সদিচ্ছা আর শ্রদ্ধাবোধ থাকলে পরিবর্তন হবেই : রুহুল আমিন
রুহুল আমিন বর্তমানে উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে বিভাগীয় কমিশনার অফিস চট্টগ্রামে কর্মরত আছেন। এরআগে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর উদ্যোগে সীতাকুণ্ড ভূমি অফিসের চেহারা আমূল পরিবর্তিত হয়েছে। তিনি প্রথমে পাঁচ দিন, এরপর চব্বিশ ঘণ্টা এবং সর্বশেষ দশ মিনিটে খতিয়ান দিয়ে রেকর্ড গড়েছেন। তার নাম এখন সীতাকুণ্ডের মানুষের মুখে মুখে।
সরকারি অফিসসমূহের বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। সীতাকুণ্ডে থাকাকালীন অফিসের উঠোনে চেয়ার নিয়ে বসে মানুষের মুখোমুখি হতেন। শুনানি আকারে শুনতেন সবার অভাব-অভিযোগ। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত কিংবা সমাধান দিতেন। এভাবেই চলতে থাকতো একেবারে পাঁচটা পর্যন্ত। এরপর নিজের কক্ষে ঢুকে অফিসিয়াল কাজ সারতেন। সেটা অনেক সময় রাত নয়টাতেও গড়াতো।
এসব বিষয় নিয়ে শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি সময় দিয়েছেন জাগো নিউজকে। কথা বলেছেন নিজের কাজকর্ম এবং আগামীর স্বপ্ন নিয়ে। তার সঙ্গে কথা বলেছেন সাংবাদিক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ-
জাগো নিউজ : প্রথমেই নিজের সম্পর্কে পাঠককে কিছু বলুন-
রুহুল আমিন : আমার জন্ম মাদারীপুর জেলায়। এইচএসসি পর্যন্ত শিক্ষা জীবন মাদারীপু্রেই কেটেছে। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে ২০১২ সালের জুনে সরকারি চাকরিতে যোগদান করি। ব্যক্তিগত জীবনে আমি, আমার সহধর্মিণী ফারজানা শারমিন মৌসুমী এবং কন্যা আরিশাকে নিয়েই আমার পরিবার।
> আরও পড়ুন- টার্কি পালনে উদ্যোক্তা মিরাজের সফলতা
জাগো নিউজ : বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কততম ব্যাচ আপনি?
রুহুল আমিন : আমি ৩০তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য।
জাগো নিউজ : আপনার প্রথম কর্মস্থল এবং পদমর্যাদা কী ছিলো?
রুহুল আমিন : প্রথম কর্মস্থল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, চট্টগ্রাম। পদবী ছিল সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
জাগো নিউজ : এ পর্যন্ত কতবার বদলি হয়েছেন বা কয়টি স্টেশনে কাজ করেছেন?
রুহুল আমিন : দুইবার বদলি হয়েছি। তিনটি স্টেশনে কাজ করেছি। প্রথমে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, চট্টগ্রাম এরপরে উপজেলা ভূমি অফিস, সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম। বর্তমানে তৃতীয় স্টেশন হিসেবে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, বিভাগীয় কমিশনার অফিস চট্টগ্রামে কর্মরত।
জাগো নিউজ : আপনি তো সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেখানে আপনাকে কী কী কাজ করতে হতো?
রুহুল আমিন : সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কর্মপরিধি ব্যাপক। তবে মোটাদাগে রেকর্ড হালকরণ (নামজারি), রাজস্ব আদায় (ভূমি উন্নয়ন কর), খাস জমি রক্ষণাবেক্ষণ, সায়রাত মহল ব্যবস্থাপনা, অর্পিত বা পরিত্যক্ত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনাসহ ভূমিসংক্রান্ত সাধারণ মানুষের ছোটখাটো অনেক সমস্যা শুনে আইনি প্রতিকার করাই মূলত দায়িত্ব এবং কর্তব্য ছিলো।
জাগো নিউজ : তখন আপনি মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রবাসীদের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সেবা প্রদান করেছেন- সে সম্পর্কে কিছু বলুন-
রুহুল আমিন : মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁদের জন্যই আজ আমি বাংলাদেশি বলে পরিচয় দিতে পারছি। তাঁদের কারণেই আমি আজ বিসিএস অফিসার। তারা যুদ্ধ না করলে আজ এই চেয়ারে হয়তো পাকিস্তানি কেউ থাকতো। অন্যদিকে প্রবাসীরা তাদের রক্ত পানি করে এদেশে রেমিটেন্স পাঠায়। তারা যখন দেশে আসেন; তাদের সময় খুব হিসেব করা। প্রতিটি দিন তাদের আপনজনদের সাথে কাটানোর জন্য। সেই হিসেব করা সময় যদি ভূমি অফিসে আসা-যাওয়া করে ব্যয় হয়, তাহলে সেটা অনেক বড় অবিচার হবে। এই তাড়না থেকেই এই ডেস্ক চালু করা হয়।
> আরও পড়ুন- বাংলাদেশের সেরা ৫ বিজ্ঞানী
জাগো নিউজ : আপনি সীতাকুণ্ড ভূমি অফিসে ‘ই-নামজারী’ সেবা চালু করেছিলেন। এতে গ্রাহকরা কেমন সেবা পাবেন?
রুহুল আমিন : ই-নামজারী আসলে এখন শুরুর দিকে। এটা চালু হলে মধ্যস্বত্ত্বভোগী দালালের সংখ্যা কমবে। মানুষ নিজের গ্রামে বসেই ইউনিয়ন পরিষদ ডিজিটাল সেন্টার- এমনকি নিজের মোবাইলেও আবেদন করতে পারবে। এতে ভূমি অফিসে আসা-যাওয়া কমে যাবে অবৈধ লেনদেন কমে আসবে।
জাগো নিউজ : আপনার মাধ্যমে ২৪ বছর পর খতিয়ান পাওয়ার ঘটনা আমরা শুনেছি- কাজটি কিভাবে সম্ভব হয়েছে?
রুহুল আমিন : ২৪ বছর আগের অনেকগুলো খতিয়ান আমি ডেলিভারি দিয়েছি। এই কাজটির জন্য আমাকে ২ মাস পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমার অফিসের যত পুরনো নথি আছে, সবগুলোর তালিকা তৈরি করে তা বাঁধাই করেছি। স্বাধীনের পর থেকে যত নথি পেয়েছি, সব তালিকা করে সিরিয়ালি সাজিয়ে রেখেছি। ভূমি অফিসের অনেক সমস্যার একটা হল ‘নথি পাওয়া যায় না, পরে আসেন’। এখন যেহেতু তালিকার কপি আছে, তাই মুহূর্তেই বলা যাবে, ‘আপনার নথি আছে, খতিয়ান নিয়ে যেতে পারবেন’।
জাগো নিউজ : ‘ভূমি সেবায় আশার আলো দেখাচ্ছেন এসিল্যান্ড রুহুল আমিন’- কথাটা শোনা যেত মানুষের মুখে মুখে। এতে আপনার অনুভূতি কী?
রুহুল আমিন : আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে আমি চেষ্টা করেছি। এই চেষ্টার স্বীকৃতি পেয়ে দিন শেষে ভালো লাগে এই ভেবে যে, জনগণের টাকায় বেতন নিয়ে আমি ভুলে যাইনি; আমি তাদের সেবক।
জাগো নিউজ : আপনি নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করেছেন- কেন করেছেন?
রুহুল আমিন : ভূমি অফিসের কাজের পরিধি অনেক। সারাদিন মানুষের ছোট-বড় নানা সমস্যা শুনে নোট নিতে হয়েছে। কর্মঘণ্টা শেষ হলেও সারাদিন অফিসে আসা মানুষের কাজগুলো তৈরি করতে হয়েছে। ৯টা-৫টা অফিসের মধ্যে এটা সম্ভব নয়। তাই শুক্র-শনির পাশাপাশি রাত ২-৩টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়েছে।
জাগো নিউজ : সীতাকুণ্ড ভূমি অফিসকে বদলে দেওয়ার গল্পটি শুনতে চাই-
রুহুল আমিন : আমি চট্টগ্রামে অনেক দিন ধরে কাজ করছি। অনেক ভূমি অফিসে নিজে গিয়েছি, কাজেই গিয়েছি, নিজ জেলায়ও গিয়েছি, অনেক জেলায় নিজে ফোনে বন্ধু-বান্ধবের জন্য সেবা চেয়েছি। প্র্যাকটিকাল অভিজ্ঞতা আছে আমার ভূমি অফিসে। অর্থাৎ আমার নিজেরই কষ্ট আছে। তখন থেকেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ভূমি অফিসে যোগদান করলে প্রতিটি মানুষের কষ্ট আমি কিছুটা হলেও বুঝবো। তাই যোগদানের পর থেকেই সেবা নিতে আসা প্রতিটি মানুষের জায়গায় আমি নিজেকে চিন্তা করেছি। অর্থাৎ সেবাপ্রার্থী ভূমির মালিকদের সমস্যাগুলোকে নিজের সমস্যা হিসেবে নিয়েছি। গল্পের শুরু এভাবেই...
> আরও পড়ুন- সালাম সালাম হাজার সালাম
জাগো নিউজ : যারা আপনার মতো হতে চান, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
রুহুল আমিন : একটাই পরামর্শ- সরকারি অফিসে সেবা নিতে আসা মানুষগুলোকে তাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে এবং সেবাগ্রহীতার জায়গায় নিজেকে চিন্তা করতে হবে অর্থাৎ ওই জায়গায় আমি হলে কী চাইতাম?
জাগো নিউজ : দেশ ও দেশের মানুষ নিয়ে আপনার আর কী কী স্বপ্ন রয়েছে?
রুহুল আমিন : দেশের মানুষ সব সরকারি দফতরে গিয়ে তার পাওনাটুকু বুঝে পাক। সেবাপ্রার্থী দেশের জনগণ যেন ভাবতে শুরু করে- সবচেয়ে দ্রুত এবং ভালো সেবা এখন সরকারি দফতরেই পাওয়া যায়।
জাগো নিউজ : সফলতা বলতে আপনি কী বোঝেন?
রুহুল আমিন : সরকারি দফতরের একজন কর্মকর্তা হিসেবে আমার কাছে সফলতার একটাই সংজ্ঞা- ‘আমার কাছে সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষ যখন আনন্দের হাসি দিয়ে বলেন, ‘স্যার আমার পাওনা আমি ঠিকমতো পেয়েছি, কোন সমস্যাই হয়নি, আপনাকে ধন্যবাদ’। এই কথাগুলোই আমার সফলতা।
এসইউ/পিআর