জীবনের সব কাজই অসমাপ্ত থেকে যায় : ক্যাথরিন
শেরিফ আল সায়ার
১৩ আগস্ট, ২০১১। দুপুরের দিকে একটি অনলাইন পত্রিকায় দেখি “সড়ক দুর্ঘটনায় মিশুক মুনির-তারেক মাসুদ নিহত”। এই দুজন মানুষকেই সামনাসামনি দেখিনি। কথা হওয়া তো অনেক পরের কথা। মিশুক মুনীরকে চিনতাম এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী হওয়ার পর থেকে। তারেক মাসুদের সঙ্গে অবশ্য অনেক আগেই ‘মুক্তির গান’ ছবি দিয়ে পরিচয়।
বছর খানেক পর তারেক মাসুদের বাসায় গেলাম। কখনও ভাবিওনি তার বাসায় যাওয়া হবে। তাও আবার যখন তিনি এ পৃথিবীতে নেই। আধো আলোতে ভরা ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলাম আমি ও বন্ধু আরমান। ক্যাথরিন তখন ফোনে কথা বলছিলেন। আমাদের দেখে ফোন কানে নিয়েই মুচকি হাসলেন। কিছুক্ষণ পরেই টিভি সাংবাদিকরা আসা শুরু করলো। তাদের কাছে ইন্টারভিউ দেওয়ার আগে বলছিলেন, একসঙ্গেই নিয়ে নেন। আরমান বলল, না অসুবিধা নেই। আমরা অপেক্ষা করছি।
অপেক্ষার পালা শেষ হলো ঘণ্টাখানেক পরে। আমরা বসলাম সামনা সামনি। কথা হলো। সাংবাদিক উদিসা ইমন আপাও ছিলেন। সেখানে যাওয়ার আগের রাত তারেক মাসুদকে নিয়ে পড়াশোনা করে গিয়েছিলাম। তার লেখা বই, পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে দেওয়া ইন্টারভিউ। এমনকি মুক্তির গান ও মাটির ময়নাও দেখে গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য একটাই সাক্ষাৎকারটা যাতে ঠিক মতো নিতে পারি। তারেক মাসুদকে বোঝার চেষ্টাও ছিল।
একজন মানুষকে কখনও বোঝা সম্ভব হয় না। শুধু তার কাজের মধ্যে মানুষটার ভালোবাসার ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। অনুভব করা যায়।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ। দুরন্ত গতিতে যখন তারেক মাসুদ তার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক সেই মুহূর্তে ঘটে যায় মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনা। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের অদূরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী মিশুক মুনীরসহ ৫ জন।
তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ একজন মার্কিন নাগরিক। দীর্ঘদিন ধরে তারেক ও ক্যাথরিন একসঙ্গে বাংলা চলচ্চিত্রকে ভিন্ন দিশায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। আজ তারেক মাসুদ নেই। কিন্তু তার জীবনসঙ্গী ক্যাথরিন মাসুদ এখনও তারেকের স্বপ্নপূরণের পথে হেঁটে চলছেন। তারেকের প্রতিটি অসমাপ্ত কাজকে তিনি সমাপ্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সে সময় ক্যাথরিন মাসুদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ তার বিভিন্ন কাজ ও তারেক মাসুদকে নিয়ে আলোচনা হয়। আমার সঙ্গে ছিলেন আরিফুল ইসলাম আরমান
আমি যতটুকু জানি আদম সুরতের সম্পাদনার টেবিল থেকে আপনার কাজের শুরু। ফিল্ম বিষয়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া কাজটা কীভাবে করলেন?
কাজ করতে করতে শিখেছি। তারেকও কিন্তু তাই। তারেকেরও ফিল্ম স্কুলিং ছিল না। আমরা সব সময় বলি, কাজ করতে করতেই শেখা যায়। তবে তারেক তো আগে থেকেই চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করছিল।
তারেক আদম সুরত নিয়ে কাজ করছিল। বলতে হয় কাজটা শেষ পর্যায়ে। আমি আসলে শেষ পর্যায়ে সেই টিমের সঙ্গে কাজ শুরু করি।
চূড়ান্ত সম্পাদনার কাজের সময় ছিলাম। তার আগে নজরুল ইসলাম নামে একজন সম্পাদনার কাজ করছিলেন। তিনিই আসলে মূল কাজটি করেছিলেন। একদিক থেকে তিনিই (নজরুল ইসলাম) আমার শিক্ষক। তার পেছনে বসে বসে আমি দেখতাম কাজটা কীভাবে করে। এভাবেই সম্পাদনার কাজটা আমি শিখতে শুরু করলাম।
আমরা দুজনই কাজ করতে করতে শিখেছি। তবে আমরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতাম যে, আমাদের শেখার কোনো শেষ নেই। আজ, এখনও শিখছি। এবং আমার জীবনের শেষ পর্যন্ত আমি শিখে যাবো।
চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহটা কি সেখান থেকেই শুরু?
আসলে কাজ করতে গিয়ে আমি যখন স্টুডিওগুলোতে যেতাম। তখন দেখতাম ফিল্মের স্ট্রিপগুলো হ্যাং করছে। সিলিং থেকে, ওয়াল থেকে ফ্লোরে পড়ে আছে। ওগুলো দেখে আমি রোমাঞ্চবোধ করতাম। আমার ভেতর আগ্রহ তৈরি হতে থাকলো। চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করার আগ্রহটা তখন থেকেই শুরু। আমি দেখতাম সারাক্ষণ একটা হৈচৈ। এই হৈচৈ মধ্যে দিয়েও সৃজনশীল কাজ বের হয়ে আসতে পারে। সেটা ভেবেই আগ্রহ পেতাম।
এক সাক্ষাৎকারে তারেক মাসুদ বলেছিলেন, ‘সুলতানকে নিয়ে মুভি করতে এসে আমি তখনো ভাবিনি, আমার পেশা হবে চলচ্চিত্র নির্মাণ।’ আপনারও সেরকমই কিছু হয়েছিল? আপনি কি ভেবেছিলেন একদিন চলচ্চিত্র নির্মাতা হবেন?
আসলে কি, প্রতিটা কাজের পরই আগ্রহ জন্মে। একটি কাজ যখন শেষ হয় তখন মনের ভেতর একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। মনে হয় যে, আমি সামনে এই বিষয়টি নিয়ে এগিয়ে যেতে পারবো।
কাজ করতে করতে আমরা দুজনই চিন্তা করলাম যে, এই বিষয়টি নিয়ে কিভাবে ধারণ করে এগিয়ে যাওয়া যায়। তারপরও আমি জানি না যে এখনও আমি কিছু করতে পেরেছি। আমি মনে করি এখনও অনেক কিছু শেখার আছে। অনেক কিছু করার আছে। আসলে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমরা কাজ করে যেতে চেয়েছি। আমিও শেষ জীবন পর্যন্ত কাজ করে যেতে চাই।
সত্যি কথা হলো, শেষ জীবন পর্যন্ত প্রতিটি মানুষের কাজ অসমাপ্ত থেকে যায়। আমরা শুধুমাত্র কিছু করার চেষ্টা করি। এর বেশি কিছু নয়। কোনো কাজই আসলে পুরোপুরি শেষ হয় না। একটি কাজ শেষ করার পরই মনে হতে থাকে, না আরও কিছু করতে পারতাম। আরও কিছু করার আছে। সেজন্যই বললাম, সব কাজ অসমাপ্ত থাকে। তারেকের ক্ষেত্রেও তাই। তারও অনেক কিছু করার ছিল। অনেক স্বপ্ন ছিল। তাই এখন আমরা তার স্বপ্ন বা তার অসমাপ্ত কাজগুলো যতটুকু পারি শেষ করার চেষ্টাই আমরা করবো। তবে আপনার উত্তরটা ঠিক মতো দিতে পেরেছি কিনা জানি না। এক কথায় বলতে হয়, আমরা ভাবিনি যে চলচ্চিত্র নির্মাণটাই পেশা হবে। তবে আমরা এক একটি কাজ শেষ করে এগিয়ে যাবো এটা জানতাম।
এবার ‘মুক্তির গানে’র প্রসঙ্গে আসতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের ফুটেজগুলো লিয়ার লেভিনের কাছ থেকে নেওয়া। যুক্তরাষ্ট্রে লিয়ার লেভিনের সঙ্গে পরিচয়ের গল্পটি একটু বলবেন?
শুরুটা হয়েছিল আমার ভাইয়ের মাধ্যমে। আমার ভাই প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করতেন। একদিন তিনি ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস দিয়ে যাচ্ছেন; তখন একজন সাউথ এশিয়ান মেয়ে তাকে প্রশ্ন করলো, ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টটা কোন দিকে।
আমার ভাই ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টেরই শিক্ষক ছিলেন। সেই সূত্রেই সেই মেয়েটির সঙ্গে তার আলাপ হয়। আমার ভাই খুব কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার দেশ কোথায়?’ সে তখন বলল, ‘বাংলাদেশ’। আমার ভাই তখন এক্সাইটেড হয়ে বলল, ‘ও! তাই? আমার বোনের বিয়ে হয়েছে বাংলাদেশে।’ এভাবেই ওই মেয়েটার সঙ্গে পরিচয় হলো।
কথা বলতে বলতে দেখা গেল যে, সে তো তারেকের খুবই ঘনিষ্ঠ। তিনি হচ্ছেন মিলিয়া আলী। তারেক আলীর স্ত্রী। তারেক আলী হচ্ছেন মুক্তির গানে মোটা চশমা পরা যেই মানুষটি ছিলেন তিনি।
তখন আমি এবং তারেক নিউইয়র্কে থাকতাম। পরের সপ্তাহে আমরা প্রিন্সটনে আসলাম। সেখানে একটা অনুষ্ঠানে গেলাম। আমরা জানতামও না যে সেখানে তারেক আলী এবং মিলিয়া আলী আছেন। সেই অনুষ্ঠানে আড্ডা দিতে দিতে তারেক আলী আমাদের জানালেন, লিয়ার লেভিন নামে একজন আছেন। যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের কিছু দৃশ্য ধারণ করেছিলেন। শুটিং করেছিলেন। এখনও তিনি নিউইয়র্কে আছেন কিনা সেটা অবশ্য তিনি জানেন না।
যদিও তিনি জানতেন না আসলে কি ধরনের কাজ লিয়ার লেভিন করেছিলেন। কারণ অল্প কিছু সময় তিনি এই দলটির সঙ্গে ছিলেন। তারপরও তারেক আলী বললেন, হয়ত তার কাছে ফুটেজ পাওয়া যেতে পারে। একইসঙ্গে বললেন, তোমরা তাকে খুঁজে দেখতে পারো। তিনি জীবিত আছেন কিনা তাও জানি না।
আমাদের তখন আগ্রহ তৈরি হলো। যদিও লিয়ার লেভিন সম্পর্কে তারেক কিছু কিছু জানতেন। তার কথা তারেক শুনেছে বেণু ভাইয়ের কাছ থেকে। মাহমুদুর রহমান বেণু। তিনি তারেকের চাচাতো ভাই। কিন্তু যখন শুনেছে তখন তারেক অনেক ছোট ছিল। তাই লিয়ারের কথা সে ভুলেই গিয়েছিল।
তো, তারপর আমরা লিয়ার লেভিনকে খুঁজে বের করলাম। তখন তো ইন্টারনেট ছিল না। টেলিফোনের বই থেকে তার ফোন নম্বর সংগ্রহ করলাম। আমরা ফোন করলাম। তারেক কথা বলল। বেণু ভাইয়ের ছোট ভাই হিসেবে নিজের পরিচয় দিলো।
তারেক বলল, ‘আমার ভাইয়ের নাম মাহমুদুর রহমান বেণু। আমি বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করি। আপাতত আমি নিউইয়র্কে আছি। আমরা শুনেছি আপনার কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কিছু ফুটেজ আছে। এই বিষয়টি নিয়ে আমি আগ্রহী।’
লিয়ার লেভিন অত্যন্ত খুশী হলেন এবং বললেন, গত বিশ বছর ধরে আমি এই ফোন কলটির জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
এরপর পরিচয় হলো। আমরা ওনার ফুটেজগুলো দেখলাম। ফুটেজগুলো দেখার সময় আমরা অবাক হচ্ছিলাম। এতো অসাধারণ সব ফুটেজ। এরপর তো কাজ শুরু করলাম। নিউইয়র্ক বসেই মুক্তির গানের কাজ শুরু করলাম।
সম্পাদনার টেবিলে সবসময় পরিচালক-সম্পাদকের মধ্যে ফুটেজ সিলেকশনে মতবিরোধ হয়। মুক্তির গানের ফুটেজ সিলেকশনের সময় আপনাদের কি এমনটি হয়েছে কখনও?
তখন তো সম্পাদক-পরিচালক সম্পর্কটা গড়ে ওঠেনি। আমরা দুজনই একসঙ্গে মুক্তির গানের কাজ করেছি। তবে হ্যাঁ, কাজটি করতে গিয়ে দ্বিমত হয়েছে। আসলে এটি সৃজনশীল কাজের একটি অংশ। দ্বন্দ্ব থাকবে, দ্বিমত তৈরি হবে। কিন্তু এগুলো আমরা আলোচনা করে ঠিক করে নিতাম। বিভাজন তৈরি হবেই। সেটা আবার আলোচনা করে পথটা আমরাই বের করে নিতাম। এই ছবিটি করতে চার বছর সময় লেগেছে। সুতরাং অনেক ইতিহাস আছে এর পেছনে। খুব সহজেই হয়নি।
মুক্তির গানের পরবর্তী যে প্রডাকশনগুলো হয়েছে; সে সম্পর্কে তারেক মাসুদ সবসময় নিজের টিম সম্পর্কে বলতেন, তাদের কাছে তিনি খুবই ডিমান্ডিং।
এটা আসলে প্রফেশনালিজম। আমরা দুজনই এমন। হয়ত এটা প্রকাশ পেত ভিন্নভাবে। তারেক সবসময় সামনের সারিতে থাকতো। আমি পেছনের জায়গাগুলোতে কাজ করতাম। কিন্তু এ বিষয়ে কী বলবো আমি জানি না। এতটুকু বলতে পারি যে, তারেক মাসুদ একটি সিনেমা তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিটি বিষয়ে নজর রাখতো। সিনেমা কিন্তু পুরো একটি টিমের কাজ। একজন প্রডাকশন বয় থেকে শুরু করে ড্রাইভার পর্যন্ত প্রত্যেকের গুরুত্ব আছে। প্রত্যেকের ভূমিকা আছে। সেখানে প্রতিটা বিষয়ই দেখতে হয়। কোনো কিছুই বাদ পড়ে না। তাই সবার কাজের দিকে আমাদের নজর রাখতে হয়। সেখানে ডিমান্ডিং না হয়ে উপায় নেই। প্রতিটি কাজের সেরাটা আদায় করতেই হবে। তাও কিন্তু আমরা বলতাম, যে লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাজ শুরু করতাম। সেটা যদি ৪০ ভাগ হয় সেটাই অনেক বড় পাওয়া।
এবার ফিল্ম স্কুলিং বিষয়ে আসি। বাংলাদেশে এখনও সেভাবে স্কুলিং গড়ে ওঠেনি। তরুণ নির্মাতাদের নিয়ে কিংবা ছবি বানাতে আগ্রহী এই বিষয়েও তারেক মাসুদ বহুবার কথা বলেছেন। এখন আপনি কি নতুন কোনো উদ্যোগ তরুণদের জন্য নেবেন?
একদমই স্কুলিং তৈরি হচ্ছে না এটা বলবো না। হয়েছে। এখন তো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ফিল্মের উপর ডিগ্রি দেওয়া শুরু করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ফিল্ম নিয়ে প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে। গত পাঁচ বছরে অনেক কিছু হয়েছে। সামনে এটি এগিয়ে যাবে।
তবে যেটা প্রয়োজন রয়েছে সেটা হলো সবকিছু মিলিয়ে; যেমন: মিডিয়া, টেলিভিশন মিডিয়া, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, ফিল্ম এই সবকিছু মিলিয়ে একটি পূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শুধু ফিল্ম নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এখন দরকার। নতুন প্রজন্ম যারা কাজ করতে চায় তাদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা আমাদের করতেই হবে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এখন এগিয়ে আসছে। কিন্তু প্রয়োজন বিচ্ছিন্নভাবে না করে একটা ঘরের ভেতর সব নিয়ে আসা। এটা অবশ্য একদিনে হবে না। শুরু হয়েছে, ভবিষ্যতে হয়তো ধীরে ধীরে হবে। চলচ্চিত্র জগতটা যেহেতু অনেক বড় তাই আমাদের চিন্তাটা করতে হবে বড়। আমরা তো অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছি। তবে সরকারিভাবে এগিয়ে না আসলে বেসরকারিভাবে খুব একটা এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।
এটা তো গেল শিক্ষার বিষয়ে। কিন্তু একজন তরুণ নির্মাতা চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করবে কিসের উপর ভর করে? যেখানে বাংলাদেশে সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ কি?
এই জায়গায় আমরা অনেক কাজ করেছি। বিশেষ করে তারেক ‘সিনেমা হল বাঁচাও আন্দোলন’ চালিয়েছিল। তার শেষ জীবনের এক বছর এই আন্দোলনটি জোরালোভাবে করে গেছেন। আমাদের রানওয়ে ছবিটি সারাদেশে চলার সময় আমরাও সারাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছি। তখন আমরা সিনেমা হলগুলোতে গিয়ে মূল সমস্যাগুলো বের করার চেষ্টা করেছি। সমস্যা বের করে আমরা একটি প্রস্তাবনাও তৈরি করেছিলাম। তারেক মারা যাওয়ার পরও আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি।
এখন যেটা হলো যে, গত এপ্রিল মাসে চলচ্চিত্রকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আমাদের মূল দাবি এটিই ছিল। আমার মনে হয় এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আস্তে আস্তে পরিবর্তন আসবে।
শিল্প মাধ্যম হিসেবে এখন সিনেমা হলগুলো কিছু ট্যাক্সের সুবিধা পাবে। নতুন হল তৈরি এবং হলগুলোকে আধুনিকায়ন করার জন্য তারা ব্যাংকের সহযোগিতা পাবে। এমনকি চলচ্চিত্রের প্রডাকশনের ক্ষেত্রেও ব্যাংক লোনের সুবিধা আসবে।
এখন আশা করি চলচ্চিত্র এগিয়ে যাবে। আগে এই বিষয়টি নিয়ে কেউ সচেতন ছিল না। অথচ সার্কভুক্ত দেশগুলো অনেক আগে থেকেই চলচ্চিত্রের জায়গায় এগিয়ে গিয়েছে। শুধুমাত্র বাংলাদেশ পিছিয়ে ছিল। মজার বিষয় হলো, টিকিটের উপর যে ট্যাক্স আরোপ করা হতো সেটা ব্রিটিশ আমলের তৈরি করা। স্বদেশি আন্দোলনের সময় বিপ্লবী যে নাটক হতো সেটা দমানোর জন্য ট্যাক্স নিয়মটি তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু ভারত পাকিস্তানের মতো দেশগুলো এই বিষয়টি বুঝে ফেলেছিল স্বাধীনতার পর। তাই ধীরে ধীরে তারা এটি বন্ধ করে দেয়। কারণ, এই ট্যাক্সের কারণে ইন্ডাস্ট্রি ধ্বসে পড়ছে। ট্যাক্স বেশি হলে, টিকিটের দামও বেশি হয় আবার হল মালিকদের সেভিংস কমে যায়। অন্যদিকে টিকিটের দাম বেশি হলে মানুষও কম হয়।
সুতরাং, এই ট্যাক্স নিয়ম বাংলাদেশে শিথিল হচ্ছে। এখন দেখবেন সব সিনেমা হলে টিকিটের দাম কমে যাবে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, তারেকের মৃত্যুর কারণেই এই পরিবর্তনগুলো আসছে। যাইহোক, তাও আসছে। আশা করি আস্তে আস্তে সব সমস্যার সমাধান হবে।
আপনি এখন কি নিয়ে কাজ করছেন?
এখন অনেক কাজ করছি। প্রকাশনার কাজ হচ্ছে। প্রডাকশনের কাজও চলছে। এছাড়াও আগের কাজ যেগুলো ডিভিডি বের হয়নি। সেগুলোও আমরা বের করার প্রক্রিয়া চালাচ্ছি।
অনেকেই বলেন, তারেক মাসুদ চলচ্চিত্রে একটি নতুনধারা সৃষ্টি করে গেছেন। সেই নতুন ধারার পথ এখন অনেকটাই ঘোলা হয়ে যাবে। এই বিষয়টিকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
না আমি এমনটা মনে করি না। তারেক একটি নতুন ধারা এনেছিল ঠিকই কিন্তু তার অনুপস্থিতি মোটেও পথকে ঘোলা হবে না। বরং ধীরে ধীরে যে নতুন পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছে, এখান থেকেই অনেক ভালো কাজ করার সুযোগ তৈরি হবে। তারেক সবসময় বলতো, আমাদের সময় শেষ হয়ে আসছে। এখন নতুন প্রজন্মের সময় চলে এসেছে। তাদের কাজ করার সময় হয়ে গেছে।
আমি গত বিশ বছর ধরে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করছি। আগের থেকে এখন নতুন যারা কাজ করছেন তারা অনেক ভিন্ন ধরনের চিন্তা নিয়ে আসছে। তারা আমাদের চেয়েও ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে যাবে বলেই আমি মনে করি। আগে আমরা অল্প কিছু মানুষ কাজ করতাম। তখন তো তেমন সুযোগই ছিল না। কিন্তু এখন মানুষও বেশি। অনেকেই কাজ করছে। সেই সঙ্গে অনেক সুযোগও তৈরি হচ্ছে। তরুণরা বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে হাত পাকানো হচ্ছে।
আমি আশাবাদি। নতুন প্রজন্মের মধ্যে থেকে অনেক ভালো নির্মাতা উঠে আসবে। আসলে তারেক নেই ঠিক। কিন্তু উদাহরণ হিসেবে তারেক মাসুদ এখনও আছেন। তারেক একটা জায়গা পর্যন্ত নিয়ে গেছে। সেখান থেকে আরেকজন এগিয়ে নিয়ে যাবে। এটাই জীবনের একটি নিয়ম। কখনও কিছু থমকে থাকবে না। প্রতিটি কাজ তার আপন গতিতে চলবে। একজন পর আরেকজন এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাই আমি এখনও স্বপ্ন দেখি। পুন:প্রকাশ