বিলে বিলে শাপলার উৎসব
ভোরের আলো দেখা যায়নি। চারদিক অন্ধকার। ঠিক তখনি মাদারীপুরের বাঘিয়ার বিল ও গোপালগঞ্জের চান্দার বিল অঞ্চলের সহস্রাধিক মানুষ জীবিকা নির্বাহের জন্য ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে নেমে পড়ে বিলের পানিতে। শুরু হয় বর্ষা মৌসুমে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া শাপলা তোলার প্রতিযোগিতা। কে কত বেশি শাপলা তুলবে, কার ডিঙ্গি নৌকা কত তাড়াতাড়ি ভরে যাবে, চলে এমন প্রতিযোগিতা। শুধু বড়রা নয় শিশুরাও পরিবারের সদস্যদের সাথে এসে শাপলা তোলার কাজে নেমে যায়।
ভোরের আলো চোখ মেলার কিছুক্ষণের মধ্যে পাইকারি ব্যবসায়িরা নছিমন, ভ্যানগাড়ি নিয়ে শাপলা কিনতে চলে আসে। তারা নৌকা থেকে শাপলা তুলে নির্দিষ্ট পরিবহনে ছুটে চলে শহরের বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে।
জানা যায়, মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলা ও গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার অংশ নিয়ে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর আয়তনের বাঘিয়ার বিলজুড়ে বিশাল শাপলার বিল রয়েছে।
এছাড়াও গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর, কাশিয়ানী, সদর উপজেলায় প্রায় ১১ হাজার হেক্টর আয়তনের জলাভূমি চান্দা বিল রয়েছে। যা দক্ষিণ অঞ্চলসহ দেশের অন্যতম বৃহত্তম বিল হিসেবে পরিচিত।
কয়েকশ’ বছরের পুরনো বাঘিয়ার বিল ও চান্দার বিল প্রায় ৯ মাসই থাকে জলাবদ্ধ। ফলে এই বিলে শাপলার পাশাপাশি শামুক ও নানাজাতের দেশীয় মাছ বিক্রি করেও অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। তবে জ্যৈষ্ঠ থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত প্রাকৃতিকভাবেই প্রচুর পরিমাণে শাপলা জন্মায়। ওই শাপলা বিল থেকে তুলে জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রায় অর্ধশত গ্রামের সহস্রাধিক মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে।
সেখানকার মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, ওই অঞ্চলের হতদরিদ্র পরিবারের সদস্যরা বিল থেকে শাপলা তুলে আনে। তাদের কাছ থেকে পাইকাররা কম দামে শাপলা কিনে নেয়। এরপর পাইকাররা নছিমন বা ভ্যানগাড়িতে করে মাদারীপুরের রাজৈর, টেকেরহাট বন্দর এবং গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরসহ পার্শ্ববর্তী জেলা শহরের পাইকারদের কাছে বিক্রি করে দেয়। সেখান থেকে খুচরা কাঁচামাল ব্যবসায়িরা শহরসহ আশেপাশের বাজারগুলোতে বিক্রি করে।
তবে অনেক পরিবার আছে, তারা বিল থেকে শাপলা তুলে বেশি লাভের আশায় নিজেরাই স্থানীয় বাজারগুলোতে বিক্রি করে। ১০-১৫টা শাপলা একসঙ্গে বেঁধে ৫ টাকা আর শহরগুলোতে ১০ টাকা করে বিক্রি করতে দেখা যায়।
রাজৈরের টেকেরহাট বন্দরে শাপলা বিক্রি করতে আসা সুমন ঘরামী, কার্তিক চন্দ্রধরসহ একাধিক ব্যবসায়ী জানান, বর্ষা মৌসুমে প্রতিদিন খুব ভোরে, অনেকে ভোররাতেও বিল থেকে শাপলা তুলতে আসে। আমাদের মতো কয়েকশ’ মানুষ বাঘিয়ার বিল, চান্দার বিলসহ পার্শ্ববর্তী ছোট ছোট বিল থেকে শাপলা তুলে এনে হাট-বাজারে অথবা পাইকারদের কাছে বিক্রি করে।
স্থানীয়রা জানান, বাঘিয়ার বিল, চান্দার বিল ছাড়াও পার্শ্ববর্তী অনেক ছোট ছোট বিল আছে। গোপালগঞ্জের বড়বিল, মোল্লার বিল, সিঙ্গার বিল এবং মাদারীপুরের রাজৈরের মহিষমারীর বিল, কদমবাড়ির বিল, লখণ্ডার বিল থেকেও প্রতিদিন লোকজন প্রচুর শাপলা তুলে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। এখানকার শাপলা মাদারীপুর, ফরিদপুর, বাগেরহাট, নড়াইল, খুলনা, বরিশাল এমনকি ঢাকার বিভিন্ন হাট-বাজারেও পাইকাররা বিক্রির জন্য নিয়ে যায়।
রাজৈরের সিমা বেগম, মাদারীপুর শহরের ইসরাত জাহান, মুকসুদপুরের শিউলী বেগমসহ একাধিক গৃহবধূ জানান, বর্ষা মৌসুমে শাপলা সহজেই পাওয়া যায়। দামেও কম। তাই সবজি হিসেবে খাদ্যতালিকায় এ এলাকার মানুষ রান্না করে খায়। সরিষা বাটা দিয়ে শাপলা ভাজি, ডাল ও মাছের সাথেও খাওয়া যায়। তবে বেলে মাছ, ইলিশ মাছ ও চিংড়ি মাছের সাথে শাপলা তরকারি রান্না করলে খুবই সুস্বাদু হয়।
মাদারীপুরের পরিবেশবাদী সংগঠন ফ্রেন্ডস অব নেচারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক রাজন মাহমুদ বলেন, ‘বর্তমানে কৃষকরা অত্যাধিক রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করায় জলাভূমির জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে অন্য উদ্ভিদের মতো জলজ উদ্ভিদ শাপলার উৎপাদনও দিন দিন কমে যাচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে সরকারিভাবে ও পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলো যদি এগিয়ে আসে, তাহলে আর্থিক উন্নয়নের জন্য এই বিল দুটো দেশের মধ্যে উদাহরণ হতে পারে।’
জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির (দুপ্রক) সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান খান বলেন, ‘শুধু শাপলা নয়, এই বিলে একসময় প্রচুর মাছ ও শামুক পাওয়া যেতো। যা বেচে ওই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করতো। জলজ প্রাণিবৈচিত্র্যে ভরা ছিলো বাঘিয়ার বিল। পরিবেশ ও প্রকৃতির পরিবর্তনের কারণে এখন তা বিলুপ্তির পথে।’
মাদারীপুর উন্নয়ন সংস্থা দেশগ্রামের নির্বাহী পরিচালক এবিএম বজলুর রহমান মন্টু খান বলেন, ‘একসময় দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় নৌকা বাইচ হতো বাঘিয়ার বিল ও চান্দার বিলে। এখন আর সেই নৌকাবাইচ চোখে পড়ে না। তবে বর্ষা মৌসুমে প্রচুর শাপলা জন্মানোর জন্য আজও এই বিল তার নিজস্ব ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।’
লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী সুবল বিশ্বাস বলেন, ‘মাত্র কয়েক বছর আগেও জীববৈচিত্র্যে ভরা ছিলো এই বাঘিয়ার বিল। শাপলা, শালুক, শোলা, ধইঞ্চা, কলমি, কচুরিপানা, মালঞ্চ, হেলেঞ্চা, বিভিন্ন ধরনের কচুসহ নানা জলজ উদ্ভিদ ও কৈ, শিং, মাগুর, চিতল, শোল, গজার, খইলসা, পুঁটিসহ নানা জাতের মাছে ভরা ছিলো এই বিল। যা বিক্রি করে ওই এলাকার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করতো।’
তিনি আরো বলেন, ‘এছাড়াও চিল, শালিক, বাবুই, টুনটুনি, বক, মাছরাঙা, বুনোহাঁস, পানকৌড়ি, ডাহুকসহ নানা জাতের পাখির আনাগোনায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর থাকতো এই বিল অঞ্চল। এখন আর সেই দৃশ্য চোখে পড়ে না। তবে এখনও বর্ষা মৌসুমে বিলজুড়ে প্রচুর শাপলা দেখা যায়। যা বিক্রি করে এই অঞ্চলের বহু পরিবার জীবিকা নির্বাহ করে।’
এসইউ/পিআর