শৈশবের বৃষ্টি
বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য গ্রীষ্মকাল। ঝড়-বৃষ্টি তো এ সময়ে অবধারিত। এ সময়ের বৃষ্টি নিয়ে আমাদের কত স্মৃতি জমে আছে। এখন কংক্রিটের শহরে বৃষ্টি নামলেই সেই স্মৃতিগুলো ভেসে ওঠে চোখের তারায়। মনের ক্যানভাসে আঁকি ফেলে আসা বৃষ্টিস্নাত দিনের ছবি। বৃষ্টিঝরা দিনের তেমন এক স্মৃতির কথা জানিয়েছেন তরুণ লেখক ও নির্মাতা সাদাত হোসাইন।
উচ্চশিক্ষার্থে নানু বাড়ির স্কুলে ভর্তি হয়েছি। স্যার কৃষি শিক্ষা পড়াতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বিস্টি নামলে কী হয়?’
আমি বললাম, ‘কই মাছ ওঠে।’
স্যার হতভম্ব গলায় বললেন, ‘কই মাছ ওঠে মানে?’
আমি বললাম, ‘আমাগো ইশকুল মাঠে বিস্টি নামলেই কই মাছ ওঠে। ইশকুলের পাশে বিশাল পুস্কুনি আছে, অইখান থেইকা শত শত কই মাছ কানে হাইটা মাঠে উইঠা আসে।’
স্যার বললেন, ‘কি কয় এই পুলা?’
আমি নির্বিকার গলায় বললাম, ‘কথা সইত্য। আমরা ইশকুলে পরীক্ষা দিতেছি, ক্লাস ফোরে না ফাইভে পড়ি। বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি। একটু পরপর বিজলি চমকায়। টিনের চালের ফুটা দিয়া পানি পড়তেছে। আমি বইছি লাস্টের বেঞ্চে, অংক পরীক্ষা। পুরা প্রশ্নে দুইটা মাত্র অংক পারি। খুব মনোযোগ দিয়া লেখতেছি। অনেকক্ষণ পর হঠাৎ মনে হইল, কি ব্যাপার? আর কারো কোন সাড়া-শব্দ নাই কেন? সামনে তাকাই দেখি পুরা ক্লাসরুম ফাঁকা। আমি ছাড়া একটা মাছিও নাই। ঘটনা কি! বাইরে তাকাই দেখি, পরীক্ষার খাতাপত্র রাইখা, স্যারেরা-ছাত্ররা সবাই মিল্যা মাঠে কই মাছ টুকাইতেছে। পাশের পুস্কুনি থেইকা ঝাঁকে ঝাঁকে কই মাছ উঠতেছে কানে হাইটা। আমি একবার খাতার দিকে তাকাইলাম, একবার মাঠের দিকে। তারপর গায়ের জামাটা খুইলা লাফ দিয়া মাঠে নামলাম। একঘণ্টা বিস্টি ভেজার পর স্যার কইল, ‘যার যার মাছের কাইনসার (কানের) ভিত্রে রশি ঢুকাইয়া বাইন্ধা রাইখা, আবার মাঠে আস। আইজকা ইশকুল ছুটি, পরীক্ষা কাইল হইব। ওই পুলাপাইন, ফুটবল নিয়ায়, মাঠে অখন ফুটবল খেলা হইব।’
উচ্চশিক্ষার্থে যেই স্কুলে গিয়েছি, সেই স্কুলের স্যার আমার দিকে চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে রইলেন। আমি তাকিয়ে রইলাম জানালা দিয়ে বাইরে। বাইরে সুনীল আকাশ। একটা চিল উড়ে যাচ্ছে ডানা মেলে। আমার হঠাৎ ওই চিলটার মতন উড়ে যেতে ইচ্ছে হল। ডানা মেলে সীমাহীন পথ। কিন্তু আমি বসে ছিলাম উচ্চশিক্ষার্থে লোহার গ্রিল দেওয়া জানালার কংক্রিটের ক্লাসরুমে।
এখনো বসে আছি, অন্য এক কংক্রিটের ক্লাসরুমে। সেই ক্লাসরুমের নাম জীবনের ক্লাসরুম। স্কুলের ক্লাসরুম থেকে মুক্তি মেলে। কিন্তু জীবনের এই ক্লাস রুম থেকে মুক্তি মেলে না।
মাঝে মাঝে জীবনের ক্লাসরুমের ব্ল্যাকবোর্ড এমন তুমুল বৃষ্টির সন্ধ্যায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘হায় শৈশব, হায় কই সব?’
এসইউ/জেআইএম