ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

ঈদের নতুন জামা

সাদাত হোসাইন | প্রকাশিত: ০২:২০ এএম, ২৭ জুন ২০১৭

সবুজের লুঙ্গীর কোচড়ে ভাঁজ করা ২ টাকা, ৫ টাকার নোট। আমি তৃষ্ণার্ত চোখে তাকাই। সবুজ আমার চোখের ভাষা বোঝে। আমার টাকা নেই, ওর আছে। এই সুযোগ আর না-ও আসতে পারে। সুযোগমত দুর্বলতা বুঝে আঘাত করার এই তো সুযোগ! সবুজ আমার চোখের সামনে ভাঁজ করা টাকাগুলো তৃতীয় বারের মত গুণতে গুণতে বলে, ‘কি রে! ঈদের তো আর বেশি বাকি নাই। কয় টেকা খরচ করবি?’

- কিয়ের টেকা? আমি না বোঝার ভান করি।
- আরে ব্যাডা, ঈদের দিনে কি কি কিনবি? কি কি খাবি হেইডা।
- তুই কি কি কিনবি? আমি সবুজের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করি।
- পিস্তল কিনুম, ৩ টেকার বারুদ কিনুম, লাল চশমা কিনুম, একখান ঘড়ি কিনুম আর লগে একখান বাঁশি। হেরপর চোর-পুলিশ খেলুম। আমি হইলাম পুলিশ আর তুই হইবি চোর।
- ক্যান? আমি চোর ক্যান?
- আরে ব্যাডা, তুই ভাবছোস আমি জানি না? আমি জানি, তোর মায়ে তোরে টেকা দিতে পারবো না। তুই তো ঈদের মেলায় কিছু কিনতেও পারবি না। এইজন্য চোর-পুলিশ খেলায় আমি পুলিশ, তুই চোর। চশমা চোখে দিয়া, ঘড়ি হাতে দিয়া, আমি পিস্তল হাতে লইয়া তোরে ধাওয়ামু, তুই পলাবি। আর আমি মাঝেমইধ্যে বাঁশিতে পুলিশের মতন হুইস্যাল দিমু, পুউউউপ... পুউউউপ... তুই দৌড়াবি। অনেক মজা হইব এই খেলাতে।

খেলাতে যতই মজা হোক, কে চোর হতে চায়? আমিও চোর হতে চাই না। বরং রঙিন চশমা পরে, ঘড়ি পরে, বাঁশিতে হুইসেল দিয়ে, পিস্তল হাতে পুলিশ হতে চাই। ব্যাপারটার মধ্যে একটা ভাব আছে। ভাবতেই গলার রগ খানিকটা ফুলে ওঠে। আহা!

সমস্যা হচ্ছে, ওই রঙিন চশমা, ঘড়ি, পিস্তল, বাঁশি কতটুকু আমার কেনা হবে এই বিষয়ে আমি সন্দিহান। আব্বা ঢাকা থেকে আসেন ঈদের আগের দিন রাতে, কিংবা ঈদের দিন ভোরে। এসেই আমাদের দুই ভাইকে কোলে বসিয়ে নিয়ে এই কথা সেই কথার পর যা বলেন, তা হল- ‘শোন আব্বারা, এইবারের ঈদ আমাদের জন্য না। আমরা ঈদ করবো আগামী বছর। ধুমধাম কইরা ঈদ করবো। ঠিক আছে বড় আব্বা?’

বড় আব্বা মানে আমি। আমাকে জিজ্ঞেস করার শানে নযুল হল, আমি যা বলবো, ছোটটাও অবিকল একই কথা বলবে। প্রতিবছরই এই একই খেলা চলে। আব্বা হয়তো কোন মতে আমাদের এক পিস জামা কিনে দেন। এরপর আর কোন চাওয়া-পাওয়ার বালাই নেই। রঙিন চশমা, ঘড়ি, পিস্তল, বাঁশি কিছুই না। আমি প্রতিবছর মাথা নেড়ে বলি, ‘জ্বি আইচ্ছা’। আমার ছোটটাও অবিকল আমার মত মাথা নেড়ে বলে, ‘জ্বি আইচ্ছা’।

অমন অবলীলায় আমার ‘জ্বি আইচ্ছা’ বলার কারণ আমার মা। আমার মা পতিব্রতা স্ত্রী। স্বামী অন্তঃপ্রাণ। তিনি সবসময় আমাদের কানে ফিসফিস করে মন্ত্র জপেন, ‘বাপে কষ্ট পাইব এমন কিছু বলতে নাই বাজান। তোমরা যদি এমুন কিছু বাবার কাছে চাও, যেইটা দেওনের ক্ষমতা তোমাদের বাবার নাই, তখন কি হইব? তখন তোমাগো সেই জিনিস না দিতে পাইরা তোমাগো বাবায় কষ্ট পাইবো। বাবারে কি তোমরা কষ্ট দিবা?’ আমি মাথা নেড়ে বলি, ‘না আম্মা।’ আমার ছোটটাও আমার মত ৯০ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে মাথা নেড়ে বলে, ‘না আম্মা।’ আম্মা আমাদের দুই ভাইকে বুকে চেপে ধরে রাখেন। কপালে চুমু খান। আম্মা তখন বুকে আরও একটা জিনিস চেপে ধরে রাখেন, তার নাম কষ্ট। কিন্তু সেই কষ্ট আমরা দেখি না।

ঈদের বিশদিন আগে থেকে দিন গোনা শুরু হয়। উনিশ দিন, আঠারো দিন, সতেরো দিন। একেকটি দিন যেন কয়েক মাস। শেষই হয় না। অথচ ঈদের দিনটাই ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়। সবুজের লুঙ্গীর কোচড়ে টাকার ভাঁজটা আরও খানিকটা মোটা হয়। আমি তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে থেকে শুকনো গলায় বলি, ‘ঈদে হাবিজাবি জিনিস কেনন ভালো না। আম্মায় কইছে, টাকা-পয়সা অপচয় করন ঠিক না। আর বাঁশিতে ফু দিলে তো মাইনষের ডিস্টাবও হয়’।

সবুজ ওস্তাদ ছেলে। এসব জিনিস ওর জানা। ও আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে হাসে, তারপর বলে, ‘নাইরকেল পাতা দিয়া তোর আম্মায় যখন বাঁশি বানাই দেয়, তখন হেই বাঁশির শব্দে মাইনসের ডিস্টাব হয় না চান্দু? আমার লগে গুল মারবি না। তোরে টেকা দিব না, তোগো ট্যাকা নাই, হেইডা কস না ক্যা? যা ভাগ!’

আমি ভাগি। ভেগে যাই। বাকি ক’দিন আর সবুজের মুখোমুখি হই না। মনে মনে আল্লাহকে ডাকি। আল্লাহ, আব্বা যেন এইবার ঈদে আমাকে কিছু বাড়তি টাকা দেন। আমি সবুজকে আগেভাগে কিছুই বলবো না। কিন্তু ওর মতো জিনিসপত্র কিনে পুলিশ সেজে ওর মুখোমুখি হবো। তারপর খেলা হবে। সেই খেলায় চোর থাকবে না, থাকবে পুলিশ। পুলিশ-পুলিশ খেলা। কিন্তু আব্বার কাছ থেকে এটা পাওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। সম্ভাবনা একটা আছে, যদি মামা আসেন তাহলে। আর তা না হলে...

আমি আর ভাবতে পারি না। বুকের ভেতর কেমন করে। গলার গোড়ায় শক্ত মতন কী ঠেকে! কিন্তু আমি কাঁদতে চাই না। আমি দিন গুনি। ইস! আর মাত্র চারটে দিন। তিনটি দিন। দুই দিন। কাল ঈদ! কাল!

ঈদের দিন সকাল। আব্বা এখনো আসেননি। একটার পর একটা লঞ্চ ছেড়ে যাচ্ছে। আমি উৎকণ্ঠিত হয়ে তাকিয়ে আছি। প্রতিটি মুহূর্ত যেন প্রলম্বিত ঘড়ির কাঁটা। বুকের ভেতর ধীরে টিকটিক বয়ে যায়। প্রতিটি সেকেন্ড। পাশের বাড়ির মোহসিন কাকা বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় চিৎকার করে ডেকে বললেন, ‘ওই, তোর আব্বায় যেই লঞ্চে উঠছিল, সেইটা চরে ঠেইক্কা গেছে। চর থেকে জোয়ার না আসন পর্যন্ত লঞ্চ বাইর হইতে পারবো না। বাড়ি পৌঁছাইতে, পৌঁছাইতে রাইত হইব’।

আমি হতভম্বের মতন তাকিয়ে থাকি। আমার ছোটটাও। সে গুটিগুটি পায়ে এসে আমার পাশে দাঁড়ায়। তারপর বলে, ‘ভাইয়া, নতুন জামা?’ আমার হঠাৎ নতুন জামার কথা মনে পড়ে। রঙিন চশমা, ঘড়ি, বাঁশি, পিস্তলের ঘোরে আমি জামার কথা ভুলেই ছিলাম। আমি ওর কথায় কোন জবাব দেই না। আম্মার দিকে তাকাই। আম্মা কেমন অদ্ভুতভাবে যেন ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসার চেষ্টা করেন, ‘চিন্তা কইরো না আব্বারা, তোমার বাবা চইলা আসবো, নতুন জামা নিয়া আসবো’। ছোট ভাইটা আম্মার কোলের কাছে গিয়ে বলল, ‘নামাজের পড়ে আসব আম্মা? রাইতের বেলা আসবো? তখন জামা দিয়া কি করবো?’

এ কথার উত্তরে আম্মা কিছু বলেন না। শাড়ির আঁচলে চোখ লুকান। আমাদের চোখ থেকে পালিয়ে বেড়ান। যেন আমরা পুলিশ আর আম্মা চোর। চোর-পুলিশ খেলা হচ্ছে। সবুজ আর আমার মতো। অইখানে সবুজ পুলিশ আর আমি চোর, এখানে আমি পুলিশ আর আম্মা চোর। আসলে জগতটাই একটা চোর-পুলিশ খেলা। সময় আর অবস্থাভেদে এখানে আমরা সবাই চোর, সবাই পুলিশ।

দুই.
আমার সব লেখাই ইদানীং কেমন মন খারাপের হয়ে যাচ্ছে। যেন মন খারাপের সোল এজেন্সি নিয়ে নিয়েছি। এই লেখাটার শেষটা হয়তো এমন ছিল না। হয়তো অন্যরকম ছিল, আনন্দময়। হয়তো নামাজে যাওয়ার আগমুহূর্তে মামা এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। তার হাতে নতুন জামা। তিনি আমাদের দুই ভাইকে দু’হাতে ধরে ঈদগাহে নিয়ে গিয়েছিলেন, হয়তো। হয়তো নামাজ শেষে মেলা ঘুরে কিনে দিয়েছিলেন ঘড়ি, চশমা, পিস্তল আর বাঁশি। আমি বাড়ি ফিরে বিকেলে কাঁচুমাচু মুখে সবুজের সামনে গিয়ে হয়তো দাঁড়িয়েছিলাম। সবুজ হয়তো তীব্র উপেক্ষা নিয়ে আমার দিকে তাকাল। রঙিন চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে পিস্তলের নল নাড়াতে নাড়াতে বলল, ‘ওই চোর, খেলা স্টার্ট। এই যে ঘড়িধরা ২মিনিট, এর মধ্যে পালাবি। ধাওয়াইয়া ধরতে পারলে কিন্তু পায়ে গুলি কইরা জেলে ঢুকাই দিমু। খেলা স্টার্ট।’ আমি পরাজিত সৈনিকের মত অন্ধকার মুখে বললাম, ‘জ্বি স্যার’।

আমি পালানোর জন্য দৌড় দিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছি। সবুজের মুখে বিজয়ীর হাসি। আকর্ণবিস্তৃত সেই হাসিতে শৈশবের সবটুকু নির্ভেজাল আনন্দ। আমি হঠাৎ থামলাম। তারপর ঘুরে দাঁড়ালাম। আচমকা বিদ্যুদ্বেগে দুই হাত একসাথে নড়ে উঠলো। ডানহাতে উঠে এলো রঙিন চশমা। সেই রঙিন চশমায় ঢাকা চোখে তাকিয়ে আমি বাহাতে পকেট থেকে পিস্তলখানা তুলে ধরলাম সবুজের বুক বরাবর। তারপর দু’পা সামনে এগিয়ে বললাম, ‘ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট!’

সবুজ হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। ওর চোখমুখে অবিশ্বাস, বিস্ময়। বিস্ময়ের ধাক্কা কাঁটিয়ে নিয়ে ও হেসে উঠলো। তারপর দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘চল আমরা চোর-পুলিশ না, নায়ক-নায়ক খেলি। তুই রুবেল, আমি সোহেল রানা। ইয়া ঢিসুমা ঢিসুমা।’

আমরা দুইজন গলা জড়াজড়ি করে হেঁটে যাচ্ছি আর গাছ, লতা, পাতা, বাড়ি-ঘরকে কাল্পনিক শত্রু বানিয়ে পিস্তল তাক করছি। তারপর শরীর কাঁপিয়ে দুর্ধর্ষ দুই অ্যাকশন হিরো অভেদ্য গুলিতে শত্রুদের বুক ঝাঁঝরা করে দিচ্ছি। ইয়া ঢিসুমা ঢিসুমা...

লেখক : তরুণ লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা।

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন