হা-ডু-ডু কি বিলুপ্ত হয়ে যাবে
খেলাধুলা মানুষের শারীরিক সুস্থতা ও মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গ্রামবাংলার প্রাচীন খেলা হা-ডু-ডু একটি নির্মল আনন্দদায়ক খেলা। হা-ডু-ডু বা কাবাডি গ্রামবাংলার অন্যতম জনপ্রিয় খেলা। বর্তমানে এ খেলা আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত হয়। তবে ঐতিহ্যবাহী এ খেলাটি এখন গ্রামবাংলা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। রূপ নিয়েছে কেবল আনুষ্ঠানিকতায়।
হা-ডু-ডু খেলাটি সাধারণত কিশোর থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেরা খেলে থাকে। সাধারণত বিশেষ উৎসব বা পালা-পার্বণে বেশ আড়ম্বরপূর্ণভাবে আয়োজন করা হয়। বর্ষা মৌসুমে স্কুলমাঠ, হাট-বাজার বা উন্মুক্ত স্থানে প্রতিদিন বিকেলে অনুষ্ঠিত হয়। এক গ্রামের সাথে অন্য গ্রামের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। বিজয়ীদের পুরস্কার দেওয়া হয়। মাঝে মাঝে খেলা নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে মারামারির ঘটনাও ঘটে।
হা-ডু-ডু বা কাবাডির উৎপত্তি ভারতে বলে ধারণা করা হয়। কেননা ১৯৫০ সালে ভারতীয় জাতীয় কাবাডি ফেডারেশন গঠিত হয়। ১৯৫৩ সালে কাবাডি খেলার আইন-কানুন প্রণীত হয়। ১৯৬০ এবং ১৯৬৬ সালে কাবাডি খেলার আইন সংশোধন করা হয়।
তবে হা-ডু-ডু বা কাবাডি বাংলাদেশের জাতীয় খেলা। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের দু’জন কর্মকর্তা পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে ভারতীয় জাতীয় কাবাডি প্রতিযোগিতা দেখতে যান। দেশে ফিরে তারা ‘কাবাডি ফেডারেশন’ গঠন করেন। ১৯৭৪ সালে ‘এশিয়ান অ্যামেচার কাবাডি ফেডারেশন’ গঠিত হয়। ১৯৭৮ সালে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও বার্মার প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ‘এশিয়ান কাবাডি ফেডারেশন’ গঠিত হয়।
১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতায় প্রথম এশিয়ান কাবাডি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এভাবে আস্তে আস্তে হা-ডু-ডু বা কাবাডি খেলা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বর্তমানে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, মরিশাস, মায়ানমার, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও শ্রীলংকায় হা-ডু-ডু খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া জাপান, নেপাল, মালদ্বীপ ও ভুটানে এই খেলা শেখার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কাবাডি টেস্ট অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে বেইজিংয়ে সিলভার, ১৯৯৪ সালে হিরোশিমা গেমসে সিলভার ও ১৯৯৮ সালে ব্যাংককে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করে। দক্ষিণ এশীয় গেমসে ১৯৮৫ সালে ২য় স্থান, ১৯৯৩ সালে ৩য় স্থান এবং ২০১০ সালে ৩য় স্থান অধিকার করে। এশিয়ান গেমসে মেয়েদের কাবাডি অন্তর্ভুক্ত হয় ২০১০ সালে। এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের ছেলেদের অর্জন ৩টি রুপা ও ৩টি ব্রোঞ্জ। ২০১০ সালে ‘সাফ’ কাবাডিতে বাংলাদেশ ছেলে এবং মেয়ে দুই বিভাগেই সোনা জেতে।
হা-ডু-ডু বা কাবাডি খেলায় বালকদের মাঠ লম্বায় ১২.৫০ মিটার, চওড়ায় ১০ মিটার হয়। বালিকাদের কাবাডি খেলার মাঠ লম্বায় ১১ মিটার, চওড়ায় ৮ মিটার হয়। খেলার মাঠের ঠিক মাঝখানে একটি লাইন টানা থাকে; যাকে মধ্যরেখা বা চড়াই লাইন বলে। এই মধ্যরেখার দু’দিকে দু’অর্ধে দু’টি লাইন টানা হয়, যাকে কোল লাইন বলে। মৃত বা আউট খেলোয়াড়দের জন্য মাঠের দুই পাশে ১ মিটার দূরে দুটি লাইন থাকে যাকে লবি বলা হয়।
প্রতি দলে ১২ জন খেলোয়াড় অংশ নেয়। কিন্তু প্রতি দলের ৭ জন খেলোয়াড় একসাথে মাঠে নামে। বাকি ৫ জন অতিরিক্ত খেলোয়াড় হিসেবে থাকে। খেলা চলাকালীন সর্বাধিক তিনজন খেলোয়াড় পরিবর্তন করা যায়। হা-ডু-ডু খেলা ৫ মিনিট বিরতিসহ দু’অর্ধে পুরুষদের ২৫ মিনিট করে এবং মেয়েদের ২০ মিনিট করে অনুষ্ঠিত হয়। খেলা শেষে যে দল বেশি পয়েন্ট পাবে সে দলই জয়ী হবে। দু’দলের পয়েন্ট সমান হলে দু’অর্ধে আরও ৫ মিনিট করে খেলা হবে। এরপরেও যদি পয়েন্ট সমান থাকে তবে যে দল প্রথম পয়েন্ট অর্জন করেছিল সে দলই জয়ী হবে।
যদি কোনো খেলোয়াড় মাঠের বাইরে চলে যায়, তাহলে সে আউট হয়। এভাবে একটি দলের সবাই আউট হলে বিপক্ষ দল একটি লোনা (অতিরিক্ত ২ পয়েন্ট) পায়। মধ্যরেখা থেকে দম নিয়ে বিপক্ষ দলের কোনো খেলোয়াড়কে (একাধিক হতে পারে) স্পর্শ করে এক নিশ্বাসে নিরাপদে নিজেদের কোটে ফিরে আসতে পারলে, যাদেরকে স্পর্শ করবে সে বা তারা আউট হয়। এভাবে যতজন আউট হবে তাদের প্রত্যেকের জন্য এক পয়েন্ট পাওয়া যায়।
এক নিশ্বাসে স্পষ্টভাবে বারবার হা-ডু-ডু বা কাবাডি বলে ডাক দেওয়াকে ‘দম’ বলে। এই দম মধ্যরেখা থেকে শুরু করতে হয়। বিপক্ষ কোটে একসাথে একাধিক আক্রমণকারী যেতে পারবে না। কোনো আক্রমণকারী বিপক্ষ দলের কোটে দম হারালে এবং বিপক্ষ দলের খেলোয়াড় তাকে স্পর্শ করতে পারলে সে আক্রমণকারী আউট বলে গণ্য হয়।
সর্বত্র একই নিয়ম প্রযোজ্য না হলেও খেলা অনুষ্ঠিত হতো। স্থানীয়ভাবেও তৈরি হতো কিছু নিয়ম। তবুও এক সময় গ্রামাঞ্চলে হা-ডু-ডু খেলার খুব বেশি প্রচলন ছিলো। সময়ের আবর্তনে মানুষের ব্যস্ততা, আধুনিকায়নের ফলে খেলাটি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় কষ্টসাধ্য শারীরিক এ খেলাটি যুবসম্প্রদায়কে আর টানে না। ফলে জনমনে প্রশ্ন উঠতেই পারে- হা-ডু-ডু খেলাটি কি বিলুপ্ত হয়ে যাবে?
এসইউ/আরআইপি