ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

নারীকে নারী ভাবার আগে মানুষ ভাবতে হবে : ইফরীত জাহিন কুঞ্জ

মাহবুবর রহমান সুমন | প্রকাশিত: ১২:৩৯ পিএম, ০৮ মার্চ ২০১৭

জীবনের একটা পর্যায়ে এসে নির্যাতনের শিকার হয়ে ভেবেছিলেন আত্মহত্যা করবেন। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে যখন আত্মহত্যা করতে গেলেন; তখন চিন্তা করে দেখলেন তিনি যদি চলে যান, তাহলে তার সঙ্গে যা ঘটেছে তা অন্য মেয়েদের সঙ্গেও ঘটবে। তিনি আত্মহত্যা করলে হেরে যাবেন। দোষিরা জিতে যাবে, তাদের ক্ষমতা আরো বেড়ে যাবে। তারপর নিজের সিদ্ধান্ত বদলে নির্যাতিত নারীদের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। যার কথা বলছিলাম, তিনি জাস্টিস ফর উইমেন ইন বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ইফরীত জাহিন কুঞ্জ।

নারী অধিকার ও সাইবার ক্রাইম নিয়ে কাজ করে বেশ আলোচিত ব্যক্তি তিনি। সাধারণ মানুষকে তিনি আইনি সহায়তা দেন। বিশেষ করে নারীদের। যারা লজ্জায়, সমাজের ভয়ে বা পারিবারিক চাপে যৌন নির্যাতন, নিপীড়ন বা সাইবার অপরাধের শিকার হয়েও চুপচাপ দিন কাটাচ্ছেন। তাদের নিয়ে কাজ করতেই কয়েকজন বন্ধুর সহযোগিতায় ২০১৫ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেন জাস্টিস ফর উইমেন ইন বাংলাদেশ। দুই বছর ধরে নির্যাতনের শিকার নারীদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। দুই বছরের এই পথচলায় প্রায় ৪শ’র মতো মামলায় জয় লাভ করেছে তার সংগঠনটি। হাতে আছে আরো শতাধিক মামলা।

বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষে জাগো নিউজের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতার চুম্বক অংশ জানাচ্ছেন মাহবুবর রহমান সুমন

kunjo

জাগো নিউজ : ‘জাস্টিস ফর উইমেন ইন বাংলাদেশ`র শুরুর গল্পটা শুনতে চাই-
ইফরীত জাহিন কুঞ্জ : ছোটবেলায় নিজে সাইবার হ্যারেসমেন্টের শিকার হয়েছিলাম। ছোটবেলা থেকে বড় হই দেশের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে। কড়া নিরাপত্তার পরিবেশে থাকার পরেও চাইল্ড মোলেস্টের শিকার ছিলাম কোচিংয়ের শিক্ষক দ্বারা। অনেক বড় হয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পারি। তারপর থেকে কিছুটা মানসিকভাবে অস্বাভাবিক হয়ে যাই। মেনে নিতে পারছিলাম না কিছুই। বাবা-মার সঙ্গেও শেয়ার করতে পারতাম না। আত্মীয়দের মধ্যেও প্রচুর পরিমাণে নারী নির্যাতন দেখতাম। এইসব নানাবিধ কারণ থেকেই একটা পর্যায়ে এসে সিদ্ধান্ত নেই যে, বড় হয়ে একজন সমাজসেবক হবো।

এরপর একদিন মেডিকেলে পড়ার জন্য ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের একটা গ্রামে পাড়ি জমাই। সেখানেও দেখি, অনেক গরিব নারী চিকিৎসা নিতে আসছে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়ে। কিন্তু সমাজের ভয়ে, অর্থাভাবে এবং পুলিশ সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাবে তারা সহজে প্রতিকারের জন্য এগোতে চাইতো না। তাছাড়া ওই সময় আরো একটা নতুন জিনিস আবিষ্কার করি, তাহলো নিরাপদ মাতৃত্বের প্রচণ্ড অভাব। এইসব কিছুর প্রতিকার খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করি- এটার কোনো প্রতিষেধক নেই। পরবর্তীতে কয়েকজন ডাক্তার, পুলিশ ও উকিল বন্ধুদের সহযোগিতায় জাস্টিস ফর উইমেন ইন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করি ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি। যার মাধ্যমে আমরা আজো অসহায় ও নির্যাতিতদের আইনি সহযোগিতা প্রদান করে যাচ্ছি।

জাগো নিউজ : শুরুর পর থেকে আজকের গল্পটা কী?
ইফরীত জাহিন কুঞ্জ : শুরুতেই সবাই টিটকারি দিতো, হাসাহাসি করত। প্রথম কেসটাই ছিলো বাড্ডায় ইভটিজারদের দৌরাত্ম্য নিয়ে। একটা মেয়ে সুইসাইড এটেম্পট নেয়। তার পরিবার কেস করতে ইচ্ছুক ছিলো না। তারা যথেষ্ট প্রমাণসহ আমাদের কাছে সাহায্যের জন্য আসেন। কিন্তু এই কেস কীভাবে সলভ করা যায় এটা নিয়ে পুলিশের সঙ্গে আমি কথা বলি। তারা নিজেরাই আবিষ্কার করেন ব্যাপারটা অন্যভাবে আগাতে। পরে পুলিশ একজন ফ্রেন্ডের সহায়তায় যখন বাড্ডায় রেড দেয়া হয় তখন মাদকসহ সেই ইভটিজার ধরা পড়ে। মেয়েটা এখন নিরাপদে সেখানে চলাফেরা করতে পারছে।

এরপর এরকম নানা ধরনের কেস আসতে থাকে। বাসে, ঘাটে হ্যারেসমেন্টের কেসসহ অনেক ঘটনা। কিন্তু আমার লক্ষ্য ছিলো সাইবার ক্রাইম নিয়েই কাজ করার। ধীরে ধীরে আমাদের এখানে সাইবার ক্রাইমের কেসের সংখ্যা বাড়তে থাকে। একটা পর্যায়ে আমাদেরকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় ডিএমপি, ডিবি, সিএমপি, এসএমপি ও সিআইডি। আমরা পুলিশকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা প্রদান করি, পুলিশও আমাদের সব কেস গুরুত্ব সহকারে সমাধানে এগিয়ে আসেন।

আমরা গত দুই বছরে প্রায় ৪শ’র মতো মামলার রায় আমাদের পক্ষে পেয়েছি। যেটা আমাদের ৯০% সাকসেস রেট। কোর্টে আরো ৪শ’র বেশি মামলার কার্যক্রম চলছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল গৃহ নির্যাতনের মামলা। এছাড়াও সাইবার ক্রাইম, সহকর্মী দ্বারা নিপীড়নের শিকার হওয়া, শিশু নির্যাতনের মামলাই বেশি থাকে। কিন্তু কাজ করতে এসে একটা জায়গায় আমি অবাক হয়েছি, পারিবারিকভাবেই অনেক মেয়েছেলে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এটা নিয়ে কাজ না করলে এই ব্যাপারে আমি জানতেই পারতাম না। আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ নিজগৃহে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এছাড়া চলতি বছরে ১শ’টিরও বেশি মামলা হয়েছে সংগঠনের পক্ষ থেকে।

kunjo

জাগো নিউজ : বাংলাদেশের নারীরা এখন তাদের অধিকার নিয়ে কতটা সচেতন বলে আপনি মনে করেন?
ইফরীত জাহিন কুঞ্জ : বাংলাদেশে এখন নারী দিবস উৎসবের মত। আমাদের দেশের প্রায় অনেক নারীই এই দিবস সম্পর্কে এখনো কোন স্পষ্ট ধারণা রাখে না। আমাদের দেশের নারীরা এখনো  তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে পারেনি। এখনো দেশের অনেক নারীই মনে করে, স্বামীর সঙ্গে সংসার করা মানেই সব সুখ। তাই আমাদের দেশে শুধু নারী দিবসে নয়, সচেতনতার লক্ষ্যে সারা দেশব্যাপী নারীদের নিয়ে কাজ করতে হবে। এছাড়া আমি মনে করি, আমাদের দেশ তখনই উন্নতি করবে; যখন দেশের অর্ধেক নারী ও অর্ধেক পুরুষ উভয়ই মানুষ হিসেবে সমাজের উন্নতির জন্য কাজ করবে। তাছাড়া আমাদের নারীকে নারী ভাবার আগে মানুষ ভাবতে হবে।

জাগো নিউজ : বাংলাদেশের নারীরা নিজেদের অবস্থার কতটা উন্নতি করতে পেরেছে?
ইফরীত জাহিন কুঞ্জ : আমি মনে করি, আমাদের দেশের নারীদের যতটা নিজেদের অবস্থার উন্নয়ন করা উচিত ছিলো তাতো করতে পারিনি। আমাদের দেশের নারীরা নিজেদের অবস্থান উন্নয়ন করার চেয়ে এখন বিদেশি টিভি সিরিয়াল নিয়ে ব্যস্ত। যার ভ্রান্ত ধারণা নারীর অবস্থা উন্নয়নের জন্য অন্যতম বাধা। আমাদের দেশের নারীরা যতদিন অন্যের উপর নির্ভর থাকার চেয়ে নিজে আয় করার জন্য গর্ববোধ করতে না শিখবে; ততদিন এই উন্নয়ন আশানুরূপ হবে না।

জাগো নিউজ : বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের বর্তমান পরিস্থিতি কেমন?
ইফরীত জাহিন কুঞ্জ : বাংলাদেশের প্রত্যেক নারীই নির্যাতনের শিকার হন। ছোটবেলা থেকে মেয়েরা হন পারিবারিক, যৌন, মানসিক- না হয় ইমোশোনাল নির্যাতনের শিকার। কোনো না কোনো ভাবেই তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে এসব নির্যাতন কিছুটা কমলেও আরো ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

জাগো নিউজ : আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
ইফরীত জাহিন কুঞ্জ : আমাদের মূল লক্ষ্য কয়েকটি বিষয়ে কাজ করা- নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, পুলিশের সঙ্গে মানুষের সেতুবন্ধন তৈরি করা, দেশের আপামর জনসাধারণের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা,  দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সৃষ্টি সর্বোপরি মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা।

kunjo

আমি কাজ করতে গিয়ে আবিষ্কার করি যে, আমরা যদি ছোটখাটো কিছু পন্থা অবলম্বন করি, তাহলে আমরা খুব সহজে এসবের প্রতিকার পেতে পারি। আমি চাচ্ছি- ভবিষ্যতে পৃথিবীব্যাপী সেমিনার করতে। ইতোমধ্যে এটা নিয়ে কাজও করছি। তাছাড়া আমি চাই- নানারকম অপরাধে জড়িতদের মনস্তত্ত্ব ও তাদের চিন্তা-ভাবনা পরিবর্তন করতে। এটা নিয়েও কাজ করছি। আশাকরি একদিন এ দেশের পুলিশ বাস্তবিক অর্থেই বসে বসে মাছি মারবে, জেলগুলো সব শূন্য থাকবে; কারণ তখন কোনো অপরাধীই থাকবে না জেলে ঢোকানোর মতো। কোনো নির্যাতনও হবে না। এছাড়া আমি চাই- একদিন মামলার অভাবে জাস্টিস ফর উইমেন ইন বাংলাদেশ বন্ধ হয়ে যাক। এটা চাইলেই সম্ভব। আমি সাহস করে যে পদক্ষেপ নিয়েছি, আশেপাশের সবাই যদি এগিয়ে আসে তাহলেই সমাজটা এরকম হবে। এছাড়া মেয়েদের জন্য শেল্টার হোম নির্মাণ করার ইচ্ছা আছে আমাদের।

জাগো নিউজ : নির্যাতনের বা হয়রানির শিকার নারীরা কীভাবে জাস্টিস ফর উইমেনের সহযোগিতা পেতে পারে?
ইফরীত জাহিন কুঞ্জ : তারা আমাদের ফেসবুক পেজ বা গ্রুপে যোগাযোগ করতে পারে। আমার সঙ্গে সরাসরি বা মোবাইলে যোগাযোগ করতে পারে। এছাড়া আমাদের অফিসের নম্বরে বা সরাসরি অফিসে যোগাযোগ করতে পারে।

জাগো নিউজ : জাগো নিউজকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ইফরীত জাহিন কুঞ্জ : জাগো নিউজ এবং আপনাকেও ধন্যবাদ।

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন