পাঙ্গাসের আচার রফতানি করা সম্ভব : ড. সালাম
বর্তমানে দেশে বছরে প্রায় আড়াই থেকে তিন লক্ষ মেট্রিক টন থাই পাঙ্গাস উৎপাদন হয়। বৃহত্তর উৎপাদন ও কম দামের পরও অতিরিক্ত চর্বি, আঁশটে গন্ধ আর কালচে বর্ণের কারণে দেশে জনপ্রিয়তা হারানোর পাশাপাশি বিদেশ যাত্রায় সুবিধা করে উঠতে পারেনি পাঙ্গাস মাছ। ফলে পাঙ্গাস খামারিরা হতাশ হয়ে পড়ছেন।
পাঙ্গাসের জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনতে বিকল্প ব্যবহার সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একোয়াকালচার বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুস সালাম তৈরি করেছেন পাঙ্গাসের হরেক রকম আচার।
জাগো নিউজের পক্ষ থেকে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিলো পাঙ্গাসের আচার তৈরি সম্পর্কে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের বাকৃবি প্রতিনিধি মো. শাহীন সরদার।
জাগো নিউজ : কিভাবে আচার তৈরির ধারণা এলো?
অধ্যাপক ড. সালাম : আবহমান কাল থেকে এই উপমহাদেশের তথা বাংলাদেশের মানুষ বিভিন্ন ধরনের ফলের আচার তৈরি করে আসছে। তবে আমাদের দেশে মাছের আচারের প্রচলন তেমন একটা নেই বললেই চলে। ২০০৯ সালে ময়মনসিংহের পাঙ্গাস চাষিরা যখন মাছের দাম না পেয়ে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন; তখন আমি চাষিদের রক্ষার জন্য কিছু একটা করার চিন্তা করতে থাকি। এমন একসময় আমার গবেষণার পুকুরে প্রচুর ছোট ছোট বেলে মাছ পাই। এত ছোট মাছ দিয়ে কী করা যায় ভেবে পাচ্ছিলাম না। পরীক্ষামূলকভাবে ওই ছোট বেলে মাছ দিয়ে আচার জাতীয় কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত নেই।
জাগো নিউজ : পারিবারিক সহযোগিতা কেমন ছিল?
অধ্যাপক ড. সালাম : প্রথমে স্ত্রী ও দুই মেয়ে এই কাজকে পাগলামি বলে ভর্ৎসনা করে। তারপরও তারা খুব আগ্রহ সহকারে আমাকে সাহায্য করতে থাকে। বিশেষ করে ছোট মেয়ে চয়নিকা সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ও কৌতুকচ্ছলে সাহায্য করে। আচার তৈরিতে আমি ইংল্যান্ডের অভিজ্ঞতা এবং ইন্টারনেটের সাহায্য নেই। সত্যি সত্যি আচারটা যখন তৈরি হলো তখন পরিবারের সবাই তা খুব পছন্দ করলো। তবে তাদের কথা হলো- এই আচার যদি পাঙ্গাস, বোয়াল, বাইম বা শোল-গজার মাছ দিয়ে করা হতো তবে খুব মজা হতো। তাদের কথামতো এক শুক্রবারে ৫ কেজি পাঙ্গাস মাছ কিনে এনে শুরু করলাম পাঙ্গাস মাছের আচার তৈরির কাজ। এবার পরিবারের কেউ আমার এই আচার তৈরিকে পাগলামি বলেনি বরং সবাই সহযোগিতা করেছে। মাছ কাটাকাটি থেকে শুরু করে মসলা মাখিয়ে রাখা এবং আচার তৈরি হতে প্রায় সারা দিন লেগে যায়। সবার অনেক পরিশ্রম হলেও আচারের মজা পেয়ে সব কষ্টই সবাই ভুলে যায়। পরিবারের সবাই একবাক্যে পাঙ্গাস মাছের আচারকে মজাদার ও অতুলনীয় বলে অভিহিত করে।
জাগো নিউজ : আচারের সাথে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা যদি শেয়ার করতেন-
অধ্যাপক ড. সালাম : আচার তৈরিতে অন্য মানুষের মতামত নেওয়ার জন্য প্যানেল টেস্টের চিন্তা করলাম। এমন সময় ঢাকা থেকে কিছুসংখ্যক মেহমান বাসায় এলে তাদের খেতে দিয়ে মতামত জানতে চাইলাম। তারা আচার খেয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। এরপর আমি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম এ সাত্তার মণ্ডল মহোদয়কে আচারটা পরীক্ষা করে দেখার জন্য বলি। উপাচার্য মহোদয় এবং তার পরিবার এক শুক্রবারে খাওয়ার টেবিল থেকেই ফোন করে আচারের খুব প্রশংসা করেন। পরবর্তীতে অধ্যাপক মণ্ডল নবম সংসদে কৃষির উপর আলোচনা করতে গিয়ে পাঙ্গাস মাছের আচারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নব উদ্ভাবন বলে অভিহিত করেন। এরপর তিনি তার কিছু সহকর্মীকে আচারটা টেস্টের জন্য দেন। তারা সবাই এটাকে একবাক্যে খুবই উপাদেয় বলেন। একসময় ময়মনসিংহের স্বর্ণলতা মৎস্য খামারের সাহায্যে আচারটিকে শহরের এক মেলায় প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করি এবং সেখান থেকেও উৎসাহব্যাঞ্জক ফলাফল পাই। পরবর্তীতে একোয়াকালচার বিভাগ আয়োজিত মৎস্যচাষীদের সমাবেশ শেষে দুপুরের খাবারের সাথে পাঙ্গাস মাছের আচার পরিবেশন করলে ভালো, মজাদার ও সুস্বাদু বিশেষণে বিশেষায়িত হয়।
জাগো নিউজ : পাঙ্গাস মাছের আচার ছাড়াও অন্য কোন আচারের রেসিপি তৈরির চেষ্টা করেছেন কি?
অধ্যাপক ড. সালাম : হাওরের বোয়াল ও গুচি বাইম মাছ দিয়েও আচার তৈরি করে ভালো ফল পাই। কাঁটাযুক্ত ছোট মাছের আচার কিছুদিন ফ্রিজে রেখে দিলে ভিনেগারের কারণে কাটাগুলো নরম হয়, ফলে কাটাসহ আচার খাওয়া যায়। ২০১২ সালের আগস্ট মাসে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সফরে এলে তাকেও দুপুরের খাবারের সাথে পাঙ্গাস মাছের আচার পরিবেশন করা হয়। যদিও তার সঙ্গীরা তাকে ঝাল ও কাঁটাযুক্ত খাবার পরিবেশন করতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি পাঙ্গাস মাছের আচার খেয়ে এতোই মজা পান যে, পর পর তিনবার এই আচার নেন। শেষে নিজেই আচারের কৌটা থেকে ঢেলে আচার খান এবং বলেন, ‘তুমি এই আচার তৈরি করে আমেরিকায় রফতানি কর না কেন?’ এরপর আমি পাঙ্গাসের চাটনিও তৈরি করি এবং প্যানেল টেস্টে সেটাও ভালো এবং সুস্বাদু হিসেবে বিবেচিত হয়। মাছের আচার ও চাটনি তৈরির পর আমি ফুলকপি ও করল্লার আচারও তৈরি করি; যা খুবই মজাদার ও সুস্বাদু ছিল।
জাগো নিউজ : পাঙ্গাস মাছের আচার তৈরির উপকরণ সম্পর্কে যদি বলতেন-
অধ্যাপক ড. সালাম : পাঙ্গাস মাছের আচার তৈরিতে প্রয়োজনীয় উপকরণ হলো-
১. কাঁটা ছাড়া পাঙ্গাস মাছের ছোট ছোট টুকরা- এক কেজি
২. শুকনা মরিচের গুড়ো- ৫-৬ চা চামচ
৩. হলুদ গুড়া- ২ চা চামচ
৪. সরিষার তেল- ৪০০ মিলিলিটার
৫. সরিষা- ২ চা চামচ
৬. মেথি- ২ চা চামচ
৭. পিঁয়াজ কুচি- ২-২.৫ কাপ
৮. আদা বাটা- ৪ চা চামচ
৯. আদা কুচি- ১/২ কাপ
১০. রসুন বাটা- ৪ চা চামচ
১১. রসুন কুচি- ১/২ কাপ
১২. কাচা মরিচ ফালি- ৪-৫টা
১৩. ভিনেগার- ১ থেকে দেড় কাপ
১৪. লবণ- পরিমাণমতো
আরও পড়ুন- নীলার স্বপ্ন ছোঁয়ার চেষ্টা
জাগো নিউজ : আচার তৈরির পদ্ধতিটা যদি জানাতেন-
অধ্যাপক ড. সালাম : প্রথমেই আচার তৈরির জন্য তাজা পাঙ্গাস মাছ নিয়ে কাঁটা ফেলে এক সেন্টিমিটার আকারের ছোট ছোট টুকরা করে মাছ কাটতে হবে। মাছ কাটা হলে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে ১ কেজি মাছের মধ্যে ১ চামচ হলুদ গুড়ো, ২ চামচ মরিচ গুড়ো, পরিমাণমতো লবণ মিশিয়ে দেড় থেকে ২ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। এরপর মাছগুলোকে সসপেন বা কড়াইতে অল্প সরিষার তেলে ভাজতে হবে। খুব কড়া করে ভাজার প্রয়োজন নেই। এবার কড়াইতে ২ কাপ পরিমাণ সরিষার তেল নিয়ে গরম করে তাতে ২ চা চামচ সরিষা দিয়ে না ফোটা পর্যন্ত নাড়তে হবে। পরবর্তীতে ২ চা চামচ মেথি দিয়ে অল্প সময় নাড়ার পর পিঁয়াজ কুচি ভেজে লাল করতে হবে। এবার ৪-৫ চা চামচ করে আদা বাটা, রসুন বাটা ও ৪ চা চামচ শুকনো মরিচ বাটা এবং ৪-৫টা কাচা মরিচ ফালি দিয়ে কড়া করে ভাজতে হবে। মসলা ভাজার শেষ পর্যায়ে আধা কাপ করে আদা ও রসুন কুচি দিয়ে আরও কিছুক্ষণ ভাজতে হবে। মসলাগুলো কড়া ভাজা হলে ভাজা মাছগুলো তাতে ঢেলে দিয়ে ১৫-২০ মিনিট অল্প আচে নাড়তে হবে। প্রয়োজন হলে আরও তেল দিতে হবে, যাতে মাছের টুকরাগুলো তেলের নিচে ডুবে থাকে। এবার চুলা বন্ধ করে লবণ চেখে নামাতে হবে। এরপর এক থেকে দেড় কাপ ভিনেগার দিয়ে নেড়ে চেড়ে রেখে দিতে হবে। ঠান্ডা হলে কাচের বয়ামে ভরে রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন কৌটার ভেতর মাছ ভরার পর মাছের উপর তেল ভাসে।
জাগো নিউজ : কতদিন সংরক্ষণ করা যাবে?
অধ্যাপক ড. সালাম : এটাকে ফ্রিজে রেখে ৬ মাস পর্যন্ত খাওয়া যায়।
জাগো নিউজ : এই আচার কোন কোন খাবারের সঙ্গে খাওয়া যায়?
অধ্যাপক ড. সালাম : পাঙ্গাস মাছের আচার পোলাও, খিচুড়িসহ আলুভর্তা, ডাল ও ভাতের সাথে খাওয়া যায়। সকালে পরাটা দিয়ে এই আচার খাওয়া যায়। তাছাড়া বিকেলের নাস্তায় মুড়ির সাথে মাখিয়েও খাওয়া যায়।
জাগো নিউজ : পাঙ্গাস মাছের আচারের ভবিষ্যৎ কেমন হবে বলে মনে করেন?
অধ্যাপক ড. সালাম : বাণিজ্যিকভিত্তিতে পাঙ্গাসের আচার উৎপাদন করা হলে ময়মনসিংহ অঞ্চলের পাঙ্গাসচাষীরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে। যারা পাঙ্গাস খেতে পছন্দ করেন না; তারাও আচার খেতে পারবেন। তবে সমুদ্র উপকূলে বা হাওর-বাওরে যখন বেশি বেশি মাছ পাওয়া যায়, সেসব অঞ্চলে মাছের আচার তৈরির কুটির শিল্প হতে পারে। যা দেশে শুধু নতুন কর্মসংস্থানই করবে না, উৎপাদিত আচার দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করা সম্ভব।
এসইউ/আইআই