নদীভাঙনে দিশেহারা চার জেলার মানুষ
লক্ষ্মীপুর, শরীয়তপুর, চাঁদপুর, মাদারীপুর। এরমধ্যে লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর ও শরীয়তপুর ঝুঁকিপূর্ণ উপকূল। মেঘনা-পদ্মার ভয়ঙ্কর ভাঙনে এ চারটি জেলার মানচিত্র নদীর গর্ভে গিয়ে ঠেকেছে। ভিটে-মাটি, সহায়-সম্বল হারিয়ে পথে বসেছেন ভাঙন কবলিত মানুষ। তিল তিল করে গড়ে তোলা বহু স্বপ্ন ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে নিঃস্ব-মানবেতর জীবন-যাপন করছেন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। নদীর ভাঙন প্রতিরোধে বিজ্ঞানসম্মত উদ্যোগের অভাব সংকট আরো বাড়িয়ে তুলেছে।
সম্প্রতি পদ্মার ভাঙন বেশ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। টেলিভিশনের পর্দা, খবরের পাতা পূর্ণ হচ্ছে নদীভাঙনের সংবাদে। এখন আমরা যেন একটু বিশেষজ্ঞ হয়ে পড়েছি। যতদিন খবরের পাতা চাঙা থাকে ততদিন! কিন্তু খবরের পাতা যখন এসব খবর থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য খবরে ফেরে; তখন কি এসব মানুষ নিয়ে কেউ গবেষণা করে? বিশেষজ্ঞ হয়? না, হয় না। কারণ যখন যেটা নিয়ে গণমাধ্যম আলোচনা সৃষ্টি করে; তখন সেটা নিয়েই পড়ে থাকে বিশেষজ্ঞরা!
কোথাও কোথাও ভাঙন রোধে তীর রক্ষাবাঁধ নির্মাণ করা হলেও একবছরের মধ্যে আট বার ধসে পড়ার অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে কতটুকু নাক গলাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা? ভাঙনের সময় গণমাধ্যমের চোখ পড়লেও পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যমের চোখটা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। প্রশাসনিক খবর, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার খবরের পেছনে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এসব গুরুত্বপূর্ণ খবর প্রকাশের আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।
> আরও পড়ুন- রোভারিং চ্যালেঞ্জে দেশসেরা আশিক
স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের ভাষ্য অনুযায়ী, এসব অঞ্চলের বিশেষ খবরের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে না গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষ। ফলে কেমন জীবন কাটাচ্ছে এসব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার? মূলত তাদের সংকটটা কোথায়? এসব কিছুই থেকে যাচ্ছে গরম খবরগুলোর আড়ালে। নেই এসব বিষয়ে কোন অনুসন্ধানও।
ঢাকা শহর থেকে কোনো সাংবাদিক এসেছেন, এমন খবর ছড়িয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম। ওই সাংবাদিক কেন এসেছেন? মানুষের কথা শুনতে, মানুষের গল্প কেন্দ্রে তুলে ধরতে। সবাই ওই সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কোন চ্যানেলের বা কোন পত্রিকার?’ এই যে সাংবাদিকদের প্রতি বিপন্ন মানুষের একটা ভালোবাসা, সেটার দিকে কতটুকু খেয়াল রাখছে আজকের সাংবাদিক কিংবা গণমাধ্যম?
এদেশে বসাবসরত জনগোষ্ঠী তারা। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পেছনে তাদের রয়েছে বিরাট ভূমিকা। প্রতিনিয়ত যাদের কাছ থেকে রাষ্ট্রযন্ত্র ভ্যাট, খাজনার নাম দিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল করছে। কিন্তু ঠিক এর উল্টো পিঠে তাকালে দেখা যাবে, এর বিনিময়ে কি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে?
নদীভাঙন কবলিক মানুষ তো রোহিঙ্গা নয়, নয় ভিনদেশের মানুষ। তারা তো এদেশেরই নাগরিক। এদেশের জন্য তাদের কি কোন ত্যাগ নেই? ভাঙনের পর এসব মানুষের অবস্থানটা কোথায় গিয়ে ঠেকছে? এর খবর কি কেউ রাখতে চেষ্টা করে? ভয়াল ভাঙনের শিকার হয়ে সবশেষে থাকা সম্পদ বিক্রি করে কিংবা ঋণগ্রস্ত হয়ে কেউ জায়গা-জমি কেনেন। কিন্তু যাদের দ্বারা তা সম্ভব হয়ে ওঠে না, তাদের অবস্থাটা কী? কেউ নিঃস্ব হয়ে আশ্রয়ের জায়গা খোঁজেন আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি কিংবা অন্যের বাড়িতে। আশ্রয়হীন মানুষের আশ্রয়ের কথা কেউ কি চিন্তা করে? দেশে নদী ভেঙে লাখ লাখ মানুষ আশ্রয়হীন। তাদের আশ্রয়ের কথা তো আমরা চিন্তায় আনিনি। অথচ মিয়ানমানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা আজ আমাদের দেশে জামাই আদরে দিনের পর দিন পার করছে। সরকারি-বেসরকারি সব সুবিধাই তারা ক্রমান্বয়ে পাচ্ছেন। কিন্তু নদীভাঙা আশ্রয়হীন মানুষের জন্য আশ্রয়ন প্রকল্পের শূন্যতা কেন? তাদের নিয়ে কোন বেসরকারি দাতা সংস্থার পদক্ষেপও দেখা মিলছে না কেন?
> আরও পড়ুন- বাঁশির সুরে চলে অন্ধ সুভাষের সংসার
আসলে মূল কথা, সবখানেই আমরা সুবিধা খুঁজি! এখন রোহিঙ্গা ইস্যুটা বিশ্বের বুকে আলোচিত। তাই যত পারি এর জন্য আমাদের চেষ্টার কোন কমতি নেই। যেটা আলোচনায়, সেটা নিয়েই আমরা হুমড়ি খেড়ে পড়ি। যার মাথায় তেল আছে, আমরা তাকে আরো তেল দেই। যে পেট ভরে খেয়েছে, আমরা তাকে আরো খেতে কত না আদর-যত্ন করি। কিন্তু যে লোকটা না খেয়ে দু’মুঠো ভাতের জন্য সংগ্রামে নেমেছেন, তার মুখে একমুঠো ভাত দিতে আমাদের দয়াও হয় না। কেন? কারণটা? মানবতা বা মানবসেবা কি কোন গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত? আমরা কতটুকু মানবের মুক্তির জন্য লড়ে যাচ্ছি?
যেসব জেলাতে নদীভাঙন বেশ প্রকট, সেসব অঞ্চলে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণে সরকার কতটুকু ব্যবস্থা নিচ্ছে? কিংবা সেসব অঞ্চলে যেসব শরণার্থীরা ঠিকানা হারিয়ে বেড়িবাঁধের পাশে, অন্যের বাড়িতে কোনরকম আশ্রয়ে আছে, তাদের বাসস্থানের অধিকার নিশ্চিত করতে কতটুকু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে? আমি বলবো, দুর্নীতি থামিয়ে এসব মানুষের পাশে দাঁড়ানো উচিত। দুর্নীতি কোনভাবেই দেশে কাম্য নয়। নদীভাঙা এসব মানুষের জন্য একটি ট্রাস্ট গঠন করা হোক। যাতে এসব মানুষ তাদের প্রাপ্য অধিকারটা পায়। সংবিধানে এসব মানুষের বাসস্থানের অধিকারকে মৌলিক অধিকার বলে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আসলে সে বিষয়ে কতটুকু আলোচনা হচ্ছে?
ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকারে বেঁচে থাকুক। শুধু ভোট আসলেই তাদের কদর বাড়ে কেন? ভোটের জন্যই কি এসব মানুষের গুরুত্ব বাড়ে? তাহলে আসুন আমরা আমাদের মানসিকতা বদলাই। ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াই। একটি মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তুলি।
এসইউ/আরআইপি