ঐতিহ্য হারিয়েছে রাজধানীর মেরাদিয়া হাট
রাজধানীর বুকে ঐতিহ্যবাহী মেরাদিয়ার হাট। ঢাকায় রামপুরার দক্ষিণ বনশ্রীতে অবস্থিত হাটটি শত বছরের। এই হাট বসে প্রতি বুধবার। চলে সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত। বিশাল এক বটগাছকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই হাট স্থানীদের ভাষায় ‘মেরাইদ্দা হাট’ নামে পরিচিত।
এক সময়ের গ্রাম্য পরিবেশের হাট আজ তা পরিবর্তিত নগরায়নের ফলে ঐতিহ্য আর জৌলুস হারিয়েছে। নষ্ট হয়ে গেছে সৌন্দর্য। যে বটগাছকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল হাট আজ আর তা নেই। ভূমিদস্যুদের গর্ভে চলে গেছে কয়েক বছর আগে। হাটটি আর কতোদিন বেঁচে থাকবে তা এখন নির্ভর করছে জনগণ ও প্রশাসনের সদিচ্ছার ওপর।
গৃহস্থালি দ্রব্যাদি থেকে শুরু করে তাজা শাঁক-সবজি ফলমূল সবই রয়েছে এ হাটে। তবে হাটের মেরাদিয়া মূল আকর্ষণ তা হলো নানা পদের মিষ্টির সমাহার। মিষ্টির মধ্যে রয়েছে বালিশ, রসগোল্লা, চমচম, গজা ইত্যাদি। স্বল্প মূল্যে নানা পদের মিষ্টির স্বাদ পাওয়া যায় এ হাটে।
এছাড়াও রয়েছে মুরকি, বাদাম, ভাজাপোড়া জাতীয় খাদ্য। হাঁস-মুরগি, নানা জাতের কবুতর, পাখি, বিভিন্ন রকমের বীজ, গৃহস্থালি দ্রব্যাদি, ফলমূল, শুটকি, বাঁশ ও বাঁশের তৈরি পণ্য, ভেদ ও কুঠির শিল্পের তৈরি বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী।
হাটে আরো পাওয়া যাবে বিভিন্ন প্রকারের দেশীয় মৌসুমী ফল। যেমন- পেয়ারা, আমড়া, আমলকি, জাম্বুরা, নানা জাতের কলা, ডাব, নারিকেল, আতাফলসহ নানা রকম ফল।
হাটে আসতেই শুরুতে আপনি পাবেন কাপড়ের দোকান। এসব অস্থায়ী দোকানে মূলত নারী ও শিশুদের কাপড়। তাই এক সময় হাটে নারীদের উপস্থিতি কম থাকলেও এখন পুরুষের চাইতে নারীদের ভিড় একটু বেশি।
এদিকে গ্রামের হাটের মতই এই হাট সপ্তাহে একদিন অর্থাৎ বুধবার বসে। রোদ-গরম, ঝড় বৃষ্টি যাই হোক হাট বসবেই। মেরাদিয়ার হাটের নির্দিষ্ট কোন পরিসর নেই।
হাটটি কখনো ছোট পরিসরে হয় আবার কখনো তা বনশ্রীর আবাসিক ব্লকের ভেতর পর্যন্ত চলে যায়। তবে মোটামুটি বলতে গেলে বনশ্রী আল-রাজি হাসপাতাল থেকে শুরু হয়ে পূর্ব দিকে ফয়জুর রহমান স্কুল পর্যন্ত হাটের বিস্তৃতি থাকে।
এই হাট কবে থেকে শুরু হয়েছে তা নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারেন না। স্থানীয়রা জানান, প্রায় শত শত বছর ধরে এই হাট চলছে। এখানে একটি বিরাট বড় বট গাছ ছিল। এই বট গাছের নিচেই মূলত হাট বসতো। হাটবারে পণ্যবাহী ট্রলার নৌকা কায়েতপারা, ইছাপুরা, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ হতে এসে দোকানিরা মালপত্র নিয়ে এসে হাটে বিক্রি করতো।
দীর্ঘ ৪০ বছর ঐতিহ্যবাহী মেরাদিয়া হাটে ব্যবসা করছে আব্দুল খালেক। হাট সম্পর্কে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমার বয়স ৬৭ বছর। আমার বাড়ি ঢাকার ডেমরায়। বাঁশের তৈরি টুকরি, কোলা, পোলো, পাটি, ছনের ঝাড়ুসহ বিভিন্ন সামগ্রী হাটে হাটে বিক্রি করি। মেরাদিয়া হাটে পণ্য বিক্রি করছি প্রায় ৪০ বছর।
আব্দুল খালেক বলেন, ‘আগে হাটে একটি খোলা মাঠের মত জায়গা ছিল। ছিল একটি বড় বটগাছ। আমরা বট গাছের ছায়ায় বসতাম। এখনকার মতো সে সময় যোগাযোগের তেমন রাস্তা ছিল না। বর্ষাকালে হাটের চারোদিকে পানি থাকতো। আমরা নৌকায় করে মাল সামগ্রী নিয়ে হাটে আসতাম। ঐদিন আর এখন নেই। হাটের ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে। মাঠ নাই বটগাছটাও কাইটা ফেলছে। আস্তে আস্তে হাটের আকার ছোট হয়ে গেছে। হাটের আশেপাশে যেভাবে বড় বড় বিল্ডিং হচ্ছে কয়দিন পর হাট থাকবে কি না তাও ঠিক নেই।’
রাজধানীর খিলগাঁও থেকে হাটে আশা এক ক্রেতা হারুন জানান, আমি ছোটবেলা থেকে এই হাটে আসি। আগে বাবার সঙ্গে আসতাম। এখানে টাটকা সবজি ও দেশীয় ফল পওয়া যায়। এছাড়া এখানকার মুড়কি ও মিষ্টি ভালো লাগে। আমি সময় পেলেই হাটে আসি। কলা, গেন্ডারি, মুড়কি কিনেছি। আরো যা পছন্দ হবে তা কিনবো।
হাটে গেন্ডারি (আখ) ব্যবসায়ী মনজুরুল বলেন, রূপগঞ্জের ইছাপুরা থেকে গেন্ডারি এনে বিক্রি করি। হলুদ এই গেন্ডারি খেতে মিষ্টি তাই অনেকে পছন্দ করে কিনে। মেরাদিয়া হাটে প্রায় ২০-২২ বছর যাবৎ গেন্ডারি বিক্রি করছি। আগে হাটটি অনেক সুন্দর ছিল এখন সেই সৌন্দর্য নেই। আগে খোলা জায়গা ছিল এখন নেই। তাই রাস্তায় বিক্রি করছি।
কিভাবে যাবেন মেরাদিয়ার হাটে?
আপনাকে প্রথমে যে কোন বাস, সিএনজি বা অন্য গাড়িতে রাজধানীর রামপুরা ব্রিজ আসতে হবে। এরপর ব্রিজ থেকে সোজা পূর্ব দিকে যে রাস্তাটি বনশ্রীর দিকে গিয়েছে এই রাস্তায় আসতে হবে। রামপুরা ব্রিজ থেকে মেরাদিয়ার হাট আসতে আপনার রিকশা ভাড়া লাগবে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। এছাড়া আপনি টেম্পুতে করেও আসতে পারবেন।
এসআই/এসএইচএস/পিআর