শীতলপাটি বিক্রি করেই চলে সংসার
তীব্র গরমে অস্থির হয়ে একটু শান্তির পরশ পেতে শীতলপাটির বিকল্প নেই। এ কারণে শীতলপাটির বিক্রি বর্তমান মৌসুমে যেমন বেড়েছে, তেমন পাটি তৈরির কারিগরদের ব্যস্ততাও বেড়েছে। ঝালকাঠির শীতলপাটির বিশেষ কদর রয়েছে দেশ-বিদেশে। তাই জেলার রাজাপুরের বেশ কয়েকটি গ্রামে ৯০ বছরের বৃদ্ধ থেকে শুরু করে ৮-১০ বছরের শিশুরাও নিপুণ কারুকাজে ব্যস্ত সময় পার করছে।
পাটি শিল্পীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ঝালকাঠির শীতলপাটি বহুকাল ধরে দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। এখানকার চিকনবেতির শীতলপাটির চাহিদাও প্রচুর। এ অঞ্চলে অতিথিদের সামনে একটি ভালো মানের শীতলপাটি বিছিয়ে নিজেদের আভিজাত্যকে ফুটিয়ে তোলা হয়। পাটি শিল্প তাই বাংলাদেশের লোকাচারে জীবনঘনিষ্ঠ ও ঐতিহ্যবাহী লৌকিক উপাদান।
গরমের মৌসুমে এসব পাটি তাপে খুব বেশি গরম হয় না বলে একে শীতলপাটি বলা হয়। পাইত্রা বা মোর্তা নামে এক ধরনের বর্ষজীবী উদ্ভিদের কাণ্ড থেকে বেতি তৈরি করা হয়। পরিপক্ক পাটি গাছ কেটে পানিতে ভিজিয়ে তারপর পাটির বেতি তোলা হয়। এরপর ভাতের মাড় ও পানি মিশিয়ে বেতি জ্বাল দেওয়া হয়। এর ফলে বেতি হয়ে ওঠে মসৃণ ও সাদাটে। বেতির উপরের খোলস থেকে শীতলপাটি, পরের অংশ তুলে বুকার পাটি এবং অবশিষ্ট অংশ ছোটার (চিকন দড়ি) কাজে ব্যবহৃত হয়।
> আরও পড়ুন- শিক্ষিকার মেয়ে দেশের প্রথম নারী শিক্ষামন্ত্রী
বর্তমানে ঝালকাঠি জেলায় তিনশ’র বেশি পরিবার এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। রাজাপুর উপজেলার হাইলাকাঠি ও ডহরশংকর গ্রামে রয়েছে দুই শতাধিক পরিবার। এরা সবাই পাটি বুনে জীবিকা নির্বাহ করে। পুরাতন ঐতিহ্যের কারু হাতে গড়া শীতল পাটির জন্য এ গ্রাম দু’টিকে ‘শীতল পাটির’ গ্রামও বলা হয়। এ গ্রামের শত শত হেক্টর জমিজুড়ে রয়েছে বিশাল নজরকাড়া পাটিগাছের বাগান।
এখানে শীতলপাটি, নামাজের পাটি ও আসন পাটি নামে তিন ধরনের পাটি তৈরি করা হয়। পাটির বুনন পদ্ধতি প্রধানত দুই ধরনের। প্রথমত, পাটির জমিনে ‘জো’ তুলে তাতে রঙিন বেতি দিয়ে নকশা তোলে। দ্বিতীয়ত, পাটির জমিন তৈরি হলে তার চতুর্দিকে অন্য রঙের বেতি দিয়ে মুড়ে দেয়।
পারিবারিক ও উত্তরাধিকার সূত্রে পাটিকরদের পেশা এগিয়ে চলছে। শৈল্পিক উপস্থাপনায় এবং নির্মাণ কুশলতার কারণে দক্ষ ও সুনিপুণ একজন পাটিয়াল নারীর কদরও রয়েছে সর্বত্র। একটি পাটি বুনতে ৩-৪ জনের দুই-তিন দিন সময় লাগে। যা বিক্রি করে পাঁচশ’ থেকে দেড় হাজার টাকা আসে। মহাজনরা প্রতি পাটিতে একশ’ থেকে পাঁচশ’ টাকা লাভ করেন।
> আরও পড়ুন- মালয়েশিয়া প্রবাসী অগস্টিনের সফলতা
পাইত্রা চাষ ও কেনার জন্য প্রচুর মূলধন প্রয়োজন হয়। এজন্য শিল্পীরা মহাজন ও এনজিওর কাছে হাত পাততে বাধ্য হয়। এ শিল্পের সাথে জড়িতদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে না। ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা না থাকায় পুঁজির জন্য শিল্পীরা দাদন ব্যবসায়ী, সুদখোর মহাজনদের কাছে জিম্মি হয়ে থাকেন। তাছাড়া বিদেশে ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত শীতলপাটি রফতানিযোগ্য পণ্যের স্বীকৃতি পায়নি।
মঞ্জুরানী পাটিকর বলেন, ‘আমাদের শীতলপাটি দেশ-বিদেশের বিভিন্নস্থানে মেলা কিংবা বাজারে বিক্রি হচ্ছে। আমাদের অন্যকোন উপার্জন নেই। শুধু শীতলপাটি বিক্রি করেই সংসারের খরচ এবং ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া চালাই। শীত এবং বর্ষায় আর্থিক সংকটে ভুগতে হয়। সরকার বিনাসুদে ঋণ দিলে বেশি পাইত্রা কিনে শীতলপাটি তৈরি করা যেত।’
৮ম শ্রেণির ছাত্রী মৌসুমি জানায়, তাদের পরিবারের সবাই পাটি বুনতে পারে। বাবা-মাকে সহযোগিতা করার জন্য পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি পাটি তৈরি করেন। এতে বাবা-মাও তার প্রতি খুশি।
> আরও পড়ুন- ঘুরে ঘুরে ফুলের চারা বিক্রি করে বাড়তি আয়
পাটি শিল্পী সমিতির সভাপতি বলাই চন্দ্র পাটিকর বলেন, ‘সরকার হাইলাকাঠি গ্রামের পাটি শিল্পীদের সরকারিভাবে কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এসএমই খাতের আওতায় ঋণ দিয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ২৫ জন পাটি শিল্পীকে ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ দিয়েছে। তবে বিনাসুদে ঋণ দিলে আমরা উপকৃত হবো।’
ঝালকাঠির ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মো. দেলোয়ার হোসেন মাতুব্বর বলেন, ‘চাহিদা থাকা সত্ত্বেও পাটি বিপণন ত্রুটি থাকায় বছরের একটি সময় তাদের বসে থাকতে হচ্ছে। আমরা সরকারের অতিদরিদ্র্য কর্মসৃজন কর্মসূচির মাধ্যমে দরিদ্র্য পাটি শিল্পীদের কাজের আওতায় আনার চেষ্টা করছি। হয়তো এটি অচিরেই সম্ভব হবে।’
মো. আতিকুর রহমান/এসইউ/এমকেএইচ