ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

পাশ্চাত্যের শিক্ষা ও মৃতপ্রায় লোকজ সংস্কৃতি

রাব্বী আহমেদ | প্রকাশিত: ০৬:৫৮ এএম, ১৮ মে ২০১৭

কোনো লোকজ সংস্কৃতিকে একটি জেনারেশনেই পরিবর্তন করতে চাইলে কী করা উচিত? অবশ্যই আবহমান কাল ধরে যে মাধ্যমে শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হতো, সে মাধ্যমকে পরিবর্তন করতে হবে। উনিশ শতকেই আমেরিকার সরকার জেনে গিয়েছিল এ কথা। নেটিভ আমেরিকার শিশুদের বাধ্য করা হয়েছিল সরকারের বোর্ডিং স্কুলগুলোতে পড়তে যেতে। আজকের পৃথিবীতে স্বেচ্ছাসেবী কাজের অংশ হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের চিরাচরিত সমাজে এ ধরনের বিদ্যায়তন প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে এবং স্থানীয় মানুষদের বিভিন্ন পন্থায় আকৃষ্ট করা হচ্ছে এই বলে যে, আদিবাসী শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য এই শিক্ষা একমাত্র পন্থা। কিন্তু এই ধারণা আদৌ কতটুকু সত্য? কী ঘটে যখন কোনো চিরাচরিত সমাজে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির আলোকে পৃথিবীকে দেখা এবং অনুধাবনের শিক্ষাকে পাশ্চাত্য তথাকথিত আধুনিক শিক্ষা দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হয়। লস্ট পিপল ফিল্ম নিবেদিত ক্যারোল ব্ল্যাক পরিচালিত ‘স্কুলিং দ্য ওয়ার্ল্ড : দ্য হোয়াইট ম্যান’স লাস্ট বার্ডেন’ ডকুমেন্টরিতে এ বিষয়টিই তুলে ধরা হয়েছে। ২০১০ সালে এই ডকুমেন্টরি মুক্তি পায়। আধুনিকতা কিভাবে চিরাচরিত জ্ঞানকে বিনষ্ট করছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় এই ডকুমেন্টরিতে। এখানে দেখানো হয় তথাকথিত আধুনিক শিক্ষা কিভাবে ভারতের লাদাখ অঞ্চলের সংস্কৃতির ওপর প্রভাব বিস্তার করে। যার ফলে নব প্রজন্মের মধ্যে নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলে যাবার প্রবণতা দেখা দেয় এবং ক্রমশ সে সংস্কৃতি বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যায়। মূলত এই ডকুমেন্টরি প্রমাণ করে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রচার-প্রসারের ফলে কিভাবে লোকজ জ্ঞান ও শিক্ষা পদ্ধতি ব্যাহত হয় এবং সে সংস্কৃতির মূল্যবোধ পরিবর্তিত হতে শুরু করে।

ভারতের জম্মু এবং কাশ্মীরের একটি অঞ্চল লাদাখ যার বিস্তৃতি কুনলুন পর্বতমালা থেকে দক্ষিণ হিমালয় পর্যন্ত। এটি মূলত ইন্দো-আর্য এবং তিব্বতীয় অধ্যুষিত একটি এলাকা। Moravian মিশন ১৮৮৯ সালের অক্টোবরে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে এবং প্রত্যেক পরিবার থেকে একজনের বেশি বাচ্চাকে স্কুলে যেতে বাধ্য করা হয়। এই অধ্যাদেশ স্থানীয় লোকজনের ওপর আতঙ্কের জন্ম দেয়। কারণ শিশুদের ক্রিশ্চান ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা সৃষ্টি হতে পারে ভেবে। এই স্কুলে তিব্বতিয়ান ভাষা, উর্দু, ইংরেজি, ভূগোল, বিজ্ঞান, প্রাকৃতিক বিদ্যা, পাটি গণিত, জ্যামিতি এবং বাইবেল শেখানো হয়। স্থানীয় সমাজ কর্তৃক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করার অভিপ্রায়ে ল্যামডন সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৭৩ সালে। মূলত পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রচারের ফলে ধীরে ধীরে স্থানীয় শিক্ষা লোপ পেতে শুরু করে। এতে একটি জেনারেশনের মধ্যে বিপুল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। যা এই ডকুমেন্টরিতে তুলে ধরে হয়েছে।

map

প্রারম্ভেই লাদাখের একজন প্রৌঢ়ার আক্ষেপবাণীর মাধ্যমেই স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়, যা ডকুমেন্টরির শুরুতেই দেখানো হয়। তিনি বলেন, তার বড় মেয়ে তার সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর জন্য শহরে গিয়েছে। তার ছোট মেয়েও স্কুলে যাবার জন্য লেহতে গিয়েছে। এই ফার্ম দেখাশোনার জন্য তিনি একাই সেখানে বসবাস করছেন। মাঠে পানি দিচ্ছেন, গরু চড়াচ্ছেন। তিনি আরো জানান, পূর্বে এমন ছিল না। তার সন্তানরা এখন শিক্ষিত, তাই তারা এখানে থাকতে চান না। খুব ভালো হতো যদি সবাই আবার একত্রে বসবাস করতো। বৃদ্ধার এই কথার মধ্যেই টের পাওয়া যায় পাশ্চাত্যের শিক্ষার প্রভাব।

pic

দীর্ঘ সময় ধরেই পাশ্চাত্যের শিক্ষাকে ভারত এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচারের তোরজোর ছিল তা লক্ষ্য করা যায় বিভিন্নভাবে। ডকুমেন্টরিতে দেখানো হয়, ১৮৭২ সালে American Progress নামে একটি চিত্রে একজন শ্বেতাঙ্গ নারী শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছেন এবং শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিকরা তাকে অনুসরণ করছেন। অপরদিকে ভারতীয়রা এবং পশুরা তাকে দেখে পালিয়ে যাচ্ছে। তার কপালে সে সাম্রাজ্যের তারকা পরে আছে এবং ডান হাতে একটি স্কুল বই বয়ে বেড়াচ্ছে। আমেরিকানরা যখন পশ্চিমে যায়; তখন তারা সহস্রাধিক স্থানীয় আমেরিকান শিশুদের জোর করে পরিবার থেকে কেড়ে নেয়। তাদের সরকার চালিত বোর্ডিং স্কুলে পড়তে পাঠানো হয়। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল তাদের জীবন যাপনের পদ্ধতিকে নষ্ট করা। এই জীবন যাপন পদ্ধতির সাথেই জড়িত রয়েছে তাদের আঞ্চলিক জ্ঞান, জীবনকে উপলব্ধি করার ক্ষমতা, নিজস্ব সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা এবং সর্বোপরি আঞ্চলিক জ্ঞানকে জীবনমুখী শিক্ষা হিসেবে কাজে লাগানো। যার অনেকটাই পাল্টে গিয়েছে পাশ্চাত্যের তথাকথিত আধুনিক শিক্ষার প্রভাবে।

Carlisle Indian School এর প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল রিচার্ড প্রাট ভারতীয়দের পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত করার বিষয়ে বলেন, ‘To Civilize the Indians... Immerse them in our civilization and when we get them under... hold them there until they are throughly soaked.’ এই স্কুলের আরম্ভ বাণীতে ছিল, ‘Let all that is Indian within you die’. এর মাধ্যমেই অনুধাবন করা যায় ভারতীয়দের ওপর পাশ্চাত্যের শিক্ষা চাপিয়ে দেয়ার বিপুল প্রচেষ্টা ছিল ঔপনবেশিকদের। ব্রিটিশ শাসিত স্কুল ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিল পাশ্চাত্যের চিন্তা, চেতনা, দর্শন দ্বারা প্রভাবিত করা। এমন একটি গোষ্ঠী তৈরি করা যারা বাহ্যিকভাবে ভারতীয় কিন্তু তাদের চিন্তা, রুচি, বুদ্ধিমত্তা, নৈতিকতা, সিদ্ধান্ত, মতামত সবকিছু ইংরেজদের মত।

শুধু ভারতীয়রাই এই নির্যাতনের শিকার হয়েছে- তা নয়। আমেরিকান আর্মি প্রায় পাঁচ লক্ষ ফিলিপাইনের বেসামরিক নাগরিককে মেরে ফেলে এবং জীবিতদের শিক্ষিত করার জন্য সেনা শিক্ষক পাঠানো হয়। ওই সময়ের একটি কার্টুনে প্রকাশ পায় যে, একজন সাদা মানুষ একজন কালো চামড়ার মানুষকে বহন করছে এবং স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে। যার শিরোনাম ছিল ‘The White Man’s Burden’. এভাবেই ক্রমশ পাশ্চাত্যের শিক্ষা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে স্থাপন করা হয় এবং এর প্রভাবে পাল্টে যেতে থাকে স্থানীয় শিক্ষা ব্যবস্থার ধরন। লাদাখ জনগোষ্ঠীর আলোকে নির্মিত গবেষণাধর্মী এই ডকুমেন্টরিকে তাই নাম দেওয়া হয়েছে ‘স্কুলিং দ্য ওয়ার্ল্ড : দ্য হোয়াইট ম্যান’স লাস্ট বার্ডেন’।

লাদাখ জনগোষ্ঠী ঐতিহ্যগতভাবেই উদারতা এবং সহমর্মিতা শেখে কারণ তারা বুদ্ধের দীক্ষায় দীক্ষিত। সময় পরিক্রমায়, উন্নতির ধারাবাহিকতায় এখন প্রত্যেকে তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাচ্ছে এবং আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হবার সাথে সাথে তাদের পুরনো মূল্যবোধ মরে যাচ্ছে। এখন সবার মধ্যেই ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হবার প্রবণতা। ফলে সবাই তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে বসবাস করছে এবং একে অন্যকে সাহায্য করার যে প্রবণতা তা ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে। কিন্তু পূর্বে এমন ছিল না। একে পাশ্চাত্যের আধুনিক শিক্ষার প্রভাব বলেই মনে করেন লাদাখের স্থানীয় নারীরা। তারা আরো মনে করেন, আধুনিকা শিক্ষা শুরুর আগে তারা আধ্যাত্মিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতেন তাদের সন্তানদের। কিন্তু এখন বাস্তবিক সফলতার ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়। এখন মানুষ স্কুলে যায়, যেন তারা অনেক টাকা কামাতে পারে, ভালো ঘর নির্মাণ করতে পারে এবং ভালো গাড়ি চালাতে পারে। শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যই পাল্টে গেছে। এখন শিক্ষা লাভের মূল উদ্দেশ্য- কিভাবে প্রচুর টাকা আয় করা যায়। এমনই মনে করেন লাদাখের স্থানীয় নারীরা।

pic

বিশ্বজুড়ে বিচিত্র সংস্কৃতি রয়েছে। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ওপর নৃবিজ্ঞানীরা গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। সাংস্কৃতিক ভিন্নতার সাথে সাথে শিক্ষা গ্রহণের পদ্ধতির ভিন্নতাও পরিলক্ষিত হয়। একেক সমাজে গড়ে উঠেছে একেকরকম শিক্ষা ব্যবস্থা। রয়েছে নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস, আচার, অনুষ্ঠান, ধরন। কিন্তু যখন জোরপূর্বক কোনো একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতির ওপর জোর দেওয়া হয় এবং সে সংস্কৃতিকে অন্য সংস্কৃতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়; তখন দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ঐতিহ্য বাধাগ্রস্ত হতে হতে একসময় তা বিলুপ্ত হয়ে যায়। শুধু তাই নয়- এর মাধ্যমে কোনো সংস্কৃতির নিজস্বতাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যখন কেউ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়, সে শিক্ষা তাকে তার শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং স্বাভাবিকভাবেই সে তার অঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থান, আলো বাতাস, জলবায়ু সম্পর্কে সম্যক কোন ধারণা রাখে না। সে শিক্ষা শুধু কম্পিউটারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে যায়। ফলে যখন কেউ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হন, তিনি আসলে জানেন না কিভাবে নিজস্ব পরিবেশে টিকে থাকা যায়। এই শিক্ষা একজন মানুষকে ক্রমান্বয়ে পণ্য হিসেবে তৈরি করে। যে শিক্ষার সাথে মানবিকতার কোন সম্পর্ক নেই। যে শিক্ষা তাকে নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। যেমনটি এই ডকুমেন্টরিতে লাদাখ জনগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যায়।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির একজন এথনোবোটানিস্ট ওয়েড ডেবিস মনে করেন, ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা ভিন্ন ভিন্ন রকমের মানুষ তৈরি করে। কোনো সমাজে যা খুব জরুরি। এই সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের ফলে মানুষের এত বৈচিত্র্য। কিন্তু যখন সবাইকে একই ধরনের শিক্ষায় শিক্ষিত করানো হয় তখন এই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য নষ্ট হয়। এই ডকুমেন্টরিতে দেখানো হয়, একজন শিশু তার মায়ের সাথে গম ক্ষেতে গম তুলছে। মা তাকে আদর করছে, চুমু খাচ্ছে। শিশুটিও তার মাকে আদর করছে, যেভাবে মা তাকে আদর করেছে। এর দ্বারা বোঝা যায়, মানুষের মৌলিক শিক্ষাগুলো কোনো স্কুল-কলেজ কিংবা প্রতিষ্ঠান দিতে পারে না। এই শিক্ষাগুলো মানুষ শেখে পরিবার থেকে, পারিপার্শি্বক পরিবেশ থেকে। International Society for Ecological and Culture এর হেলেনা নুরবার্গ হজের মতে, আধুনিক শিক্ষা বস্তুত মানুষকে ভোক্তাসংস্কৃতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যার কারণে, প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। তিনি মনে করেন, একসময় জ্ঞানচর্চাই ছিল শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু এখন এর দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। জ্ঞানচর্চা নয়, বরং চাকরি পাওয়াই এখনকার শিক্ষা লাভের মূল উদ্দেশ্য। তিনি বর্তমান শিক্ষাকে মনে করেন আরবান কনজিউমার কালচার শেখার প্রধান কারণ।

নোবেলবিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ‘স্কুল শিশুদের ঈশ্বরের নিজ হাতে তৈরি হস্তশিল্প থেকে কেড়ে নেয়। এটি নিছক একটি পদ্ধতি যা স্বতন্ত্রবোধকে অগ্রাহ্য করে।’ তিনি মনে করেন, স্কুল সবসময় ইউনিফর্ম ফলাফল যায়। যে কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কখনোই প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারে না। জন স্টুয়ার্ট মিল মনে করেন, জেনারেল শিক্ষা আসলে সবাইকে একই ছাঁচে গড়ে তোলার মতলব। যে ছাঁচে তাদের তৈরি করা হয় আদতে তা সরকারকে সন্তুষ্ট করে। এটি মনের ওপর স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে এবং শরীরের ওপর প্রাকৃতিক প্রবণতা তৈরি করে। Navdanya/Research Foundation For Science, Technology and Ecology এর Vandana Shiva মনে করেন, বিগত শতাব্দীতে পশ্চিমা শিক্ষা ব্যবস্থার উত্থান ঘটেছে শিল্পায়নের ওপর ভিত্তি করে। যা আদতে মানুষকে জীবনমুখী কোনো শিক্ষা দিতে পারেনি কিংবা স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠতেও সহযোগিতা করেনি। এমনকী তারা নিজস্ব কম্যুনিটির কোনো সাহায্য-সহযোগিতায়ও কাজে আসেনি বরং তারা শিল্প উৎপাদনে যোগ্য হবার জন্য একেকটি পণ্য হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছে। তিনি আরো বলেন, ‘একদা আমরা প্রজ্ঞা থেকে জ্ঞানের দিকে যেতাম আর এখন আমরা জ্ঞান থেকে তথ্যের দিকে ধাবিত হচ্ছি।’ বিশ্বায়নের এই যুগে একটা তীব্র প্রতিযোগিতা চারপাশে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেখানে লোকজ জ্ঞানকে উন্নতির পথে প্রধান অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। যে কারণে, লোপ পাচ্ছে লোকজ সংস্কৃতি, শিক্ষা সর্বোপরি লোকজ জ্ঞান। বিশ্ববাজারে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থায় নিয়ে আসা হচ্ছে ব্যাপক পরিবর্তন। এই পরিবর্তন আদতে প্রতিটি ব্যক্তিকে একটা তীব্র প্রতিযোগিতায় ফেলে দিচ্ছে বলে মনে করেন হেলেনা। তার মতে, তরুণ প্রজন্মকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে যেন তারা সুবিশাল মোবাইল কর্পোরেশনে যোগ্য হয়ে ওঠে।

বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যকে কমিয়ে আনার জন্য বিশ্বব্যাংক প্রাথমিক শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন থেকে যায়, ব্যাংক আসলে কার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে? বিশ্বের সব শিশু যদি একই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়, তবে এই সুযোগ আসলে কারা ভোগ করছে? নিশ্চয়ই শাসক দেশগুলো। হিসেব করে দেখা যায় যে, আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশে হাইস্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েট হতে ব্যর্থ হওয়া শিক্ষার্থীদের পারসেন্টেজ যথাক্রমে নিউ অরলিয়েন্সে ৪৬ দশমিক ৬ শতাংশ, ডেট্রোয়েটে ৭৮ দশমিক তিন শতাংশ, ডালাসে ৫৩ দশমিক ৭ শতাংশ, নিউইয়র্কে ৬১ শতাংশ। প্রায় ১,৩২,৪৭,৮৪৫ জন আমেরিকান দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে।

লাদাখের ইকোনোমিক্স টেক্সট বই মতে, যারা অশিক্ষিত এবং নিরক্ষর রয়ে যাবে; তারাই প্রাচীন ধর্মকর্ম নিয়ে থাকবে এবং ঐতিহ্য পালন করবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, অশিক্ষিত রয়ে যাওয়া মানে আসলে কী? কিংবা শিক্ষিত হওয়া আসলে কাকে বলে? দেখা যায় যে, অধিকাংশ স্থানীয় মানুষই কিভাবে চাষাবাদ করতে হয়, গরু চড়াতে হয়, কাপড় বুনতে হয়- এসব তারা জানে। এসব শিক্ষা প্রাকৃতিক- যা কোনো স্কুল-কলেজে শেখানো হয় না। অথচ তারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই দিব্যি জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে। দেখা যায়, যারা স্কুলে যায় তাদের চেয়ে যারা স্কুলে যায়নি তারাই বেশি জ্ঞানী।

ডকুমেন্টরিতে লাদাখের অন্যতম স্কুল ল্যামডন মডেল স্কুলের চিত্র দেখা যায়। সে স্কুলের শিক্ষক এবং বেশকিছু শিক্ষার্থীদের মতামতও জানা যায়। দেখা যায়, তারা জন্মসূত্রে লাদাখের হলেও লাদাখ সম্পর্কে তারা তেমন কিছুই জানে না, জানে না লাদাখের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য কিংবা ধর্মীয় মূল্যবোধও। তারা ক্রমান্বয়ে পশ্চিমা শিক্ষা ব্যবস্থার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে নিজেদের মূল্যবোধ হারাতে বসেছে। মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, ‘সত্যিকার স্বাধীনতা কখনোই আসবে না যদি না আমরা নিজেদের পশ্চিমা শিক্ষা, চিন্তা, চেতনা এবং মানসিক দাসত্ব থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারবো।’

ডকুমেন্টরিটির শেষদিকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের বিপরীতে লোকজ শিক্ষায় শিক্ষিতদের জীবনযাত্রা সমান্তরালে দেখানো হয়। দেখা যায়, তথাকথিত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতরা যতোটাই বিচ্ছিন্ন, হতাশ, জীবন নিয়ে বিতৃষ্ণা  লোকজ শিক্ষায় শিক্ষিতরা ততোটাই প্রাণোচ্ছ্বল, সজীব, প্রাণবন্ত। অর্থাৎ লোকজ শিক্ষায় শিক্ষিতরাই বেশি সুখী। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কখনোই অর্থ উপার্জন নয় বরং জীবনকে আরো ভালোভাবে অনুধাবন। তথাকথিত আধুনিক শিক্ষা যা মূলত পাশ্চাত্য শিক্ষারই ধারক-বাহক কিভাবে লোকজ সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করছে তার উত্তম চালচিত্র এই ডকুমেন্টরিটি।

স্কুলিং দ্য ওয়ার্ল্ড ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দেয় আমাদের সামনে। ভাবতে শেখায়, উন্নয়নের নাম করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে স্থাপন করা বিদ্যায়তনগুলো আসলে কতোটুকু মানবতার খাতিরে আর কতোটুকু পাশ্চাত্যের শিক্ষাকে প্রসারের লক্ষ্যে এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। নিসন্দেহে তথাকথিত ‘বেটার ফিউচার’র দোহাই দিয়ে পূর্ব থেকেই নিজেদের মতো প্রাচুর্যে ভরপুর জনগোষ্ঠীকে পশ্চিমা চিন্তা-চেতনায় দীক্ষিত করা হচ্ছে, যার ফলে নতুন প্রজন্মের সাথে পুরনো প্রজন্মের মধ্যে ফারাক বেড়ে যাচ্ছে। গ্রামগুলো হারাচ্ছে তরুণ প্রজন্ম যারা আর মাঠে কাজ করছে না, বরং শহরে গিয়ে তারা বিশ্বের অন্যান্য মানুষের সাথে প্রতিযোগিতায় মগ্ন হচ্ছে। যারা প্রতিনিয়ত সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সিঁড়ি অতিক্রম করতে ব্যস্ত। ডকুমেন্টরি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, এই আদিবাসী গোষ্ঠী আসলে অর্ধশিক্ষিত হচ্ছে যার ফলে তারা তাদের জনগোষ্ঠী থেকে পৃথক পৃথিবীতে বসবাস করছে। যার ফলে তাদের চিরায়ত আধ্যাত্মিক সফলতার সাথে বাস্তবিক সাফল্যের দ্বন্দ্ব বেড়েই যাচ্ছে ক্রমশ।

পাশ্চাত্যের শিক্ষা সবাইকে একই ছাঁচে গড়ে তুলতে চায়, যার ফলে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। এই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য আসলে টাকা উপার্জন করা এবং পুঁজিবাদী বিশ্বে নিজেকে যোগ্য করে তৈরি করা। দারিদ্র্যকে নির্মাণ করেছে পশ্চিমা বিশ্ব। কারণ ট্রেডিশনাল সমাজগুলো নিজেদের মতো জীবন যাপনে অভ্যস্ত এবং নিজেদের মত করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। কিন্তু যখনই পশ্চিমা মাপকাঠিতে তাদের বিচার করা হচ্ছে, তারা দরিদ্র বলে বিবেচিত হচ্ছে। আধুনিক শিক্ষার প্রভাবে বিলুপ্ত হচ্ছে চিরাচরিত সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, পারস্পরিক সহমর্মিতা, নীতি-নৈতিকতা তথাপি মানুষের সহজাত মানবিক গুণাবলী। এভাবেই প্রাচীন সংস্কৃতিগুলো, যারা হাজার বছর ধরে পৃথিবীর বুকে টিকে রয়েছে নিজের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে, তথাকথিত উন্নয়নের নাম করে পশ্চিমা শিক্ষা এদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ক্রমান্বয়ে দূষিত করা হচ্ছে তাদের আবহমান সংস্কৃতিকে। এভাবেই পৃথিবীর লোকজ জ্ঞানগুলো পশ্চিমা জ্ঞানের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর বুক থেকে। প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে বিচিত্র সংস্কৃতি, হারাচ্ছে বিশ্বজুড়ে বৈচিত্র্যময় মানুষের স্বকীয়তা।

তথ্যসূত্র:
* Schooling The World : The White Man’s Last Burden.
* youtube.com.
* en.wikipedia.org/wiki/Ladakh
* Kopnina, Helen. Schooling The World : Exploring the critical course on sustainable development through an anthropological lens; International Journal of Educational Research 62 (2013) 220-228.

এসইউ/আরআইপি

আরও পড়ুন