ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

মিউজিক্যাল লিজেন্ড এ আর রহমান

মাহবুবর রহমান সুমন | প্রকাশিত: ১১:৩২ এএম, ০৭ জানুয়ারি ২০১৭

আল্লাহ রাখা রহমান নামের কাউকে চেনেন? নাও চিনতে পারেন! কিন্তু এ আর রহমানকে নিশ্চয়ই চেনেন। হ্যাঁ, মিউজিক্যাল লিজেন্ড এ আর রহমানের কথাই বলছি। ৮১তম অস্কারের মিউজিক ক্যাটাগরিতে ডাবল অস্কার বিজয়ী  ভারতীয় এই মিউজিশিয়ান প্রথমে কি-বোর্ড প্লেয়ার হিসেবে কাজ শুরু করেন। এক সময় ড্রাইভার হওয়ারও চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন। মাত্র নয় বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে সংসারের হাল ধরেও সংগীত জগতে ঝড় তুলেছেন তিনি। যার সুরে কোটি প্রাণে ছড়ায় মুগ্ধতা, ছুঁয়ে যায় মন।

সুরসম্রাট এ আর রহমান গত ৬ জানুয়ারি ৫০ বছরে পা রেখেছেন। সুরের এই জাদুকরকে নিয়ে জাগো নিউজের আজকের আয়োজন। বিস্তারিত জানাচ্ছেন মাহবুবর রহমান সুমন।

পরিচিতি
Rahman
এ আর রহমানের পুরো নাম আল্লাহ রাখা রহমান। তিনি ১৯৬৭ সালের ৬ জানুয়ারি ভারতের মাদ্রাজে ঐতিহ্যবাহী মুদালিয়ার তামিল সংগীত অন্তঃপ্রাণ এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পর তার নাম রাখা হয়েছিল এ এস দিলীপ কুমার। পরে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তার বাবা আর কে শেখর ছিলেন একজন সংগীত পরিচালক। তিনি তামিল ও মালায়লাম চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করতেন। তার মায়ের নাম কস্তুরি (মুসলিম হওয়ার পর করিমা বেগম)।

এ আর রহমান ভারতের বলিউড ও কলিউডের (তামিল) জনপ্রিয় সংগীত পরিচালক। তিনি প্রচুর হিন্দি এবং দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেছেন। কি-বোর্ড, পিয়ানো, সিনথেসাইজার, হারমোনিয়াম এবং গিটারসহ বেশকিছু সংগীত যন্ত্রে তার রয়েছে অসাধারণ দক্ষতা। তবে বিশেষ করে সিনথেসাইজারে তার অন্যরকম আসক্তি। সংগীতে তার আদর্শ হলো- পূর্ব, পশ্চিম, আফ্রিকাসহ সব ধরনের সংগীত ধারা এবং প্রযুক্তির সমন্বয়। তিনি ১৯৯৫ সালের ১২ মার্চ সায়রা বানুর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের তিন সন্তান- খাদিজাহ, রহিমা ও আমান।

সংগীতে হাতেখড়ি
Rahman
সংগীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করার ফলে পরিবার থেকেই সংগীতের হাতেখড়ি হয়েছে রহমানের। বাবার সঙ্গে বিভিন্ন রেকর্ডিং স্টুডিওতে যাতায়াত ছিল ছোট্ট রহমানের। সেই সময় তার বাবা যখন রেকর্ডিং নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন তখন তিনি কি-বোর্ড নাড়াচাড়া করতেন। এভাবেই আস্তে আস্তে সংগীতের হাতেখড়ি হয় তার। এছাড়া মাত্র চার বছর বয়সেই হারমোনিয়াম বাজানো রপ্ত করে ফেলেছিলেন তিনি। আর ১১ বছর বয়সে বাবার বন্ধু মালায়লাম কম্পোজার এম কে অর্জুনানের অর্কেস্ট্রা বাজানোর সুযোগ পান। খুব তাড়াতাড়িই সে সময়ের প্রখ্যাত মিউজিশিয়ানদের সঙ্গে বাজানোর অভিজ্ঞতা হয়। এমনকী জাকির হোসেন, কুন্নাকুদি বিদ্যানাথান এবং এল শঙ্করের সঙ্গে বিদেশে বেশক’টি ট্যুরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল তার। এছাড়া ছোটবেলায় বন্ধু মিউজিশিয়ান শিবামানির সঙ্গে জন অ্যান্থনি, সুরেশ পিটার, জোজো এবং রাজাকে নিয়ে ‘রুট’ নামে একটি ব্যান্ড দল গঠন করেন। চেন্নাইয়ের রক ব্যান্ড ‘নেমেসিস অ্যাভেনিউ’র প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। তবে ছোটবেলায় তিনি হতে চেয়েছিলেন ইলেকট্রনিক্স অথবা কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার।

ছন্দপতন
Rahaman

মাত্র ৯ বছর বয়সে রহমানের বাবা মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর অভিভাবকহীন হওয়ার পাশাপাশি সংসারে আর্থিক সমস্যা দেখা দেয়। সে সময় তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে ভূমিকা পালন করে বাবার সংগীত যন্ত্রগুলো। এই যন্ত্রগুলো ভাড়া দিয়েই পরবর্তীতে বেশ কিছুদিন তাদের সংসার চলে। সংসারের শত দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও তার সংগীতচর্চা থেমে থাকেনি। বাবার মৃত্যুর পর দক্ষিণ ভারতের সেরা কম্পোজার ইলাইয়ারাজা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে রহমানকে তার কি-বোর্ডিস্ট হিসেবে কাজ করার সুযোগ দেন। সে সময় ইলাইয়ারাজার টিমের লিড কি-বোর্ড প্লেয়ার ভিজি ম্যানুয়াল তাকে জিঙ্গেলে (বিজ্ঞাপনের মিউজিক) ক্যারিয়ার আরম্ভ করার পরামর্শ দেন। তখন তিনি বিষয়টি সিরিয়াসলি নেন এবং ভেবে রাখেন যে, এ লাইনে সফল না হলে ড্রাইভিং শিখবেন এবং একজন ড্রাইভার হিসেবে অর্থোপার্জনের পথ বেছে নেবেন।

পড়ালেখা ও সংগীত শিক্ষা
বাবার মৃত্যুর সময় রহমান পদ্মা শেষাদ্রি বাল ভবন স্কুলে নবম স্ট্যান্ডার্ডে পড়তেন। বাবার মৃত্যুতে সংসারের দুর্দশার কারণে বেশিরভাগ সময়ই তিনি ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতেন। স্কুল কর্তৃপক্ষের কঠোরতার কারণে তাকে স্কুল ছেড়ে মাদ্রা ক্রিশ্চিয়ান স্কুলে যেতে হয়। সেখানেও তিনি বেশিদিন লেখাপড়া করতে পারেননি। ১১তম স্ট্যান্ডার্ডে এসে ওই কলেজও ছেড়ে দেন তিনি। এরপর সংগীতের জন্য কয়েকটি বিদেশি ট্যুরের পর লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজে স্কলারশিপ পান। ওই কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পর পশ্চিমা সংগীতের ওপর ডিপ্লোমা করেন রহমান।

দিলীপ থেকে রহমান
Rahman

১৯৮৪ সালে রহমানের ছোট বোন (এ আর রেহানা) প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেক চিকিৎসক এবং কবিরাজ দেখানোর পরও তিনি সুস্থ হচ্ছিলেন না। এই পরিস্থিতিতে তার মা আজমীর শরীফে মানত করেন। ১৯৮৮ সালে আল্লাহর রহমতে একজন মুসলিম পীরের সাহায্যে তার অসুস্থ বোন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে উঠলে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস আসে এবং সপরিবারে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এসময় তার নাম রাখা হয় আল্লাহ রাখা রহমান বা সংক্ষেপে এ আর রহমান।

সফলতার শুরু
১৯৮৭ সালে রহমান আলৌইন শীর্ষক একটি জিঙ্গেল কম্পোজের সুযোগ পান যা অনেক বেশি মানুষের কাছে পরিচিতি পেতে সহায়তা করে। তখনই তিনি পরিচালক মনি রত্নমের নজরে আসেন। রত্নম তার তামিল ‘রোজা’ চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনার সুযোগ দেন রহমানকে। এরপর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি এ আর রহমানকে। রোজা নির্মাণের সময়ই চিত্রনাট্যকার সন্তোষ শিবান মালায়লাম চলচ্চিত্র ‘যোধা’তে এ আর রহমানকে চুক্তিবদ্ধ করেন। এটি মুক্তি পায় ১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বরে। চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাওয়ার পরই জীবনের মোড় ঘুরে যায় এ আর রহমানের। ‘রোজা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জয় করেন ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডে সেরা সংগীত পরিচালকের পুরস্কার।

এরপর ১৯৯২ সালে তিনি নিজ বাড়িতেই ‘পঞ্চাখান রেকর্ড ইন’ নামে একটি রেকর্ড ও মিক্সিং স্টুডিও চালু করেন। শুরুর দিকে তিনি বিভিন্ন তথ্যচিত্র, বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল, ভারতীয় টিভি চ্যানেলের বিজ্ঞাপন এবং কিছু প্রকল্প নিয়ে কাজ করতেন। স্টুডিওটি এত দ্রুত পরিচিতি পাবে তা এ আর রহমানও ভাবেননি। ভারতের গণ্ডি ছাড়িয়ে এশিয়ার অন্যতম একটি রেকর্ডিং স্টুডিও হিসেবে এটি পরিচিতি পায়। তবে ২০০৬ সালে তার রেকর্ডিং স্টুডিওর নাম বদলে রাখেন এ এম স্টুডিও।

অন্য এ আর রহমান
Rahman

শুধু সিনেমায় মিউজিক কম্পোজিশনের মধ্যেই তিনি নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। নিজেকে দেখিয়েছেন বহুরূপে। ১৯৯৭ সালে উপহার দিয়েছেন ‘বন্দে মাতরম’র মতো মাইলস্টোন অ্যালবাম। এই অ্যালবামটি শুধু ভারতে তখন বিক্রি হয়েছিল ১.২ কোটি পিস। চলচ্চিত্রের বাইরে কোনো অ্যালবাম ভারতে এটি প্রথম এতোটা ব্যবসাসফল হয়। এছাড়া তিনি ভারতের ধ্রুপদ সংগীত নিয়ে ‘জন গণ মন’ মিউজিক ভিডিও বের করেন যাতে ভারতের সেরা শিল্পীরা পারফর্ম করেন। ১৯৯৯ সালে জার্মানির মিউনিখে মাইকেল জ্যাকসনের কনসার্টে কোরিওগ্রাফার শোবানা এবং প্রভুদেবার সঙ্গে কাজ করেছেন রহমান।

অন্যদিকে ২০০৯ সালের ২৪ নভেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে হোয়াইট হাউসে কনসার্ট করেছেন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমন্ত্রণে ডিনারে অংশ নেন। তাছাড়া ২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য ‘স্লামডগ মিলিয়নেয়ার’র পরিচালক ড্যানি বয়েলের আয়োজনে একটি পাঞ্জাবি গানের কম্পোজিশন করে দেন। শুধু তাই নয়, ২০১২ সালে ডিসেম্বরে শেখর কাপুরের সঙ্গে মিলে ‘কিয়ুকি’ নামে একটি সোশ্যাল ওয়েবসাইট তৈরি করেন। এত কিছুর মধ্যেও মানবতার জন্য কাজ করে চলেছেন এ মিউজিশিয়ান। ২০০৪ সালে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের স্টপ টিবি প্রজেক্টের গ্লোবাল অ্যাম্বাসেডর হয়েছিলেন তিনি। ২০০৪ সালে সুনামি আক্রান্ত এতিম শিশুদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এবং চেন্নাইয়ের উদ্বাস্তু নারীদের নিয়ে নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা ‘দ্য বেনিয়ান’র জন্য থিম সং কম্পোজ করেন।

পুরস্কার
এ আর রহমানের পুরস্কারগুলোর মধ্যে রয়েছে- দু’টি অস্কার, বাফটা পুরস্কার, গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড, চারটি ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড এবং ১৩টি ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য- মাত্র ২০ দিনে সংগীত তৈরি করা সিনেমা স্লামডগ মিলিয়নেয়ার তাকে পৌঁছে দিয়েছে সম্মানের শীর্ষে। এ সিনেমার জন্যই তিনি জিতেছেন দু’টি অস্কার ও একটি করে গোল্ডেন গ্লোব ও বাফটা অ্যাওয়ার্ড। তবে মজার ব্যাপার হল, তিনি প্রথমে এই ছবির কাজটি করতে চাননি।

উপাধি
ar_next

তার কাজের জন্য তাকে ‘মাদ্রাজের মোজার্ট’ বলা হয়। তামিল ভক্তরা তাকে ‘মিউজিকের ঝড়’ বা ‘সংগীতের ঝড়’ উপাধিতে ভূষিত করেন। অন্যদিকে ২০০৯ সালে ‘টাইমস ম্যাগাজিন’ তাকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। ২০১১ সালে লন্ডনের ওয়ার্ল্ড মিউজিক ম্যাগাজিনে তাকে ‘ভবিষ্যৎ পৃথিবীর মিউজিক আইকনদের মধ্যে একজন’ বলে অভিহিত করা হয়। এছাড়া তিনিই প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র ভারতীয়; যিনি দু’টি অস্কার জিতেছেন।

যুগ যুগ বেঁচে থাকুন এ আর রহমান। বেঁচে থাকুন তার সংগীতে। মানুষের অন্তরে চিরদিন বেজে উঠুক তার সুরের অমীয়ধারা। নিরন্তর শুভকামনা তার জন্য। উইকিপিডিয়া

এসইউ/আরআইপি

আরও পড়ুন