সঠিকভাবে সৎকারের দাবি যৌনকর্মীদের
ভোরের আলোয় দেখা স্বপ্ন যাদের রাতের আঁধারে হারিয়ে যায়; তারা যৌনকর্মী। জামালপুরের রাণীগঞ্জেও রয়েছে যৌনপল্লী। এই পল্লীর অধিকাংশ নারী-ই ভোটার। তারা ভোট দেন জনপ্রতিনিধিদের। কিন্তু তাদের ভাগ্যে মেলে না কোনো নাগরিক অধিকার। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে বেড়ে ওঠে যৌনকর্মীদের শিশুরা। বৃদ্ধাদের দিন যায় অনাহারে। মৃত্যুর পর কোনো ধর্মমতেই সৎকার হয় না তাদের।
জানা যায়, প্রায় ৮ মাস আগে অসুস্থ হয়ে মারা যান ২৭ বছর বয়সী জুঁই (ছদ্মনাম)। লাশ দাফনের জন্য জামালপুর পৌর ফৌতি গোরস্থানে নিয়ে যান তার সহকর্মীরা। জানাজার জন্য স্থানীয় আলেমদের অনুরোধ করা হলে জুঁইয়ের জানাজা পড়াতে অস্বীকার করেন। হতাশ হয়ে সহকর্মীরাই কোনোভাবে মাটি চাপা দিয়ে আসেন। ৭ বছর আগে একই রকম ঘটনা ঘটে শিল্পীর (ছদ্মনাম) সঙ্গেও। কোথাও সৎকার করতে না পারায় দু’দিন যৌনপল্লীর রাস্তায় পড়ে থাকে শিল্পীর মরদেহ। খবর পেয়ে তৎকালীন স্থানীয় কাউন্সিলর সিদ্ধার্থ শংকর লাশ মাটি চাপা দেয়ার ব্যবস্থা করেন।
প্রায় আড়াইশ বছরের পুরনো রাণীগঞ্জ যৌনপল্লীতে মারা যাওয়া প্রত্যেক যৌনকর্মীর সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটে যুগ যুগ ধরে। সভ্য সমাজে ঠাঁই নেই তাদের। প্রয়োজনে হাট-বাজার কিংবা চিকিৎসার জন্য বাইরে এলে দেখা হয় অবহেলার চোখে। শিকার হতে হয় নানা লাঞ্ছনা আর অবজ্ঞার। এখানকার শিশুরাও বেড়ে উঠছে অজানা ভবিষ্যৎ নিয়ে। ছেলেরা হয়ে উঠছে মাদকাসক্ত আর মেয়েরা ধরছে মায়ের পথ। ‘অপরাজেয় বাংলাদেশ’ নামে একটি এনজিও শিশুদের নিয়ে কাজ করলেও আর্থিক সংকটে সেটিও সঙ্কুচিত হয়ে গেছে।
অপরদিকে বয়সের ভারে ন্যুব্জরা অভাব-অনটনে দিন কাটায়। অর্ধশতাধিক বৃদ্ধা সেখানকার কর্মক্ষম যৌনকর্মীর গৃহস্থালির কাজ করে কোনো রকমে বেঁচে থাকলেও রাতে ঘুমানোর জায়গা নেই। পল্লীর ভেতরে কোনো বাড়ির বারান্দায় রাত কেটে যায় তাদের। এখনও মেলেনি বয়স্কভাতার কার্ড।
তাদের অভিযোগ, ‘নির্বাচন এলে তাদের নানা আশ্বাস দিলেও নির্বাচিত হওয়ার পর কেউ আর খোঁজ রাখে না। ৭০ বছর বয়সী পিয়ারী বেগম (ছদ্মনাম) জাগো নিউজকে বলেন, ‘নির্বাচন আসলে প্রার্থীরা আমাদের খালা-চাচি ডাইক্যা ভোট নিয়ে যায়। পার হওয়ার পর তাদের কাছে গেলে দূর দূর করে তাড়াইয়্যা দেয়। এতো বয়স হইলো, এখন পর্যন্ত কোনো ভাতার কার্ড পাইলাম না।’
সূর্যের হাসি সমাজকল্যাণ সংস্থার সভানেত্রী মোছা. রেখা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘নাগরিক হিসেবে আমরা কোনো মূল্যায়ন পাই না। এখানে সবাই আসে। অথচ তারা মারা গেলে দাফন হয়; আমরা মারা গেলেই যত দোষ। আমাদের জীবিত অবস্থায় মূল্যায়ন না করলেও মৃত্যুর পর যেন অন্তত ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সৎকার করা হয়।’
বর্তমানে এখানে ১১টি বাড়িতে প্রায় ৬০০ কক্ষ রয়েছে। আর রেজিস্ট্রেশনভুক্ত যৌনকর্মীর সংখ্যা ৪৭৪ এবং অস্থায়ী যৌনকর্মী প্রায় ৯শ’ জন।
বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থা জামালপুরের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর সেলিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘মৃত্যুর পর তাদের সৎকার না হওয়াটা অত্যন্ত অমানবিক। সরকারের উচিত দেশের প্রত্যেক নাগরিকের মতো তাদের দিকেও সুদৃষ্টি দেয়া।’
পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিলর রাজীব সিংহ সাহা জাগো নিউজকে বলেন, ‘ইতোমধ্যেই তাদের জন্য মাতৃত্বকালীন সুবিধা চালু করে দেয়া হয়েছে। বয়স্কভাতা চালুর পরিকল্পনা রয়েছে এবং সে লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে। এছাড়া এখানকার শিশুসহ যৌনকর্মীদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে।’
জামালপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. রাসেল সাবরিন জাগো নিউজ বলেন, ‘যৌনকর্মীদের সৎকার করতে দিচ্ছে না এমন অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। জামালপুরে শেখ রাসেল শিশু কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। যৌনপল্লীর শিশুদের সুরক্ষার জন্য সেখানে রাখার ব্যবস্থা করা যাবে। পৌরসভার সঙ্গে আলোচনা করে বয়স্কভাতা চালুর বিষয়টি দেখা হবে।’
এসইউ/জেআইএম