স্মৃতিতে-স্মরণে জামাল নজরুল ইসলাম
উন্নত বিশ্বে জীবনের ৩০ বছর পার করার পর ১৯৮৪ সালে চলে আসেন দেশে। বিদেশের আকর্ষণীয় বেতনের চাকরি, লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটির রিডার পদ, কেমব্রিজে অগ্রসর বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ অবলীলায় ছেড়ে দিলেন। নিজের দেশে এসে যোগ দিলেন মাত্র তিন হাজার টাকা বেতনের চাকরিতে। কারণ হিসেবে জানিয়েছিলেন, ‘আমি আমার দেশকে ভালোবাসি। আমি এখান থেকে নিতে আসিনি; আমি দিতে এসেছি।’
যে মানুষটির কথা বলছিলাম তিনি বিশিষ্ট তাত্ত্বিক কসমোলজিস্ট প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম। বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বিশ্বতত্ত্ববিদ ও অর্থনীতিবিদ।
এছাড়া তিনি মহাবিশ্বের উদ্ভব ও পরিণতি বিষয়ে মৌলিক গবেষণার জন্য বিশেষভাবে বিশ্বখ্যাত। তার লেখা বই অক্সফোর্ড, কেমব্রিজসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই মানুষটি ছিলেন বিশ্বখ্যাত স্টিফেন হকিংয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও এক সময়ের রুমমেট।
অন্যদিকে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার যেন বাংলাদেশের পক্ষে থাকে সেজন্য তিনি প্রায় সকল ব্রিটিশ এমপির কাছে চিঠি লিখেছিলেন। এমনকী ব্রিটিশ এমপি লর্ড বাটলারের মাধ্যমে চীনের সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রী চু এন লাইয়ের কাছে অনুরোধ করেছিলেন চীন যেন পাকিস্তানের পক্ষে না দাঁড়ায় সেজন্য।
১৬ মার্চ ছোট দেশের বড় বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের প্রয়াণ দিবস। বাংলাদেশের একটি নক্ষত্র হারানোর দিন। তাই ছোট দেশের এই বড় বিজ্ঞানীকে নিয়ে জাগো নিউজের বিশেষ আয়োজন।
জে এন ইসলাম
জামাল নজরুল ইসলাম আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জে এন ইসলাম নামে পরিচিত। গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিদ্যার একজন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী হলেন ড. জামাল নজরুল ইসলাম। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব, কোয়ান্টাম মেকানিক্স, কসমোলজি ও মহাবিশ্বের সৃষ্টি তত্ত্বের মতো জটিল বিষয় নিয়ে তিনি মৌলিক গবেষণা করেছেন। বিশ্বের বিজ্ঞান মহলে যিনি ছিলেন রীতিমত সেলিব্রেটি।
জন্ম ও পড়াশোনা
জামাল নজরুল ইসলাম ঝিনাইদহ শহরে ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মুন্সেফ হিসেবে চাকরি করতেন। নজরুল ইসলামের বয়স যখন মাত্র ১ বছর তখনই তার বাবা কলকাতায় বদলি হন। তাই জামাল নজরুলের ছেলেবেলা কাটে কলকাতাতেই। জামাল নজরুল প্রথমে ভর্তি হন কলকাতার মডেল স্কুলে। এই স্কুল থেকে পরবর্তীতে শিশু বিদ্যাপীঠে। চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত এই বিদ্যাপীঠেই পড়েন। সেখানে ৪র্থ শ্রেণী সম্পন্ন করে তিনি বাংলাদেশের চট্টগ্রামে চলে আসেন ও পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন।
এখানে একটা চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ভর্তি পরীক্ষায় তিনি চমৎকার কৃতিত্ব দেখান। ফলে ‘ডবল প্রমোশন’ পেয়ে সরাসরি ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। ৯ম শ্রেণী পর্যন্ত এই স্কুলে পড়াশোনা করলেও পশ্চিম পাকিস্তানের লরেন্স কলেজ থেকে ও’লেভেল এবং এ’লেভেল পাস করেন। এখানে পড়ার সময়ই গণিতের প্রতি তার অন্যরকম ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। এ’লেভেলের পাঠ চুকিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বি.এসসি অনার্স শেষ করেন। এরপর ১৯৫৭ সালে তিনি কেমব্রিজে পড়তে যান। এখান থেকে প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৫৯ সালে। ১৯৬০ সালে সেখান থেকে মাস্টার্স করেন। এখান থেকেই গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৬৪ সালে। আবার কেমব্রিজ থেকেই ‘ডক্টর অব সায়েন্স’ ডিগ্রি অর্জন করেন।
কর্মজীবন
জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডে পোস্ট ডক্টোরাল ফেলো হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ইসলাম কেমব্রিজের ইনস্টিটিউট অব থিওরেটিকাল অ্যাস্ট্রোনমি-তে ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কেমব্রিজের ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোনমিতে কাজ করেন। মাঝে ১৯৬৮-তে যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটনে অবস্থিত ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্ট্যাডিতে ভিজিটিং সদস্য হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭১ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ভিজিটিং সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের প্রভাষক ছিলেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি কলেজ, কার্ডিফ (বর্তমানে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়) এর সায়েন্স রিসার্চ কাউন্সিলে ফেলো ছিলেন। ১৯৭৮ সালে তিনি লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং পরে রিডার পদে উন্নীত হন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটনে অবস্থিত ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিতে ১৯৬৮, ১৯৭৩ ও ১৯৮৪ সালে ভিজিটিং সদস্য হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৪ সালে নজরুল বাংলাদেশে ফিরে এসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিকাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্সের গবেষক এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালযয়ের একজন সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন।
ব্যক্তিজীবন
জামাল নজরুল ইসলাম বই পড়তে ভালোবাসেন। শখ গান শোনা ও ছবি আঁকার। রবীন্দ্র সংগীত সবচেয়ে প্রিয়। কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের প্রতি তার কোন আগ্রহ ছিল না। ছোটবেলা থেকেই ক্যালকুলেটর ব্যবহারে তার অনীহা ছিল। গাণিতিক হিসাব মাথা খাটিয়ে করতে পছন্দ করতেন। তাই কম্পিউটারের ব্যবহারও তার কাছে ভালো লাগত না। এই অপছন্দের মূল কারণ অবশ্য অপ্রয়োজনীয়তা। তিনি বলতেন, কম্পিউটার তার কাজে লাগে না। তার চিন্তার অনেকখানি জুড়ে ছিল দেশ ও সমাজের উন্নতি এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ। নিজের আয় থেকে কিছু অর্থ জমিয়ে দরিদ্র ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। চট্টগ্রামে পাহাড় ধ্বসে মানুষ মারা গিয়েছিলো। জামাল নজরুল ইসলাম বসে থাকেননি। তিনি তাঁর সাধ্যমত সাহায্য করেছিলেন হতাহতের পরিবারকে। তাছাড়া ১৯৭১ সালে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ বন্ধের উদ্যোগ নিতে বলেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার এই পরোক্ষ অবদান ও পরবর্তীকালে দেশে ফিরে আসা থেকে তার দেশপ্রেমের প্রমাণ পাওয়া যায়। এছাড়া তিনি বিদেশে পড়াশোনা করছে এমন সব শিক্ষার্থীকেই পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে আসতে উৎসাহিত করেন।
জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৬০ সালের ১৩ নভেম্বর সুরাইয়া ইসলামের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর দুই মেয়ে। বড় মেয়ের নাম সাদাফ সাজ সিদ্দিকি আর ছোট মেয়ের নাম নার্গিস ইসলাম।
২০০১ সালে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বলে একটি গুজব রটেছিল। বাংলাদেশেও এই গুজব ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় জামাল নজরুল ইসলাম গণিতের হিসাব কষে দেখান যে, সে রকম সম্ভাবনা নেই। কারণ প্রাকৃতিক নিয়মে সৌরজগতের সবগুলো গ্রহ এক সরলরেখা বরাবর চলে এলেও তার প্রভাবে পৃথিবীর কোন ক্ষতি হবে না।
অন্যদিকে জামাল নজরুল ইসলাম তার ছাত্রজীবন ও কর্মজীবনে বেশকিছু বিজ্ঞানীর সঙ্গে দিন যাপনের অভিজ্ঞতা পেয়েছেন। বর্তমান সময়ের আলোচিত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের বন্ধু ও রুমমেট ছিলেন দেশের এই কৃতি সন্তান। ভারতের বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী জয়ন্ত নারলিকা ছিলেন তাঁর সহপাঠী। তাঁর বন্ধু ছিলেন নোবেলজয়ী ব্রায়েন জোসেফসন, আব্দুস সালাম, রিচার্ড ফাইনম্যানের মত বিজ্ঞানীরা। রিচার্ড ফাইনম্যানের সঙ্গে তাঁর খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো। তাঁকে একটা মেক্সিকান নকশী কাঁথা উপহার দিয়েছিলেন ফাইনম্যান।
বইসমূহ
১৯৮৩ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের লেখা ‘দি আলটিমেট ফেট অব দ্য ইউনিভার্স’ বইটি বের হয়। যা এখন পড়ানো হয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। জাপানি, ফরাসি, পর্তুগিজ, জার্মানসহ কয়েকটি ভাষায়ও বইটি অনূদিত হয়েছে। এছাড়া ক্লাসিক্যাল জেনারেল রিলেটিভিটি (১৯৮৪), রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি (১৯৮৪), অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি (১৯৯২), স্কাই অ্যান্ড টেলিস্কোপ, দ্যা ফার ফিউচার অব দ্য ইউনিভার্স (স্প্যনিশ ভাষায় অনূদিত), কৃষ্ণবিবর, মাতৃভাষা ও বিজ্ঞানচর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ, শিল্পসাহিত্য ও সমাজ তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
পুরস্কার ও সদস্যপদ
বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী ১৯৮৫ সালে জামাল নজরুল ইসলামকে স্বর্ণপদকে ভূষিত করে। ১৯৯৪ সালে তিনি ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি মেডেল পান। ১৯৯৮ সালে ইতালির আব্দুস সালাম সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্সে থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমী অব সায়েন্স অনুষ্ঠানে তাঁকে মেডাল লেকচার পদক দেওয়া হয়। তিনি ২০০০ সালে কাজী মাহবুবুল্লাহ ও জেবুন্নেছা পদক পান। ২০০১ সালে লাভ করেন একুশে পদক। ২০১১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে অবদান রাখার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজ্জাক-শামসুন আজীবন সম্মাননা পদক পান।
এছাড়া তিনি বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি, রয়েল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি, কেমব্রিজ ফিলোসফিক্যাল সোসাইটি, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স, বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশের সদস্য ছিলেন।
প্রস্থান
এই বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ চট্টগ্রামে ৭৪ বছর বয়সে মারা যান। আজকের দিনটিতে বাংলাদেশের মত ছোট একটি দেশ শুধু একজন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীকে হারায়নি হারিয়েছে উজ্জ্বল নক্ষত্র।
বাংলাদেশের ইতিহাসে বিজ্ঞানীর সংখ্যা একদমই কম। তবুও সত্যেন বোস, জগদীশচন্দ্র বসু, মাকসুদুল আলমের মত নামকরা বিজ্ঞানী জন্মেছেন এখানে। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যে মৌলিক বিজ্ঞানে তাঁর মতো অবদান আর কারও নেই। তেমনি বিশ্ববিজ্ঞানের সারস্বত সমাজে তাঁর মতো সমাদর ও খ্যাতিও কারো ছিল না।
এসইউ/পিআর