ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

বৈশাখে আমাদের প্রত্যাশা

প্রকাশিত: ১০:৫৭ এএম, ১৩ এপ্রিল ২০১৭

বছর ঘুরে এলো বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ মানেই একটি অনন্য বৈশিষ্ট্যময় সামাজিক মহোৎসব। বাঙালি সমাজে এই দিনটির গুরুত্ব বলার অপেক্ষা রাখে না। এটি ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি-পেশা, ছেলে-বুড়ো নির্বিশেষে সব মানুষের প্রাণের উৎসব। নববর্ষ পৃথিবীর সর্বত্রই দেশীয় সংস্কৃতি ও জনগণের আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে উদযাপিত হয়ে থাকে। নতুন বছরের এই দিনটিকে ঘিরে প্রতিটি মানুষের মনে প্রত্যাশা থাকে, অতীতের সব গ্লানি ধুয়ে-মুছে নতুনভাবে বছরটা যতোটা সম্ভব নিজের মতো করে বরণ করে নিবে।

বলা হয়ে থাকে, বাংলা নববর্ষের শুরুটা হয়েছিল সম্রাট আকবরের শাসনামলে রাজকীয় খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে। কৃষিকাজ ও খাজনা সংগ্রহের ব্যবস্থাকে ঘিরে দিনটির প্রচলন হলেও এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় ব্যবসা-বাণিজ্যের দেনা-পাওনার হিসাব মেটানোর ব্যাপারটিও। দিনে দিনে পয়লা বৈশাখ হয়ে ওঠে এক সর্বজনীন সাংস্কৃতিক আনন্দ-উৎসব। ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাংলা ভূখণ্ডের সব মানুষের প্রাণের উৎসবে পরিণত আজ পহেলা বৈশাখ। পৃথিবীতে এমন অসাম্প্রদায়িক উৎসব দ্বিতীয়টি আছে বলে জানা নেই। বাঙালির আদি সাংস্কৃতিক পরিচয় বহনকারী এই অসাম্প্রদায়িক উৎসবটির গুরুত্ব তাই এককথায় অবর্ণনীয়।

পহেলা বৈশাখের শুরুর দিকে যদিও এটি ছিল মূলত গ্রামাঞ্চলকেন্দ্রিক বাৎসরিক উৎসব। গ্রামীণ মেলা, লোকজ নানা ধরনের খেলাধুলা ও নৃত্য-সংগীত ছিল এর প্রধান আকর্ষণ। দিনে দিনে এই উৎসব শহরাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়াতে আজকাল পহেলা বৈশাখের উৎসবের আড়ম্বর শহরাঞ্চলই বেশি লক্ষণীয়। রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, ঢাবির চারুকলা অনুষদ থেকে সূচিত বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা ছাড়াও মহানগরের বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় নানা ধরনের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে এই দিনে। শহরের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক লোকেশনে আবার কোথায়ও বসে তিন দিনের মেলা। শহরের মাঠগুলোতে তরুণরা মেতে ওঠে বৈশাখী কনসার্টে।

বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতেও শুধু যে বৈশাখী মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানই হয়ে থাকে- তা নয়। সঙ্গে ব্যবসায়ীরা খুলে বসেন হালখাতা। আর তরুণরা এদিন দলে দলে বৈশাখী উৎসবের রঙিন পোশাক পরে বেরিয়ে আসেন ঐতিহ্যবাহী দেশি খাবারের উৎসবে। সর্বত্র দেখা যায় নতুন প্রাণের উচ্ছ্বাস। তরুণ সমাজই এ উৎসবের প্রাণ। তাদের পেছনে যারা উৎসবের ভিত্তিটি গড়ে দেন, তারা এ দেশের কৃষক ও শ্রমজীবী সাধারণ জনগণ। বাংলা নববর্ষকে ঘিরে দেশি পোশাক-পরিচ্ছদ ও খাদ্যের চাহিদা ও মর্যাদা বাড়ে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিত্য-নতুন সাজে এই উৎসবে চাকচিক্য এসেছে। বেড়েছে এর বৈচিত্রও। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে সারা দেশের তারুণরা অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে বলীয়ান হয়ে সমাজ পরিবর্তনের দিকেও এগিয়ে আসছে। সৌন্দর্য, মানবিকতা, সাম্য, স্বাধীনতার প্রতি তারুণ্যের সহজাত সমর্থন ও নিষ্ঠা সৃষ্টিতে বৈশাখী উৎসবের অবদান অতুল্য।

নাগরিক জীবনে পহেলা বৈশাখে যে সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশ ঘটেছে, তা প্রবর্তনের কৃতিত্ব কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। জনশ্রুতি আছে যে, তিনিই প্রথম শান্তি নিকেতনে ঋতুভিত্তিক উৎসবের আয়োজন করেন। এর অংশ হিসেবে বৈশাখ বরণের উৎসবের জন্য বাংলা নতুন বছরকে সম্ভাষণ জানিয়ে রচনা করেছেন বহু কালজয়ী সংগীত ও কবিতা।

যেকোনো জাতির ক্ষেত্রেই নববর্ষ মানেই নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন, নতুন সংকল্প। নববর্ষ মানেই অসাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় ঐক্যবোধে দীপ্ত হওয়ার উপলক্ষ্য। এ কারণেই এ উৎসবের গুরুত্ব দিনে দিনে বৃদ্ধি পেয়ে পরিণত হয়েছে বাঙালি জাতির জীবনের এক মহোৎসব হিসেবে। তাই দিনটি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ফলে ভোর থেকেই রাজধানীর পথে পথে ঢল নামে উৎসবমুখর নগরবাসীর।

লাল-সাদা হলো বৈশাখী উৎসবের প্রধান রং। প্রতিবছর এ দিনটিতে নারীদের পরনে থাকে সুতি শাড়ি, হাতে কাচের চুড়ি, চুলে তাজা ফুলের মালা। পুরুষদের পোশাক হয়ে থাকে রঙিন। যা প্রধানত পাঞ্জাবি। এ দিনে কেউ যোগ দিয়ে থাকেন মঙ্গল শোভাযাত্রায়, কেউ যান গান শুনতে বা গাইতে। কেউ বা পথের পাশের পসরা থেকে লোকজ খেলনা ও কারুপণ্য কেনাকাটা করেন। আবার অনেকে উদ্যানের ছায়ায় বা লেকের পাড়ে বসে সহপাঠী বা বন্ধুদের সঙ্গে মেতে উঠবেন আড্ডায়। দিনটিকে ঘিরে পোশাকের মতো আহারেও প্রাধান্য পাবে বাঙালির চিরকালের পছন্দের খাদ্যগুলো। পান্তা-ইলিশ, হরেক রকমের ভর্তা, ভাজি, আচার, চাটনির মতো দেশীয় খাদ্যে এ দিনে তৃপ্ত হবেন উৎসবমুখর মানুষ। সবমিলে আহারে-বিহারে আনন্দ-স্ফূর্তিতে কেটে যাবে বছরের প্রথম দিনটি।

সবশেষে নতুন বছরকে সামনে রেখে গত বছরের আবর্জনাসহ দূর হোক সাম্প্রতিক জঙ্গিবাদ। যা কিছু জীর্ণ-পুরনো, অশুভ-অসুন্দর, তা পিছনে ফেলে নতুনের কেতন উড়িয়ে সম্প্রীতির বন্ধনে স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জঙ্গিবাদের ধকল সামলে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাক লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ বাংলাদেশ- বৈশাখে এটাই যেন সতেরো কোটি মানুষের প্রাণের আকুতি। বৈশাখে আমাদের প্রত্যাশা, নিপাত যাক জঙ্গিবাদ।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন