জীবনের মাঝে খুঁজি জীবন
নগরের বুকে জলে একাকার। পানিতে ভাসছে অনেকের স্বপ্ন। মোড়ে মোড়ে আগন্তুকের ভিড়। এখানে আবার কেউ নাড়ীর টানে গাড়ির অপেক্ষায়। তাদের সহযাত্রী আমি। এর মাঝে নিঃসঙ্গ মুসাফিরের মতো একা স্টার জলসার নায়িকাদের দেখছি। তারাও আশ্চর্য সুন্দর, দেখিয়ে চলছে অবিরাম। কে কতটুকু দেখাতে পারে এমন প্রতিযোগিতাও দৃশ্যমান! অতিদৃশ্যমানরা উঠে যায় বিলবোর্ডে। বিলবোর্ড সুখ অনুভূত হয় মৌসুমী বাকলে।
তবে আজ ভেতরে ভালোবাসার হাহাকারকে ডিঙিয়ে বাড়ি ফেরার অদম্য ইচ্ছা। বাড়িতে আমার প্রিয়জনরা অধীর আগ্রহে পথপানে চেয়ে আছেন। কখন যে আসবে অবুঝ বালক। মা আমার জানে, পাখিরা বিরাণ প্রান্তর ঘুরে আসে আপনালোয়। অনেক কাঠ-খড় জলে ডুবিয়ে নগর থেকে বের হলাম। যেভাবে বের হয় চিমনি থেকে ধোঁয়া। রাতের আকাশ দেখে বাড়ি ফিরছি।
টানা বৃষ্টিতে নিরাভরণ চারপাশ। খুব উপভোগ্য সময়। যতোই এগোচ্ছি অনুসন্ধানী চোখ ততোই বড় হচ্ছে। কী হারালাম, আর কী বা খুঁজছি। দীর্ঘ আশি বছর আল মাহমুদ তার মায়ের হারানো নোলক খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। আমি কিনা অর্ধযুগ আগে হারিয়ে পাব? নদী-নারী, মানুষ-পাখি কে কার মাঝে? জীবন, ফিরে দেখা সময় কোথায় খুঁজি!
খবরের কাগজে উঠে আসে না সব। জীবন দেখি জীবনের মাঝে। রবির স্পর্শে কুয়াশা ভেদ করে জ্বলে উঠবে আলো। যে আলোয় আমি আমার সময়কে নতুন করে দেখতে পাবো। প্রকৃতি চোখ মেলছে। আমি রাজপথ দিয়ে বাড়ি পৌঁছলাম। খোলা দরজায় মাকে দেখলাম, সঙ্গে বাবাকেও। একে একে সব চিরচেনা চন্দনমুখ। জানতে চায় সবাই- আমি কেমন, সময় কেমন, শহর কেমন? কোনটা কেমন লাগে তার জবাব বোধের দেয়াল টপকে আসে না। হঠাৎ পিছন থেকে কাহলিল জিবরান আমার হয়ে জানায় : ‘ভালোবাসি অপরিচিত পথে পথে হেঁটে বেড়াতে আর পাশ দিয়ে যাওয়া অচেনা মানুষদের তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে। আমি ভালোবাসি নিঃসঙ্গ মুসাফির হতে’।
আমার কাছে গ্রাম আর শহর মানে হচ্ছে আত্মা থেকে দেহর মতো। দু’টির সংযোগ কোনো কালেই ঘটেনি। আর সে প্রেক্ষিতে মনের সঙ্গে শরীরের মিলন আপেক্ষিক! ঢাকায় নিকষ কালো আঁধারে অবাধ্য সন্তানের মতো ঘুমাতাম। একা হলে প্রায় সবাই নিয়ম ভাঙার মাস্টার হয়ে যায়। আমার বাড়িতে সেটা আকাশ কুসুম। সম্ভব নয়, নিয়ম মানতে হয়।
আমার একা ঘর। মা খুব ভোর থেকে একটু পরপর আসেন। মায়ের ডাকে বিনয়ী কণ্ঠে জবাব দিয়ে শান্ত মেজাজে উঠে পড়ি। আর খুব সকালে উঠলে মনে হয় দিনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনেক কাজ করা যায়। প্রতিনিয়ত সেটাই করান আমার মা। এটা করাতে পারলে মায়েদেরও বোধ হয় খুব ভালো লাগে।
পুকুরঘাটে ঘুমজড়ানো কণ্ঠে ছোট্ট মামুনিটার কাছে দোয়া চাইতে বলল : ‘আমি তো ছোট। তুমি বড় হলে দোয়া করতাম, এখন তুমি আমার বড়। কেন দোয়া করবো? তোমাকে আরো দোয়া করলে তুমি আল্লাহর সমান হয়ে যাবে, আর আমাদের সাথে দেখা করবে না।’ মনে পড়ে আমার : ঈশ্বর থাকেন ভদ্র পল্লিতে। তাই বাবুটার কাছে হার মানলাম।
একটু পরে ছুটলাম বাগানের দিকে। গাছের সঙ্গে রয়েছে আমার দীর্ঘ সখ্যতা। জীবন খুঁজে পাই তাদের মাঝে। নিয়ত দাঁড়িয়ে আছে। যা দিচ্ছে, যা নিচ্ছে সমান। কোনো ভেদাভেদ নেই। সত্যি স্বাধীন প্রকৃতি। আমি আমার জীবনকে দেখতে, জীবনকে জীবনের মাঝে খুঁজে পেতে দুনিয়া ঘুরতে চাই। অবাধ স্বাধীন থাকতে চাই। কারণ আমি বিশ্বাস করি, কাহলিল জিবরানের কথা : ‘... মহৎ না হয়েও একজন ব্যক্তি মুক্ত-স্বাধীন হতে পারে, কিন্তু মুক্ত- স্বাধীন না হয়ে কোন ব্যক্তিই মহৎ হতে পারে না।’
লেখক : কবি ও সম্পাদক, কালের ধ্বনি
এসইউ/পিআর