রাতের রূপরেখা
কৈশোর কাটানো রাতগুলোয় আমাদের বাতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্যও ছিল আইন-কানুন। এমনিতেই আমরা নিয়ন্ত্রিত হতাম প্রতিটি পদক্ষেপে। চলার সময় আমাদের হাত কতটুকু সম্প্রসারিত করতে হবে, প্যারেডে প্রতিটি পদক্ষেপ কতটুকু সময় অন্তর নেব, কার কতটুকু নিকটে যেতে পারবো, সূর্য গলে যাওয়া তপ্ত বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে ফল-ইনে স্থির দাঁড়িয়ে থাকার মুহূর্তে ঘাড় বেয়ে নেমে আসা ঘামের চিকন স্রোত মুছে ফেলতে পারবো কি না, এমনকি চায়ের সাথে বিস্কুট ভিজিয়ে খাওয়ার মতো অকিঞ্চিৎকর অধিকার পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত হতো। নিরবধি নিয়ন্ত্রণের ভেতর যারা বসবাসিত হয়, একটু স্বাধীনতা পেলেই তারা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। মাঝেমাঝে ভাবি, ক্যাডেট কলেজের নিয়মতান্ত্রিক ঘেরাটোপে কৈশোরের সেই নিয়ন্ত্রিত রাতগুলোর সাথে এই লাল-নীল-সবুজ-হলুদ দীপাবলির ঢাকা শহরের বেসামরিক রাতগুলোর কী দারুণ বৈপরীত্য!
এখানে বাতি নেভানোর জন্য কোন নিয়ম-অনিয়ম নেই, নেই কোন বাধ্যবাধকতা। নগরীর নিষ্প্রাণ দালানকোঠায় কখনো একযোগে নেমে আসে না নয়নাভিরাম অন্ধকার। সব রং মুছে গেলেও আয়োজন করার মতো কোন পাণ্ডুলিপি থাকে না, তাই শহরের ফ্ল্যাটগুলো একেকটি অসমাপ্ত উপন্যাস। যে উপন্যাসের অধ্যায়ে-অধ্যায়ে অপ্রেম-অস্নেহ-বিরহ-বেদনা আর সম্পর্ক ভাঙা কিংবা জীবনকে টেনে নিয়ে যাওয়ার একঘেয়ে কাহিনি। অবিশ্বস্ততা আর বিশ্বাসহীনতার পটভূমি।
ভাবি, খাকি চত্বরের রাতগুলোর মতো যদি একবার এ শহরে নেমে আসতো নিয়ন্ত্রিত রাত। কোথাও একযোগে অদৃশ্য কমান্ড হচ্ছে, লাইটস আউট। লাইটস আউট। আকাশ থেকে ভেসে আসা কোন ঘোষণা সংকেত কিংবা যুদ্ধের ময়দানে অলৌকিক আদেশবাণীর মতো কিছুটা বাস্তব, কিছুটা অপার্থিব। অতিলৌকিক কোন কণ্ঠস্বর, যা মানুষের কণ্ঠ, কিন্তু ঠিক যেন মানুষের নয়।
এক ধরনের ব্যতিব্যস্ততা নেমে আসতো শহুরে জীবনে। ক্রমশ বাতিগুলো নিভে যাচ্ছে। কোথাও ধীর লয়ে, কোথাও দ্রুত। কোন কোন অঞ্চলে যখন আঁধার নেমে এসেছে, কোন কোন অঞ্চলে তখনো মায়াবী আলো। সেই মায়াবী আলোর রশ্মি অন্ধকার অঞ্চলে এসে আবছায়া অবয়ব তৈরি করছে। সে এক মেলোড্রামাটিক দৃশ্য।
আরও পড়ুন- প্রাণঘাতী ব্লু হোয়েল গেম থেকে সাবধান
মনে পড়ে, ঘড়ির কাঁটা যখন পৌনে এগারোটা ছুঁইছুঁই, তার কিছু আগে মাঝেমধ্যে চলে যেতাম বাস্কেট বল গ্রাউন্ডে। একযোগে বিভিন্ন রুমের বাতি নেভার দৃশ্য দেখার জন্য। ব্রিটিশ নিয়মে চালিত এ আবাসিক অঙ্গনের নিয়ম ছিলো বেশ কড়া। পৌনে এগারোটার মধ্যেই নিভিয়ে ফেলতে হবে সব বাতি। ঘুম না এলেও ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকতে হবে নিঃসঙ্গ শাদা বিছানায়। সারা দিনের ক্লান্তি ঘনিয়ে এলে প্রাত্যহিক জীবনের লেনদেন শেষের চিহ্ন হিসেবে অল্পকিছু পরেই বাঁশি বাজতো। তিন হাউজের দায়িত্বরত তিন ডিউটিক্যাডেট বাঁশি বাজিয়ে জানান দিতো কর্মব্যস্ত একটি দিনের সমাপ্তি। তিনটি আলাদা তরঙ্গে, অল্পবিস্তর সময়ের ব্যবধানে বেজে ওঠা বাঁশির আওয়াজ ভেঙে দিতো কিশোরদের ঘুমপূর্ব খেলাঘর। সে খেলাঘরে থাকতো ক্যারাম বোর্ডে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসমাপ্ত কোন দানের গুটি, টেবিল টেনিসের বল, কমনরুমে হিন্দি চ্যানেলের কোন যৌনাকর্ষক গান কিংবা হলিউডের কোন সিনেমার শেষ দৃশ্য, পরের দিনের প্যারেডের জুতা পলিশ, জুনিয়র রুমে চলতে থাকা কোন খোশ গল্প, বেসিনে শেভের আয়োজনে ব্যতিব্যস্ততা, হাউজ মস্কে চলমান এশার নামাজ, কিংবা হাউজ অফিসের বিবিধ কর্মকাণ্ড। মুহূর্তে প্রিফেক্টদের ভারি ভারি কণ্ঠস্বর থেকে আওয়াজ আসতো, ‘বয়েজ লাইটস অফ। লাইটস অফ বয়েজ’।
বালকেরা বাতি নেভাও। বাতি নেভাও বালকেরা।
যেন বাতি নেভাতে পারলেই বালকদের চোখে ঘুম এসে ভর করবে। ঘুমকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে স্বপ্নকে। ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি এসে ভর করবে কতিপয় বালকের ক্লান্ত চোখে। ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি আসার আগেই এই আদেশ বার্তা মুহূর্তে ছড়িয়ে যেত ৫১ একরে। দেখতাম, বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো বিভিন্ন ডরমেটরিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাতিগুলো একে একে আলো থেকে অবসর নিচ্ছে। একসময় সব বাতি নিভে গেলে অথৈ সমুদ্রের বাতিঘরের মতো হাউজ বিল্ডিংয়ের উপরে জেগে থাকতো আলোয় গর্ভবতী তিনটি মাত্র ইংরেজি ক্যাপিটাল লেটার ‘বিসিসি’। যা ভাঙালে পাওয়া যেত অঙ্গনের পুরো নাম। বাতি নেভানো অন্ধকার রুমগুলোর শাদা বিছানাকে সারাদিনের ক্লান্তি শেষে মনে হতো মেঘের পালঙ্ক। সেই পালঙ্কে শুয়ে শুনতাম শহর থেকে সাত মাইল দূরে পাড়া গায়ের ভেতর গড়ে ওঠা এই অঙ্গনে দূর থেকে ভেসে আসা কোন আহত ঝিঁঝিঁর হারমনিয়াম। সে সুর যেন শতাব্দী প্রাচীন কলের গানের মত মেলাংকোলিক আবহময়।
অধিকাংশ সময়েই ঘুম আসতো না। মনে পড়তো, শৈশবে ঘুম না এলে বালিশের পাশে বসে মা যে ঘুমপাড়ানি মাসিপিসিকে পান খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানাতেন, তাকে বসতে দেওয়ার মতো কোন খাট-পালঙ্ক না থাকার একটা করুণ আর্তি ফুটে উঠতো। মাথার নিচে বিব্রতকর একটি বালিশ চেপে প্রায়ই খোকা ঘুমিয়ে যাওয়া কোন পাড়া জুড়ানো জনপদে খাজনা দিতে না পারা অসহায় এক কৃষক পরিবারের কথা ভাবতাম। মনে হতো, বর্গীর ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত, বুলবুলিতে ধান খেয়ে ফেলা নির্ঘুম এক কৃষক হয়তো জেগে আছেন জীবনের অনিশ্চয়তা নিয়ে। ক্ষুধা পেটে ঘুমিয়ে যাওয়া তার সন্তানের পাশে বসে কৃষকবউ হয়তো তাকে ঘুম পাড়ানোর বৃথা চেষ্টায় কোন এককালে রচনা করেছিলেন এই ঘুমপাড়ানি গান।
মনে পড়ে, কলেজে এগারোটার ঘণ্টা বাজানোর এক অদ্ভুত রেওয়াজ চালু ছিল। প্রতিরাত এগারোটার সময় রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে কোন এক নৈশপ্রহরীর শক্ত হাতে বাজানো এগারোটি ঢং ঢং শব্দ কানে বেজে আসতো। ঘুম না আসা বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে প্রায়ই আঙুলের কড়ে গুনতাম ঘণ্টার সংখ্যা। মাঝেমাঝে মনে হতো, কোন একদিন ভুল করে হয়তো চকিদার বারোটি ঘণ্টা বাজিয়ে ফেলবে। কিন্তু তেমন কখনো হয়নি। শুধু শেষ ঘণ্টা বাজার পর ধাতুর রিনরিন মিহি ধ্বনি হাওয়াই মিঠের মতো মিলিয়ে যেত রাতের বাতাসে। এসব ভাবতে ভাবতেই হয়তো পাথর তলিয়ে যাবার মতো অতল ঘুমে তলিয়ে যেতাম ঘুমের সমুদ্রে।
আরও পড়ুন- পরীক্ষা পাসের মিষ্টি
আর এখন ঘুম না আসা এইসব মেট্রোপলিটন রাতে বসে ভাবি, জীবনের বিবিধ অস্থিরতা নিয়ে বহুরাত নির্ঘুম কাটানো কোন স্বামীকে কি তার স্ত্রী এখন ঘুমপাড়ানি গান শুনিয়ে ঘুম পাড়ায়? কিংবা ইনসমনিয়া আক্রান্ত কোন স্ত্রীকে তার স্বামী কপালে হাত রেখে ঘুম পড়ানোর সংগ্রাম চালায়? না কি ভিন্নমুখী হয়ে অভিন্ন বিছানায় মেসেঞ্জারে দু’জন ঘুম না আসার গল্প শোনায় দূরের দেশের কোন মানুষকে? কেবলই দূরের তারাদের নক্ষত্র মনে হয়। পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলা দু’জন নর-নারী তবুও টেনে নিয়ে যায় যে জীবন, সমাজ তাকে সংসার নাম দেয়। মন খারাপের রাতে কেউ কাউকে চোখের ঘুম হয়ে যাবার অনুরোধের মতো বিষয় থাকে না সেখানে।
ভাবি, যদি একদিন এই অনিয়ন্ত্রিত বিশৃঙ্খল এলোমেলো শহরজুড়ে নেমে আসতো কৈশোরের মতো কোন নিয়ন্ত্রিত রাত। লাল সবুজ হলুদ বাতিগুলো একযোগে নিভে যেত। নিভে যেত শ্রেণি ব্যবধান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শহরের উঁচু-নিচু সব দালানের আলো। সমস্ত শহর ডুবে যেত ছিমছাম অন্ধকারে। আর কোন পাণ্ডুলিপি অসমাপ্ত রয়ে যেত না তবে। বিউগল বেজে যেত অবিরাম, শহরের মানুষ ঘুমিয়ে যেত পরম প্রশান্তির বিছানায়।
থাকতো শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার আমাদের নিজস্ব বনলতা সেন।
এসইউ/জেআইএম