মাবিয়ার মৃত্যু এবং একটি চেকপয়েন্ট
মে মাসের শেষের দিক। পূর্ব জেরুজালেমের বিখ্যাত হাসপাতালটি পরিদর্শনে গেছেন ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার একদল সাংবাদিক। সেখানকার ১২০ নম্বর কেবিনের রোগীটির অবস্থা শোচনীয়। তার চিকিৎসক জানান, বছর তিনেক ধরেই ক্যান্সারের সঙ্গে লড়ে চলেছেন কেবিনের বাসিন্দা ওই ফিলিস্তিনি নারী মাবিয়া আবু সালাহ। ওইদিন সকালে হঠাৎ করেই শরীরের বামপাশে ভয়াবহ ব্যথা অনুভব করতে থাকেন তিনি। যদিও শেষ যাত্রার জন্য এখনও প্রস্তুত নন তিনি। কেননা তিনি একজন মা এবং মৃত্যুর আগে শেষবারের মত তিনি তার সন্তানদের দেখতে চান। এটি একটি সাধারণ চাওয়া হলেও তার জন্য এটি অসম্ভব স্বপ্ন। কেননা তিনি একজন ফিলিস্তিনি। আর এ কারণেই তার সন্তানদের পক্ষে ইসরাইল অধিকৃত ভূখণ্ডে প্রবেশ করা অনেকটা চাঁদে যাওয়ার মতই কঠিন ব্যাপার।
মাবিয়া আবু সালাহ অবস্থান করছিলেন পূর্ব জেরুজালেমের অগাস্টা ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে। হাসপাতালের গ্রাউন্ডে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গাছগুলোতে ফুটে আছে বসন্তের কত না বাহারী ফুল। কী মনোরম দৃশ্য! কিন্তু চাদরের নিচে শুয়ে শুয়ে কেবিনের জানালা দিয়ে এই দৃশ্য দেখলে আরও কষ্ট বাড়ে মাবিয়ার। কেননা প্রকৃতির এই শোভা তাকে কেবল ছেলেমেয়েদের কথা মনে করিয়ে দেয়। ফিরে যেতে ইচ্ছে করে নিজের বাড়িতে। তার আশা আজ না হলেও দু’একদিনের মধ্যে বাড়ি ফিরবেন তিনি। কিন্তু এই দুটোর কোনটাই সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। হাসপাতালের চিকিৎসক থেকে শুরু করে নার্স, ওয়ার্ডবয়, কেমিস্ট, অ্যাকাউন্টেন্ট সবাইকে ডেকে ডেকে তিনি ছেলেমেয়েদের গল্প করেন।
তার দুই ছেলে দুই মেয়ে। সবচেয়ে ছোটটির বয়স মাত্র তের বছর। ছেলেমেয়েরা তো হাসপাতালে তাদের মায়ের পাশে থাকার জন্য পাগল। কিন্তু ইসরাইল কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিলে তো! এক ছেলে হাসপাতালে আসার আবেদন করেছিল। কিন্তু তার আবেদন নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। তার বড় ছেলেটি থাকে জর্দানে। আর এ কারণেই তাকেও ইসরাইলে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। তার বড় মেয়েটি থাকে ইসরাইল সীমান্তের অপরপ্রান্তে। তারও মাকে দেখার খুব ইচ্ছা ছিল। পারমিট পায়নি সেও। তাদের অপরাধ তারা ফিলিস্তিনি। কেবল সালাহের স্বামী জামাল আবু সালাহ যার সঙ্গে দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে সংসার করেছেন মাবিয়া, কেবল তাকেই হাসপাতালে স্ত্রীকে দেখতে আসার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তিনি একা একাই আসেন হাসপাতালে। স্ত্রীর বিছানার পাশে রাত কাটান। মধ্যরাতে হাসপাতালের নির্জন করিডোরে ঘুরে বেড়ান। রুগ্ন স্ত্রীর পাশে তার ছেলেমেয়েদের উপস্থিতি কামনা করেন তিনিও। কিন্তু ইসরাইলি শাসকদের নির্মমতা তার এই ইচ্ছা কখনই পূরণ হতে দেয়নি।
দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে এই অমানবিক নির্মমতার শিকার হচ্ছেন ফিলিস্তিনি জনগণ। এ নিয়ে কথা বলার কেউ নেই। এ নিয়ে নিশ্চুপ পশ্চিমা বিশ্ব ও মানবাধিকার কর্মীরাও। ইসরাইলি সীমান্ত বেষ্টিত রয়েছে কাঁটাতার, প্রাচীর আর অসংখ্য চেকপয়েন্ট দিয়ে। ইসরাইলি ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে হলে নানা ধরনের পারমিট লাগে ফিলিস্তিনিদের। যদিও সবার ভাগ্যে এই পারমিট পাওয়ার সুযোগ জোটে না। তবে অসুস্থ ফিলিস্তিনিদের চিকিৎসার জন্য পূর্ব জেরুজালেমের হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়ে থাকে। জেরুজালেমের অধিকার নিয়ে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ব্যাপক বিতণ্ডা রয়েছে। এই পবিত্র শহরের অর্ধেক নিজেদের বলে দাবি ফিলিস্তিনিদের। অন্যদিকে জেরুজালমের এক ইঞ্চি মাটি ছাড় দিতে নারাজ ইসরাইল কর্তৃপক্ষ। তারা গোটা জেরুজালেমকে নিজেদের বলে দাবি করে থাকে। কয়েক বছর আগে পূর্ব জেরুজালেম কব্জা করে নেয় ইহুদী শাসকরা। ফিলিস্তিনিরা শহরের এই অংশকে ‘অধিকৃত ভূখণ্ড’ বলে বিবেচনা করে থাকে। জেরুজালেমের দখল নিয়ে ইসরাইলিদের মধ্যে একগুয়েমি থাকলেও ইসরাইলি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে আসা ফিলিস্তিনিদের পর্যাপ্ত যত্ন নিয়ে থাকেন এখনকার চিকিৎসক ও কর্মচারীরা। পশ্চিমতীরে স্বাস্থ্যসেবা অপ্রতুল হওয়ায় ইসরাইলি হাসপাতালগুলোতে ফিলিস্তিনিদের ভিড় লেগেই থাকে। গতবছর গাজা ও পশ্চিমতীর থেকে সাড়ে চার হাজার ফিলিস্তিনি ইসরাইলের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবা নিয়েছিলেন। এছাড়া পূর্ব জেরুজালেমের ছয়টি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিয়েছিলেন অতিরিক্তি আরো ২০ হাজার ফিলিস্তিনি।
এ এলাকার একটি সুপরিচিত হাসপাতাল হচ্ছে অগাস্তা ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল। ১২০ শয্যার এই হাসপাতালটি একটি লুথারান দাতব্য প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে থাকে যার অধিকাংশ কর্মচারীই ফিলিস্তিনি। এই হাসপাতালের পরিচালক ওয়ালিদ নামুর ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রতিনিধিকে বলেন, ‘বিশ্বাস করুন, রোগীদের সুস্থ করে তোলার জন্য আমরা চাঁদের দেশে যেতেও প্রস্তুত আছি।’
তিনি হাসপাতালের ইসরাইলি চিকিৎসক এবং ফিলিস্তিনি কর্মচারীদের প্রশংসা করে বলেন, ‘ইহুদি, খ্রিষ্টান আর মুসলিম কর্মীদের সহযোগিতায় আমরা একটি ভিন্নধর্মী মানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছি। কয়েক দশকের পুরনো ঘৃণা আর সন্দেহকে দূরে সরিয়ে রেখে আমরা এখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘একজন ফিলিস্তিনি হিসেবে আমি ইসরাইলের সর্বত্র বৈষম্যের শিকার হলেও এই হাসপাতাল ব্যতিক্রম। যদিও সবকিছুতেই একটা দখলদারিত্বের ছোঁয়া রয়েছে।’
ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে মাবিয়া ও অন্য ফিলিস্তিনিরা চিকিৎসা করাতে চাইলে অবশ্যই দুটো জিনিস সঙ্গে আনতে হবে। একটা হচ্ছে ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের রেফারেন্স; যেখানে চিকিৎসার খরচ নিজেকে বহন করার অঙ্গীকারনামা লিপিবদ্ধ থাকে। আর ইসরাইলে সফরের অনুমতিপত্র যা ইসরায়েলি সামরিক ও গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ প্রদান করে থাকেন। এই পারমিট দেওয়ার আগে অনেক সময় সেনেবেতে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিতে হতে পারে বিশেষ করে যারা গাজার বাসিন্দা। এসব ফিলিস্তিনি রোগীর সঙ্গে সাধারণত একজন কখনও বা দুজন নিকটাত্মীয়কে পূর্ব জেরুজালেমে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়ে থাকে। তবে রোগীর সঙ্গে কোনো তরুণ সদস্যকে বিশেষ করে ছেলেদের থাকতে দেওয়া হয় না। ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, অনেক সময় এমনও দেখা যায়, একজন অসুস্থ সন্তানের সঙ্গে হাসপাতালে যাওয়ার অনুমতি পেলেন না তার বাবা-মা। এগুলো খুবই মর্মান্তিক ঘটনা বলে উল্লেখ করেন ওই হাসপাতালের পরিচালক।
ক্যামিওথেরাপির জন্য পারমিট
এপ্রিল মাসের এক রোববার বিকেলে প্রথমবারের মত মাবিয়া আবু সালাহের সঙ্গে দেখা করেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রতিনিধি দলটি। তখন তার চিকিৎসক রাউন্ডে ছিলেন। ৫১ বছরের ওই রোগীকে তখন অক্সিজেন দেওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। দর্শনার্থীদের দেখে খুবই খুশি সালাহ। কারণ তাকে কেউ দেখতে আসে না!
এই হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসাটা একজন ফিলিস্তিনি নারীর জন্য অতটা সহজ ছিল না। এজন্য তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে দীর্ঘ পথ। সালাহ ও তার স্বামী পশ্চিম তীরের উত্তরাঞ্চল অবস্থিত নিজেদের বাড়ি থেকে প্রথমে বাসে যাত্রা শুরু করেছিলেন। বাসটি রামাল্লা হয়ে কালানদিয়া চেকপয়েন্ট দিয়ে জেরুজালেম প্রবেশ করেছিল। সেখান থেকে তারা আরও একটি বাসে ওঠেন এবং সবশেষে ট্যাক্সিতে করে গন্তব্যে পৌঁছান। চার ঘণ্টায় ৭০ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে তবেই হাসপাতালে আসতে পেরেছিলেন ক্যান্সার আক্রান্ত মাবিয়া। অথচ পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে নিজেদের গাড়ি দিয়েই হাসপাতালে পৌঁছতে পারতেন তিনি। এই দীর্ঘ ভ্রমণ একজন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
তিন বছর আগে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে জেনিনে এক ফিলিস্তিনি হাসপাতালে যান মাবিয়া। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সেখানকার চিকিৎসকরা তার ডান কিডনিতে কিছু সমস্যা আছে বলে জানান। কিন্তু তারা নিশ্চিত ছিলেন না। পরে ইসরাইলি হাসপাতালে আসার সিদ্ধান্ত নেন মাবিয়া। তবে পূর্ব জেরুজালেমে আসার জন্য পারমিট জোগাড় করা তার জন্য সহজ ছিল না। প্রথমে ইসরাইলি সামরিক বিভাগ তাকে তেলআবিব হাসপাতালে যাওয়ার অনুমতি দেয়। সেখানে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তারা নিশ্চিত হন যে, সালাহ কিডনির ক্যান্সারে আক্রান্ত। এর তিন মাস পর পূর্ব জেরুজালেমের সেন্ট জোসেফ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য মাবিয়াকে আর একটি পারমিট দেয় ইসরাইল। এরপরই ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের চিকিৎসকরা তার চিকিৎসা করার সুযোগ পান এবং তাকে থেরাপি দেওয়া শুরু করেন। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
এ সম্পর্কে মাবিয়া ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রতিবেদককে বলেন, ‘পশ্চিমতীরে আমার চিকিৎসা সম্ভব ছিল না। কেননা সেখানকার স্বাস্থ্যসেবা ততটা উন্নত নয়।’ আর এটাই ছিল মাবিয়ার সঙ্গে সাংবাদিকদের শেষ কথোপকথন। কেননা এরপরই সংজ্ঞাহীন অবস্থায় চলে যান তিনি। ইসরাইলের চিকিৎসা ব্যবস্থা এতটাই আধুনিক ও উন্নত যে ক্যান্সার আক্রান্ত মাবিয়াকে সারিয়ে তোলার মত সক্ষমতা ওই হাসপাতালের চিকিৎসকদের ছিল। কিন্তু সেই চিকিৎসার আওতায় আসার জন্য তাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল যে কারণে দেরি হয়ে গিয়েছিল অনেক। এই সাক্ষাৎকারের মাত্র তিনদিন পরই মাবিয়ার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে। শেষ হয়ে যায় চিকিৎসকদের সমস্ত প্রচেষ্টা।
তার চিকিৎসক ওয়াসিম শারবাতি বলেন, ‘তিনি যদি একজন ইসরাইলি হতেন তাহলে তার শেষ দিনগুলো অন্যরকম হত। আমরা তাকে ঘরে ফেরার অনুমতি দিতাম এবং তার সঙ্গে থাকত একজন সাইকো থেরাপিস্ট, একজন ডায়েটিসিয়ান। কিন্তু এখন তিনি হাসপাতালে স্বজনহীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে চলেছেন।’ মাত্র কয়েক পা দূরেই দাঁড়িয়ে আছেন তার স্বামী জামাল।
বাষট্টি বছরের জামালের গোটা জীবন কেটেছে ইসরাইলে একজন গৃহনির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। যেদিন তার স্ত্রী মাবিয়া সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন সেদিনও তিনি তেলআবিবের এক স্থাপনায় কাজ করছিলেন। এই কাজের জন্য অবশ্য তাকে পৃথক একটি ওয়ার্ক পারমিট জোগাড় করতে হয়েছিল।
স্ত্রীর গুরুতর অবস্থার খবর পেয়ে দ্রুত হাসপাতালে ছুটে আসেন জামাল। তখনও তার নখে লেগেছিল প্লাস্টারের ধুলা। তিনি বলেন, ‘আমরা বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলাম।’ তার স্ত্রী হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছে। গলা দিয়ে গড়গড় শব্দ হচ্ছে। জামাল তার কপালে হাত রাখেন। এরপর বাইরে গিয়ে অস্থিরভাবে সিগারেট টানতে থাকেন। দ্রুত মোবাইল টিপতে থাকেন। ছেলেমেয়েদের তার মায়ের মৃত্যুর খবর দিতে থাকেন। কেননা ছেলেমেয়েরা তো এখানে আসতে পারবে না। জামাল আবু মাবিয়া আক্ষেপ করে বলেন, ‘এটা ঠিক না। আমার ছেলেমেয়েদের তাদের মাকে শেষ দেখার অধিকার ছিল।’
জামাল আরও জানান, সেই রাতে তার স্ত্রী হঠাৎ করে তার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। তিনি তার স্বামীকে জিজ্ঞেস করেন, তার নাতি-নাতনিরা একা একা কেন ইসরাইলি চেকপয়েন্টে এসেছে। তাদের এটা উচিত হয়নি। আসলে তিনি তখন ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলেন এবং ভুল বকছিলেন। তার নাতি-নাতনিরা ছোট এবং তখন ওরা বাড়িতেই ছিল। এ প্রসঙ্গে জামাল বলেন, ‘আমি ওর কথা শুনে অবাক হয়েছিলাম। আসলে মৃত্যুর সময়ও তার মাথায় ইসরাইলি চেকপয়েন্টের কথা ঘুরছিল। বার বার সে চেকপয়েন্টের কথাই বলছিল। তাই শেষ মুহূর্তে ফেরেশতাদের বদলে সে ইসরাইলি সেনাদেরই দেখছিল!’
শেষ চেকপয়েন্ট
মে মাসের এক বৃহস্পতিবার বিকেলে মারা যান মাবিয়া আবু সালাহ। একজন চিকিৎসক তার বাহু চাপড়ে জানান, সে মারা গেছেন। একজন নার্স তার কানের সোনার দুল জোড়া জামালের কাছে হস্তান্তর করেন। জামাল তার হাত দুটো তার স্ত্রীর মুখে রাখেন এবং সুরা পড়তে থাকেন। তার জুতো, পার্সসহ টুকটাক জিনিসপত্র একটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখেন। তারপর হলঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করেন। এরপর পাগলের মত তার ছেলেমেয়েদের ফোন করতে থাকেন। যাতে তারা তাদের মায়ের জানাজা ও দাফনের ব্যবস্থা করে রাখতে পারে।
স্ত্রীর মৃতদেহ বহনের জন্য জামাল জেরুজালেম থেকে একটি প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করেন। কিন্তু মৃত সালাহ’র জন্য বাড়ি ফেরাটাও অত সহজ ছিল না। বিভিন্ন স্থানে মাবিয়ার লাশটি এক অ্যাম্বুলেন্স থেকে আর এক অ্যাম্বুলেন্সে ঘুরতে থাকে। জামাল চাইছিলেন না তার ছেলেমেয়েরা এগুলো দেখুক। তাই তিনি তাদের চেকপয়েন্টে না আসার অনুরোধ করেন, ‘গ্রামেই থাক। আমি তোমাদের মাকে বাড়িতে নিয়ে আসছি।’
এদিকে মাবিয়ার লাশ যখন এক গাড়ি থেকে অন্য গাড়িতে স্থানান্তরিত হচ্ছিল তখন একজন ইসরাইলি পুলিশ আর একজন সশস্ত্র সেনা তার কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখছিল। তার ফিলিস্তিনি পরিচয়পত্রে দেওয়া ফটোর সঙ্গে মৃতদেহটিকে মেলানোর জন্য সেনা কর্মকর্তাটি মাবিয়ার মুখ পর্যন্ত দেখে। এরপরই মেলে তার ডেথ সার্টিফিকেট এবং শেষ পারমিট বা অনুমতিপত্র। অথচ ইসলাম ধর্মে একজন মৃত নারীর লাশ পুরুষদের দেখা নিষিদ্ধ।
গুডবাই মাবিয়া
মে মাসের শুক্রবার পশ্চিমতীরের উত্তরাঞ্চলীয় শহর আরাবায় সমাধিস্থ করা হয় মাবিয়াকে। তার জানাজায় অংশ নিয়েছিল শত শত ফিলিস্তিনি। তার আপনজনেরা কাঁধে করে তার মরদেহটি গোরস্থানে নিয়ে এসেছিল এবং এটি রাখা হয়েছিল পুরনো জলপাই বনের পাশে। তার স্বামী আর দুই ছেলে তার লাশটি কবরে শুইয়ে দেন। তার মেজো ছেলে মোহাম্মদ আলী একজন রসায়নবিদ। তার বড় ছেলে যিনি একজন অঙ্কের শিক্ষক, তিনি থাকেন জর্দানে। তিনি বেলচা দিয়ে মায়ের কবরে মাটি ফেলতে থাকেন।
তার ১৩ বছরের মেয়ের নাম সিওয়ার। মায়ের লাশ দেখার পর সে বাবার বুকে আঘাত করতে করতে বলেছিল, ‘আমাকে না দেখে মা কীভাবে মরে গেল! তুমি তাকে জীবিত নিয়ে গেলে আর ফিরিয়ে আনলে মৃত!’
তার ছেলে আলী মায়ের সঙ্গে থাকার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। তিনি জেরুজালেমে যাওয়ার জন্য সাতবার ইসরাইলি সেনাদের কাছ থেকে পারমিটের জন্য আবেদন করেছিলেন। ছয়বারই তার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়। কেবল একবারই তিনি মাকে দেখার অনুমতি পেয়েছিলেন। আর জেরুজালেমে এটাই তার প্রথম এবং শেষ সফর। শোকার্ত আলী আস্তে আস্তে বলেন, ‘মায়ের আর আমার মধ্যে দূরত্ব ছিল মাত্র পাঁচ মাইল এবং একটি চেকপয়েন্ট। আমি মায়ের কত কাছে ছিলাম! যদিও সেই চেকপয়েন্ট পেরোনোর ক্ষমতা আমার ছিল না।’
এসইউ/জেআইএম