ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

মার্কিন মুলুকে গাড়ি তৈরিতে বাংলাদেশিদের ছোঁয়া

সাইফুল আজম সিদ্দিকী | প্রকাশিত: ০২:৩৯ পিএম, ০৬ মার্চ ২০১৫

ক্রিস্টেফার কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেন সেই ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে। এরপর পাঁচশ বছরেরও বেশি সময় চলে গেছে। এই দীর্ঘ সময়ে আমেরিকার স্থলভূমিতে বসবাস করে আসছে বিশ্বের বিভিন্ন মহাদেশ থেকে আসা জনগোষ্ঠী যারা সময়ের পরিবর্তনে এখন আমেরিকান।

যতদূর জানা যায়, প্রথম ইমিগ্রান্ট হিসেবে মার্কিন মুলুকে বাঙালির আগমন ঘটে ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে, চা চাষের ক্রীতদাস হিসেবে। সেই ক্রীতদাসদের আনা হয়েছিল আসাম এবং চট্টগ্রাম থেকে। এত আগে আমেরিকার মাটিতে বাংলাদেশীদের পদযাত্রা শুরু হলেও এখন পর্যন্ত মার্কিন মুল­ুকে বাংলাদেশিদের সংখ্যা খুব বেশি ন। উকিপিডিয়ার হিসেব মতে মাত্র পাঁচ লাখ। সংখ্যায় অনেক না হলেও এই দেশে বাংলাদেশিদের অনেকেই আলাদাভাবে চেনেন বিভিন্ন মৌলিক কারণে। বিশ্বখ্যাত স্থপতি বাংলার গর্ব ফজলুর রহমান খানের কীর্তিকথা এবং তার নকশায় বানানো শিকাগোর গগণচুম্বী ভবন সিয়ারস (বর্তমানে উইলস টাওয়ার) আমেরিকার অনেক গর্বের এক উল্লেখযোগ্য পর্ব।

এই দেশে ট্যাক্সি ড্রাইভারদের সততার উদাহরণ এই দেশে বসবাসরত কেবল বাংলাদেশিদের মুখেই নয়, সাদা চামড়ার অনেক ককেসিয়ানরাও বলাবলি করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমনিভাবে হয়তো বা কেউ কখনো শুনেনি কিংবা শোনার পটভূমি তৈরি হয়নি বাংলাদেশি গাড়ি-প্রকৌশলীদের কীর্তিতে গাঁথা কাব্যগ্রন্থের কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যকে বলা হয় গাড়ির রাজধানী। মিশিগান অঙ্গরাজ্যের বড় একটি শহরের নাম ডেট্রয়েট যার চারপাশে বিশ্বের বড় বড় গাড়ি কারিগরদের প্রকৌশল কেন্দ্র।

এখানে রয়েছে জেনারেল মটর, ফোর্ড মোটর, ফিয়াট মোটর, ক্রাইসলার গাড়ি কোম্পানিগুলোর সদর দফতার। রয়েছে টয়োটা এবং নিশানের মতো জাপানি, কোরিয়ান হুন্দাই-কিয়া কোম্পানিগুলোর প্রকৌশল শাখা। আনন্দের সঙ্গে বলতেই হয় প্রতিটি কোম্পানিতেই কর্মরত আছেন বাংলাদেশের প্রকৌশলীরা।

গর্বের সঙ্গে বলাই যায় যে, উত্তর আমেরিকায় প্রস্তুত প্রতিটি গাড়িতেই রয়েছে আমাদের কারিগরি হাতের ছাপ। গাড়ি আর গাড়ির কারিগর নিয়ে যেহেতু কথা বলছি, তাই গাড়ির কারুকাজে ভরা দুটো সিনেমার নাম উলে­খ না করে থাকতে পারছি না। ‘ট্রান্সফরমার’ ছবিতে বাম্বল বি’র হঠাৎ করে নতুন মডেলের ক্যামেরোতে রূপান্তরিত হওয়া সিনেমা পাগল দর্শকদের কাছে অতি পরিচিত একটা দৃশ্য। আর একটা সিনেমা হলো ‘দি ম্যার্টিক্স রি লোডেড’।

এই ছবিতে বৃহৎ আকারের গাড়ি ক্যাডিলাক এসক্যালেড-এর খোলা ছাদ থেকে গুলি বিনিময়ের দৃশ্য গুলোও সিনেমা পাগল দর্শকদের সহজে ভুলবার কথা না। সিনেমা কিংবা ছায়াছবি যার বদৌলতেই হোক না কেন, ক্যামেরো আর ক্যাডিলাক এসক্যালেড কেবল মার্কিন মুল­ুকেই নয়, সারাবিশ্বে গাড়ির গুণগত মানের বিচারে খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু যে বিষয়টা আমরা অনেকেই জানি না, তা হল ক্যামেরো গাড়ির চ্যাসিস (বাহ্যিক কাঠামো) আর সাস্পেন্সানের লিড প্রকৌশলী ছিলেন আমাদের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফেরদৌস আর ২০১৫ ক্যাডিলাক এসক্যালেড যখন টেক্সাস-এর আরলিংটনের ফ্যাক্টরি থেকে বেরিয়ে আসে, তার আগে ওই গাড়ির ইন্টেরিওর-এর ফিট এবং ফিনিসকে সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত করতে সর্বাঙ্গীন দায়িত্বে ছিলেন আমাদের আরেক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রকৌশলী নূর। কিম্বা ‘নিড ফর স্পিড’ খ্যাত মাস্তাং-এর শেতয়ারিং হুইল-এর প্রকৌশলী ইসহাক জামান।

জেনারেল মোটর কোম্পানির আর একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য গাড়ি (এই গাড়িটার বডি পুরোটাই অ্যালুমিনিয়ামের) হলো ক্যাডিলাক ঈঞ৬ যার সিট ইঞ্জিনিয়ারিং-এর দায়িত্বে আছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রকৌশলী সাইফুল। এভাবে এক এক করে বলতে থাকলে সামনে আসতে থাকবে অসংখ্য গাড়ির নাম আর তার সঙ্গে জড়িত থাকা অসংখ্য বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রকৌশলীদের নাম যারা নামের পিছনে না ছুটে নিরলস কাজ করে চলেছেন চুপিসারে ।

গাড়ি নিয়ে গবেষণা, ডিজাইন, ডেভেলপমেন্ট ও বাণিজ্যিক নির্মাণের প্রতিটি ধাপেই আজ বাংলা হাতের কারিগরি। অতি অল্প দিনের মাঝেই আমাদের প্রকৌশলীরা নিজ নিজ শাখার হয়েছেন লিড প্রকৌশলী, ম্যানেজার বা প্রধান প্রকৌশলী। গাড়ির ইঞ্জিন, ফুয়েল সিস্টেম, ব্রেক সিস্টেম, থার্মাল সিস্টেম, গ্লাস, আয়না, বাহ্যিক বডি, ইনটেরিওর সিস্টেম, সিট সিস্টেম, সেফটি সিস্টেম, কম্পিউটার প্রোগ্রামিংসহ সব জায়গাতেই আমাদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।

গাড়ি নির্মাণ কোম্পানি ছাড়াও গাড়ি নির্মাণ পার্টস সাপ্লাইয়ের কোম্পানিগুলোতেও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রকৌশলীদের উপস্থিতিও উলে­খ করার মতো। নির্দিষ্ট করে কোনো কোম্পানি বা ব্র্যান্ডের নাম তাই বললাম না, এতে পুরো পাতা ফুরিয়ে যাবে। শুধু প্রকৌশলীরা নন, গাড়ির যন্ত্রাংশ ও গাড়ি নির্মাণ শ্রমিকদের একটি অংশ বাংলাদেশি। তাদের উপস্থিতি ও সাফল্য অনস্বীকার্য। তাদের সন্তানরা আজ ডাক্তার ও প্রকৌশলী। কর্মক্ষেত্রে গাড়ি প্রকৌশলীদের হাজারও বাস্ততা থাকলেও বাংলাদেশি আড্ডায় কিন্তু সবার সরব উপস্থিতি। আমাদের প্রকৌশলীদের রয়েছে ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন ও টেবিল টেনিস দল। আর এসব দলে খেলার প্রধান শর্ত আপনাকে বাংলায় কথা বলতে হবে।

তাই দলে বাংলাদেশি ছাড়া আর কারও সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। আর খেলা মানেই মাঠে পুরো পরিবারের উপস্থিতি। যেন পারিবারিক মিলন মেলা। বাৎসরিক বনভোজন হয় সত্যিকারের বনে। সবকিছু মিলে এ যেন বইতে পড়া আদর্শ জনতার প্রতিদিনের কর্মলিপি আর বাস্তবে সেটা ঠিক ঠিক ঘটে যাবার মতো অপূর্ব ঘটনা। এসব পারিবারিক আয়োজনে সুযোগ হলেই হাজারো হাসি কৌতুকের মাঝে অতি প্রচলিত কৌতুক হলো ‘তোমাদের কোম্পানির এই গাড়িটা এতটা ভালো না ভাই’, ‘এর হর্স পাওয়ার এত কম কেন’? ইত্যাদি ইত্যাদি। রচিত হয় উৎসাহ আর উপদেশের মহাউৎসব ।

আর কয়েকটা বিষয় আছে যে, যে বিষয়গুলো না বললে মার্কিন মুল­ুকে আমাদের এসব বাংলাদেশি বংশদ্ভূত প্রকৌশলীদের পুরো পরিচয়টা দেয়া হবে না সেটা হলো বিভিন্ন প্রতিকূলতার মাঝেও যেভাবে তারা নিজেদের সম্পৃক্ত রেখেছেন এই দেশের মূল ধারার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। বাংলাদেশি আমেরিকান ডেমোক্রেটিক ককাস, মিশিগানে ডেমোক্রাটিক দলের একটি সহযোগী সংঘ যার বর্তমান চেয়ারম্যান হলেন বাংলাদেশি বংশদ্ভূত প্রকৌশলী শাহিন। বিগত কয়েকটি নির্বাচনে এই বাংলাদেশি আমেরিকান ডেমোক্রেটিক ককাস সংঘের কর্মকাণ্ড ছিল চোখে পড়ার মতো।

অন্যদিকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরেও একইভাবে সাংগঠনিকভাবে পেশাগত পরিধিতে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করে রেখেছেন এসব বাংলাদেশি বংশদ্ভূত প্রকৌশলীরা। লালন করে চলেছেন ত্রিশ বছরে পুরানো অসবৎরপধহ অংংড়পরধঃরড়হ ড়ভ ইধহমষধফবংযর ঊহমরহববৎং ধহফ অৎপযরঃবপঃং নামের সংগঠনের মিসিগান অধ্যায়কে।

লেখক : প্রকৌশলী সাইফুল আজম সিদ্দিকী ও প্রকৌশলী দেওয়ান মোহাম্মাদ নূর আলম, মিশিগান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

বিএ/পিআর