সংস্কৃতি : প্রফেসর ডক্টর এনামুল হক
সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রফেসর ড. এনামুল হককে স্বাধীনতা পুরস্কার ২০১৭ প্রদান করা হয়। তাঁকে নিয়ে আজকের আয়োজন–
প্রফেসর ডক্টর এনামুল হক ১৯৩৭ সালের ০১ মার্চ বগুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক ও ইতিহাস-প্রত্নতত্ত্বে স্নাতকোত্তর এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
কর্মজীবনে এনামুল হক ১৯৬২ সালে ঢাকা জাদুঘরে যোগদান করে ১৯৬৫ সালে অধ্যক্ষ, ১৯৬৯ সালে পরিচালক এবং ১৯৮৩-৯১ মেয়াদে জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩-৮৯ মেয়াদে আন্তর্জাতিক জাদুঘর পরিষদের এশিয়া-প্যাসিফিক আঞ্চলিক সংস্থার সভাপতি ছিলেন। ১৯৯০ সালে তিনি সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব নিযুক্ত হন। বঙ্গীয় শিল্পকলা চর্চার আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি এবং বার্ষিক জার্নাল অব বেঙ্গল আর্টের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এনামুল হক জাতীয় জাদুঘর প্রতিষ্ঠা এবং আহসান মঞ্জিলকে জাদুঘরে রূপান্তরের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। এছাড়া কবিতা, গীতিনৃত্যনাট্য, ইতিহাস-প্রত্নতত্ত্ব-ঐতিহ্য-শিল্পকলাবিষয়ে গবেষণামূলক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনার মাধ্যমে তিনি দেশে-বিদেশে সুখ্যাতি অর্জন করেন। বাংলাদেশের প্রাচীন ও মধ্যযুগের শিল্পকলার ঐতিহ্যকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উপস্থাপনের জন্য বিশ্ব-গবেষকদের সমন্বয়ে এ যাবৎ ১২টি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সংগঠক হিসেবে সফল ভূমিকা রাখেন।
এনামুল হক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় পাঠক-সমাদৃত সাহিত্যপত্রিকা ‘উত্তরণ’র প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫৩ সালে কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকাকালে তিনি প্রায় দেড়শ’ মেথর ও রিকশাচালকের সন্তানদের জন্য পাঠশালা স্থাপন করে শিক্ষাদান করেন।
মুক্তিযুদ্ধকালে প্রফেসর ডক্টর এনামুল হক বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে নিউইয়র্কে যান এবং বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতের কাছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরার ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উজ্জীবিত রাখতে তিনি লন্ডনে বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ‘অস্ত্র হাতে তুলে নাও’ শীর্ষক একটি গীতিনৃত্যনাট্য রচনা ও মঞ্চস্থ করেন। জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জয়ন্তী ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপন প্রচলনের ক্ষেত্রে তাঁর প্রয়াস প্রশংসনীয়। আশির দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে তাঁর উপস্থাপনায় ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’ একযুগব্যাপী প্রচারিত হয় এবং অনুষ্ঠানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি ছিল প্রফেসর ডক্টর এনামুল হকের গভীর শ্রদ্ধা। তিনি ১৯৯০ সালের ১৭ মার্চ তারিখে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের জন্য অনুষ্ঠান আয়োজন করেন।
ডক্টর এনামুল হক প্রত্নতত্ত্ব ও শিল্পকলায় ইতিহাসভিত্তিক ১২টি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। এছাড়া ৬টি গীতিনৃত্যনাট্য রচনা করেন, যার চারটির সুরকার তিনি নিজেই এবং অন্য দু’টির সুরকার শহিদ আলতাফ মাহমুদ। তাঁর গবেষণাকর্মের মধ্যে ‘ট্রিয়েজার্স ইন দ্য ঢাক্কা মিউজিয়াম’, ‘নওয়াব বাহাদুর আবদুল লতিফ: এ সোশ্যাল রিফর্মার অব নাইনটিনথ সেঞ্চুরি: হিজ রাইটিংস অ্যান্ড রিলেটেড ডকুমেন্টস’, ‘ঢাকা আলিয়াস জাহাঙ্গীরনগর: ফোর হানড্রেড ইয়ার্স’, ‘দ্য আর্ট হেরিটেজ অব বাংলাদেশ’, ‘চন্দ্রাকেতুগড়: এ ট্রিয়েজার-হাউজ অব বেঙ্গল টেরাকোটাস’, ‘বেঙ্গল স্কাল্পচারস: হিন্দু ইকোনোগ্রাফি আপটু সি.১২৫০ এডি’, ‘ইসলামিক আর্ট হেরিটেজ অব বাংলাদেশ’ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
প্রফেসর ডক্টর এনামুল হক শিক্ষা, সংস্কৃতি ও গবেষণায় অবদানের জন্য ২০১৪ সালে ‘একুশে পদক’, ২০১২ সালে ভারতের চেন্নাইয়ের ‘রীচ ফাউন্ডেশন অ্যাওয়ার্ড’সহ দেশে-বিদেশে অনেক সম্মাননায় ভূষিত হন।
এসইউ/জেআইএম