ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

যানজটে প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে ৪০ লাখ কর্মঘণ্টা

সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার | প্রকাশিত: ০২:০৬ পিএম, ০৭ জুন ২০১৮

হিসেব মতে, ঢাকা শহরের যানবাহনের গতি বর্তমানে গড়ে পাঁচ কিলোমিটারের কম যেখানে একজন মানুষের পায়ে হাঁটার গতিবেগ এর থেকে ঢের বেশি। অবশ্য এ তথ্য এটা নিশ্চিত করে না যে, পাঁচ কিলোমিটার পথ একঘণ্টায় পৌঁছানো যাবেই, বরং ক্ষেত্রবিশেষ এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পাঁচ ঘণ্টা লেগে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে অনেকে ঘরে ফেরেন। এতে প্রতিদিন প্রায় ৪০ লাখ কর্মঘণ্টা মানুষের জীবন থেকে নষ্ট হয়। পথের মাঝে রয়ে যায় জীবনের মূল্যবান মুহূর্তগুলো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে মানুষের শরীর ও মনের ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়ছে, হারিয়ে যাচ্ছে কর্মদক্ষতা, হারাচ্ছে সৃষ্টিশীলতা আর সামজিক প্রতিশ্রুতি। সম্ভবত রাস্তায় চলাচলকারী পৃথিবীর সবচেয়ে ধৈর্যশীল মানুষ এই শহরে বাস করে। হাসিমুখে প্রতিদিন এক দৃশ্যের অবতারণা সহ্য করে চলে। তিন দশক আগে এখানকার যানবাহনের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। সেটা ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে একটা দুঃসহ ক্লান্তিকর অবস্থায় পৌঁছেছে। কোন নগরবিদ এ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তির কোন নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না।

এর কারণ অত্যন্ত স্পষ্ট। ঢাকা শহরে বসবাস করে প্রায় সোয়া দুই কোটি মানুষ। ২০৩০ সালে এ সংখ্যা দাঁড়াবে তিন কোটির অনেক বেশি, আর তার ঠিক পাঁচ বছর পর সংখ্যাটা হয়ে যাবে বর্তমানের দ্বিগুণ। অর্থাৎ সামনে যে ভয়াবহতা অপেক্ষা করছে সেটা সহজেই অনুমেয়। বাংলাদেশের একমাত্র শহর ঢাকা যেখানে মামলা থেকে গামলা ক্রয় পর্যন্ত সব প্রয়োজন মেটানোর জন্য মানুষ এখানে আসে। চাকরি, বদলি, তদবির, প্রমোশন, পেনশন, রাজনীতি, মিটিং, মিছিল, সমাবেশ, আন্দোলন, ব্যবসা, বিনোদন- সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা শহর। গত তিন দশকে অভাবনীয় নগরায়ন, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার, যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়ন, নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি, বেসরকারি খাত সৃষ্টি ইত্যাদির ফলে ঢাকার ওপর চাপ বেড়েছে, বেড়েছে মানুষের ঢল। এমনকি গ্রাম-গঞ্জে অভাব দেখা দিলেই মানুষ ছুটছে এ শহরে মৌসুমী আয়ের খোঁজে। বাস্তবতা হলো, ঢাকা শহর সারা দেশের মাত্র এক শতাংশ জায়গার ওপর কিন্তু মোট জিডিপির ৩৬ শতাংশ জোগান আসছে এখান থেকে। তাছাড়া সারাদেশের মোট কর্মসংস্থানের ৪৪ শতাংশ ব্যবস্থা করে শহরটি।

ঢাকা বিশ্বের অন্যতম জনবহুল মেগাসিটি। এর জনঘনত্ব পৃথিবীর যে কোন শহর থেকেই বেশি। গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্স নামে সব শহরের বাসযোগ্যতার যে তালিকা মাঝে মাঝে প্রকাশিত হয় তাতে ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকা শহরের অবস্থান নিচের দিক থেকে চতুর্থ নম্বরে। অর্থাৎ পৃথিবীর অবাসযোগ্য শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান একেবারে তলানিতে। এই তালিকায় ঢাকার নিচে আছে মাত্র তিনটি শহর- সিরিয়ার দামেস্কাস, নাইজেরিয়ার লগোস আর লিবিয়ার ত্রিপলি। মাত্র ৩২৫ বর্গ কিলোমিটার এই শহরের মাঝে সাচিবিক, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক আর প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় মাত্র ১৫ কিলোমিটার জায়গার মধ্যে। প্রতিদিন কয়েক লক্ষ নতুন মানুষ এখানে আসে নানাবিধ কাজ করার জন্য। তাছাড়া ঢাকাতে চলাচল করে ১.২ মিলিয়ন যানবাহন যার মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ২ লাখ ৬০ হাজারের মতো। আশ্চর্যের বিষয়, এসব ব্যক্তিগত যানবাহনে চলাচল করে মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬ শতাংশ মানুষ। বাকি মানুষ চলে গণপরিবহন নামে বিভিন্ন উৎপাতের ভেতর দিয়ে।

বাংলাদেশে মোট রেজিস্ট্রার্ড ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ৩ লাখ ২৭ হাজারের মতো। অর্থাৎ সারা দেশের মোট গাড়ির ৮০ শতাংশই ব্যবহৃত হয় ঢাকাতে। প্রতিমাসে নতুন গাড়ি যোগ হয় দেড় হাজারেরও বেশি। ঘন ঘন গাড়ির মডেল পরিবর্তন, একাধিক গাড়ি ব্যবহার, ব্যাংক ঋণের সহজলভ্যতা, গণপরিবহনে নৈরাজ্য, রাস্তা চলাচলে অব্যবস্থাপনা ইত্যাদির ফলে মানুষ ঝুঁকছে ব্যক্তিগত গাড়ির দিকে। একই রাস্তায় নানারকম গতির যানবাহন- রিকশা, ভ্যান, সিএনজি-চালিত অটো, ট্রাক, ঠেলাগাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, কার ইত্যাদি নির্বিঘ্নে চলাচল করে। এ ব্যাপারে কোন সুরাহা হয়নি অদ্যাবধি। আইন রক্ষার মানুষেরা এ পর্যন্ত একমত হতে পারেননি, কী করলে মানুষের দুর্ভোগ কমে।

রাস্তায় চলাচলকারী মানুষের বেশিরভাগই জানে না রাস্তা পারাপারের নিয়ম অথবা জানার পরেও তা মানে না। এই শহরের মানুষের সবচেয়ে বড় প্রবণতা হলো কত স্বল্প বিনিয়োগে বেশি মুনাফা অর্জন করা যায়; কত শর্টকাটে বেশি লাভ আসে। সেটা রাস্তা পারাপার থেকে শুরু করে প্রমোশন, ভালো রেজাল্ট, সফল ব্যবসায়ী, নামি শিল্পী হওয়া ইত্যাদিসহ সব জায়গায় এক ধরনের সরল প্রবৃত্তি দেখতে পাওয়া যায়। এক ভয়াবহ প্রতিযোগিতার মধ্যে অসুস্থ চিন্তা নিয়ে এ শহরের মানুষের ঘুম ভাঙে। প্রতিদিনের নিয়ম ভাঙার মাঝে সফলতা তাদের উৎসাহিত করে।

শহরবাসীর জন্য সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ বয়ে আনে বিভিন্ন আন্দোলনকারী, মৌসুমী দাবিদার, ব্যবসায়ী, হকার, আর ইউটিলিটি সার্ভিসের কর্তাব্যক্তিরা। উৎসব পাগল মানুষ নানা ছলে রাস্তা অবরুদ্ধ করে আনন্দ প্রকাশ করে; দাবিদারেরা রাস্তায় বসে পড়ে, বিভিন্ন সার্ভিসের লোকেরা আধুনিকায়নের নামে দুইদিন পরপর যেখানে-সেখানে খোড়াখুড়ি করে আর ব্যবসায়ীরা ফুটপাত অধিগ্রহণ করে প্রসারণ ঘটায় ব্যবসার। এর ফলে শহরের নিরীহ মানুষেরা খাঁচায় বন্দি সার্কাসের প্রাণীর মতো ধুঁকে ধুঁকে মরে। সঙ্গতকারণে গণ দুর্ভোগ দিন দিন বেড়ে চলেছে আশঙ্কাজনক হারে। কিন্তু এর সমাধান কোথায়? একটি রাজধানী তো এভাবে চলতে পারে না।

বিগত বছর দশেক ধরে চেষ্টা চলছে এটাকে বাসযোগ্য করে তোলার। নানাবিধ পরিকল্পনা নিয়ে সরকার কাজ করছে যেমন ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস, মেট্রোরেল, ইউলুপ, বাইপাস ইত্যাদি। কিন্তু এটা উত্তরণের খুব বেশি আশা অনেকেই করছেন না। তবে অনেকেই ভাবছেন, সবচেয়ে কার্যকরী কিছু হতে যাচ্ছে মেট্রোরেল প্রজেক্টের ভেতর দিয়ে। কারণ এটি হলে ঘণ্টায় প্রায় ৬০ হাজার মানুষ কম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। কিন্তু সে পরিস্থিতিতে ঢাকার চিত্রটি খুব বেশি বদলাবে না। কারণ মেট্রোরেল শুধু একটি রুটের ২১ কিলোমিটারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অন্যান্য অংশের মানুষ যে অবস্থায় আছে, তার বিশেষ কোন হেরফের হবে না।

সবচেয়ে বড় কথা হলো- যে বিপুল জনস্রোত শহরটিকে ক্লান্ত করে তুলেছে তা প্রথমেই থামাতে হবে। কেন্দ্রীভূত প্রশাসন সরাতে হবে। ঢাকামুখি মানুষকে নিরুৎসাহিত করতে নানা রকম ব্যবস্থা নিতে হবে। গণপরিবহন সহজপ্রাপ্য হতে হবে। রাস্তাকে নানাবিধ দখলদারের হাত থেকে মুক্ত করতে হবে। বাংলাদেশের অন্যান্য শহরগুলোতে প্রশাসনের কর্মকাণ্ড বিকেন্দ্রীকরণ না করতে পারলে এ চাপ দিন দিন বাড়তে থাকবে।

মনে রাখতে হবে, একটি জীবনের জন্য প্রতিটা মুহূর্ত মূল্যবান, কাজেই সেটা এভাবে পথের মাঝে নষ্ট হতে দিলে আর্থ-সাংস্কৃতিক বৈকল্য দেখা দেবে, ভেঙে পড়বে মানুষের জীবন চলার স্বাভাবিক গতি। ভবিষ্যতের সব উন্নয়নের রোড ম্যাপ (২০২১, ২০৪১) পড়বে মুখ থুবড়ে।

লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারপার্সন, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

এসইউ/আরআইপি

আরও পড়ুন