণ-বৈচিত্রের ছবি তুলে যাচ্ছেন আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফার শরীফ সারওয়ার। তিনি নরসিংদী জেলার রায়পুর উপজেলার দরি হাইর মারা গ্রামের গোলাম সারওয়ারের ছেলে। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। ১৯৯৭ সাল থেকে জাতীয় দৈনিকে ফটোসাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। দৈনিক প্রভাত, ডেইলি নিউজ টুডে, প্রথম আলোসহ সর্বশেষ ২০০৯ সাল পর্যন্ত যায়যায়দিনের প্রধান ফটোসাংবাদিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
অন্যরকম নেশায় যাত্রা শুরু করেন আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফিতে। নিজের এবং সাগরতলের নানা বিষয় নিয়ে শরীফ সারওয়ার কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘একসময় ফটোসাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছি। রাজপথে রাজনৈতিক হাঙ্গামা, রক্তারক্তির অনেক ছবি তুলেছি। কিন্তু তা ভালো লাগত না। মনে অন্যরকম কিছুর ভাবনা আসে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি ও ডিসকভারি চ্যানেলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সমুদ্রতলের জীববৈচিত্র দেখে ভাবতাম, আমিও একদিন এমন ছবি তুলব। দেশের বিশাল একটি অংশ পানির নিচে। কিন্তু সেই সমুদ্রের নিচে কী আছে, তা আমার ক্যামেরায় আবিষ্কার করব। সেই ভাবনা থেকেই স্কুবা ডাইভের প্রশিক্ষণ নেই। সেই যে শুরু, আজও রোমাঞ্চিত করে চলেছে আমাকে।’
শরীফ ভালো চাকরি ছেড়ে অনিশ্চিত পেশা বেছে নিয়েছেন। নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে দিনের পর দিন ছবি তুলে এনেছেন সমুদ্রের তলদেশ থেকে। থাইল্যান্ডে গিয়ে নিয়েছেন উচ্চতর প্রশিক্ষণ। পেয়েছেন স্কুবা ডাইভিংয়ের আন্তর্জাতিক সনদ। নিজে লাভবান না হলেও দু’হাতে দেশকে দিয়ে যাচ্ছেন। বঙ্গোপসাগর ছাড়াও দেশের বিভিন্ন নদী, হাওর ও জলাশয়ে ছবি তুলেছেন। কাপ্তাই হ্রদ, লালাখাল, হাকালুকি ও টাঙ্গুয়ার হাওর, রামসাগর, দেবতার পুকুর, বগা লেক, কর্ণফুলী নদী, মাতামুহুরী নদী, ব্রহ্মপুত্র নদ, হালদা নদীর তলদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের স্বার্থে। জীববৈচিত্রের দুর্লভ ছবি তুলে এনেছেন ক্যামেরায়।
> আরও পড়ুন- জেনে নিন মুসলিম বিজ্ঞানীদের যতো আবিষ্কার
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদফতর, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ফিশারিজ ডিপার্টমেন্ট, সেভ আওয়ার সি, ইসাবেলা ফাউন্ডেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুলজি ও ইনভায়রনমেন্ট ডিপার্টমেন্ট তার তোলা ছবির সাহায্যে মাছ, কোরাল, শৈবাল ও জলতলের জীববৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা করছে।
শরীফ সারওয়ার জানান, ২০১২ সালে ওসানিক স্কুবা ডাইভিং সেন্টারে (সেন্টমার্টিন) ট্রেনিং শুরু করেন। ২০১২ সালে পিএডিআই ওপেন ওয়াটার (আন্দামান, থাইল্যান্ড) এবং ২০১৪ সালে পিএডিআই অ্যাডভান্স ওপেন ওয়াটারে (গলফ অব থাইল্যান্ড) কোর্স করে আন্তর্জাতিক লাইসেন্স পান। এছাড়া বাংলাদেশের ওসানিক স্কুবা ডাইভিং সেন্টার থেকে সারা বছরই বঙ্গোপসাগর, বিভিন্ন নদী, হাওর, লেকে আন্ডারওয়াটার এক্সপেডিশন করে আসছেন।
২০১২ সালে বঙ্গোপসাগরে আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফি ও ভিডিওগ্রাফি শুরু করলেও ভারতের আন্দামান সাগর, গলফ অব থাইল্যান্ড সাগরের নিচে গেছেন। থাইল্যান্ডে সর্বোচ্চ ৪০ মিটার নিচে গিয়ে বাংলাদেশের পতাকা তুলে ধরেছেন। সেই সাথে তুলে এনেছেন সাগরের নানা জীববৈচিত্রের দুর্লভ ছবি। গবেষণা জাহাজ ‘মীন সন্ধানী’তে করে বঙ্গোপসাগরের তিমি আর হাঙ্গরের আস্তানা ‘সোয়াস অব নো গ্রাউন্ডে’ স্কুবা ডাইভিং, আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফি ও ভিডিওগ্রাফি করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।
রোমাঞ্চকর এ পেশায় রোমাঞ্চ যেমন আছে; তেমনি আছে ভয়। শরীফ সারওয়ার জানান, ভয়ঙ্কর প্রাণীর দর্শন যেমন তিনি পেয়েছেন; তেমনি দিয়েছেন সাহসী ডুবও। পৃথিবীর অন্যতম গভীরতম খাদ হিসেবে পরিচিত বঙ্গোপসাগরের সোয়াস অব নো গ্রাউন্ডের তিমি, হাঙ্গরসহ সামুদ্রিক নানা প্রাণীর আস্তানায় ২০১৭ সালে স্কুবা ডাইভিংয়ে নেমেছিলেন। সাহসের সঙ্গে ছবি তোলার কাজটিও করে এসেছেন তিনি।
পানির নিচে একটু হেরফের হলেই যে প্রাণ সংহারের আশঙ্কা, তার উদাহরণ দিলেন কথায় কথায়। শোনালেন সমুদ্রতলে বিষাক্ত প্রাণীর সংস্পর্শের ঘটনা। বঙ্গোপসাগরেই তিনি দেখা পেয়েছিলেন লায়ন ফিশের। বিষাক্ত কাঁটাওয়ালা এ মাছের কাঁটা গায়ে লাগলেই সর্বনাশ। শুধু লায়ন ফিশের ছবিই নয়, সি আর্চিন, স্টিংরে, স্করপিয়ন ফিশের মতো বেশ কিছু মাছ ও প্রাণীর দুর্লভ ছবি তুলেছেন বিভিন্ন সময়।
শরীফ সারওয়ার বলেন, ‘সাগরের নিচে অনেক প্রাণীর কথাই আমরা জানি না। তাদের কোনোটা বিষাক্ত, কোনোটা ক্ষতিকর। জলের তলে তাদের সৌন্দর্য সারাক্ষণ মোহিত করে। তাই সবসময়ই বিপদ সঙ্গে নিয়ে চলতে হয়। তবে সাগরতলের প্রাণী ভয়ঙ্কর হলেও আচরণ সম্পর্কে জানা থাকলে খুবই বন্ধুসুলভ হয়। সহজে ক্ষতি করে না। হাঙ্গর, অক্টোপাস ও হোয়েলশার্ককে আমরা ভয়ঙ্কর মনে করলেও মোটেও ভয়ঙ্কর নয়। বরং জলের তলে তারা খুবই বন্ধুসুলভ।
আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফিতে অনেক চ্যালেঞ্জ নিতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘একটু ভুলে হারাতে হতে পারে মূল্যবান জীবন। অনেক সময় সাগরের নিচে একটু ভুল হলেও জীবন হারাতে হবে। সবচেয়ে বড় হচ্ছে সাগরতলের জীববৈচিত্র বিষয়ে জ্ঞানের অভাব। ক্যামেরা নিয়ে পানির নিচে নামার আগে জানতে হবে ওখানকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র সম্পর্কে। কেবল পরিবেশ রক্ষার জন্য নয়, নিজের নিরাপত্তার জন্যও। কোন প্রাণীটি বিষাক্ত বা কোনটি বর্ণচোরা, সেটি বুঝতে হবে আপনাকে। কেবল নিজেকে রক্ষার জন্যই নয়, নিজের অজান্তেই তাদের কোনো ক্ষতি যেন না হয়, সেটি খেয়াল রাখার জন্যও। এমন আরও হাজার দরকারি তথ্য যেগুলো জানা না থাকলে কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানেই বিপদে পড়তে পারেন।’
শখের বসে নিজের একমাত্র ছেলে স্ট্যান্ডার্ড সিক্সের ছাত্র শায়ান সারওয়ারকেও দিচ্ছেন স্কুবা ডাইভিং প্রশিক্ষণ। গত ডিসেম্বরে ছেলেকে সেন্টমার্টিনে নিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তার ইচ্ছা- ছেলেও যেন দেখতে পারে সাগরতলের অন্য জগত। সাগরতলের অন্য জগত দেখতে পারলেই খুলে যাবে মনের ভেতরের হাজার চোখ। তবে শরীফ সারওয়ারের এই চ্যালেঞ্জিং পেশায় স্বজনদের থাকতে হয় চিন্তিত। শরীফ সারওয়ারের স্ত্রী ইফফাত জাহান লিয়া বলেন, ‘সে যখন সাগরের নিচে থাকে; তখন খুবই টেনশনে থাকি। সে এ পেশার জন্য এত টান অনুভব করে যে, আমরা যদি বাধা দেই, তাই অনেক সময় না বলেই চলে যেত। এসে বলতো, সাগর থেকে এসেছি। আমি বুঝেছি যে, সে কাজটা হৃদয় দিয়ে ভালোবাসে। তাই এখন আর বাধা দেই না।’
> আরও পড়ুন- কফি আবিষ্কার করেছিলেন এক মুসলিম রাখাল
শরীফ সারওয়ার অর্জন করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম পুরস্কার, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন পুরস্কার, বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি পুরস্কারসহ ২০টি পুরস্কার। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন আয়োজিত সংবাদপত্রে প্রকাশিত আলোকচিত্রের জন্য ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’ উপাধি লাভ করেন। ২০১৯ সালে আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফির জন্য বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন আয়োজিত জাতীয় ফটো প্রতিযোগিতায় স্পেশাল জুরি বোর্ড অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন।
শরীফ সারওয়ার ওসানিক স্কুবা ডাইভিং সেন্টারের সাথে সাগরের প্রতি সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। তারা ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সাগরতলে পরীক্ষামূলক কোরাল নার্সারি এবং ২০১২ সাল থেকে প্রতি বছর সাগরতলে আন্ডারওয়াটার ক্লিনআপ করে আসছেন।
কিছু দুঃখও আছে শরীফ সারওয়ারের। তিনি বলেন, ‘বিদেশের আন্ডারওয়াটার এক্সপ্লোরাররা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে। আমরা অর্থাভাবে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারি না। তাই আমদের রিস্ক নিতে হয় বেশি। তবুও আমাদের কাজ আন্তর্জাতিক মানের। সাগর জয়ের পর সরকার যে ব্লু ইকোনমির কথা ভাবছে, সেখানে বড় একটি ভূমিকা রাখতে পারে আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফি। সরকারের সামান্য পৃষ্ঠপোষকতা পেলেই আমরা আন্তর্জাতিক মানের কাজ দিতে পারি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাইরের দেশে আন্ডারওয়াটার এক্সপ্লোরাররা তাদের সরকার বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকেই কাজের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। তবে সরকার পাশে না থাকলেও দেশমাতার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই দেশের সাগরতলের জীববৈচিত্রের সন্ধানে নিজের জীবনের শেষ সময়টুকুও দিয়ে যাব। বঙ্গোপসাগর আমার বাড়ি, ঘর, সংসার, আমার স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। এখান থেকেই আমি শিখছি প্রতিনিয়ত। আমার পরম ভালো লাগা, ভালোবাসা।
এসইউ/এমকেএইচ