চাঁদের যতো কথকতা
‘আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা’- এই ছড়াটি শিশুদের খুব প্রিয়। বুঝতে শেখার পর থেকেই শিশুরা ছড়াটি শুনতে শুনতে মুখস্থ করে ফেলে। তাই চাঁদ আমাদের সবার মামা হয়ে ওঠে। আমরা সবাই চাঁদকে ‘চাঁদ মামা’ ডাকি। বংশানুক্রমে তা-ই হয়ে আসছে। ছেলেবেলায় বাবা-মায়ের কোলে থাকা শিশুটি চাঁদের দিকে আঙুল তুলে বলে, ‘ওটা কী?’ প্রশ্নের পরে শিশুটি সহজ একটি উত্তর পায়। আর সেটা হলো- চাঁদ। এভাবেই আমরা প্রথম চাঁদকে চিনি এবং চাঁদকে নিয়ে ভাবতে শিখি।
এর বাইরেও চাঁদ নিয়ে অনেক কথকতা প্রচলিত আছে। কিছু কথা বিজ্ঞানসম্মত, কিছু কথা কল্পনাপ্রসূত। দাদা-দাদি, নানা-নানির কাছে চাঁদ নিয়ে কতো রূপকথা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছি। চাঁদে এক বুড়ি বাস করেন। বুড়ি বসে বসে সুতা কাটেন। আরো কতো কী? সুতরাং বলা যায়, চাঁদ নিয়ে আমাদের মধ্যে যতোটা কৌতূহল কাজ করে ততোটা কৌতূহল কাজ করেছিল অন্য মানুষের মাঝেও।
ভাবতে শুরু করলেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা একসময় ভাবতেন- চাঁদ হয়তো পৃথিবীরই অংশ ছিলো অথবা একই সময়ে আলাদাভাবে সৃষ্টি হয়ে পৃথিবীর আকর্ষণে বাধা পড়েছিলো। তাই পৃথিবীর কাছাকাছি আবর্তন করছে। সত্তর দশকে চাঁদের মাটি-পাথর পরীক্ষা করে তার জন্মরহস্য সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা অন্য কথা বলছেন। তাঁরা বলছেন, ‘সৌরজগৎ সৃষ্টির প্রথম দিকে বিরাট গ্যাস আর ধুলো পাথরের পাজার মধ্যে সূর্যের কাছাকাছি পাথুরে চারটি গ্রহ তৈরি হয়েছিলো আগে। দু’তিন কোটি বছরের মধ্যেই কোটি কোটি পাথরের খণ্ড একসঙ্গে জুড়ে গিয়ে পৃথিবী আর শুক্রের সৃষ্টি হলো। তখন পৃথিবীর কাছাকাছি আদি বুধ আর আদি মঙ্গল ছাড়াও ছিলো আরও অসংখ্য বড় বড় পাথরের খণ্ড, তার কোনো কোনোটা ছিলো প্রায় বুধ আর মঙ্গলের সমান। এরা যে উপবৃত্তাকার পথে সূর্যের চারপাশে ঘুরছিলো- তা পৃথিবী আর শুক্রের কক্ষপথের খুব কাছাকাছি দিয়ে যাচ্ছিলো। হঠাৎ এক সময়ে মঙ্গল গ্রহের আকারের সমান একটি বস্তু এসে ধাক্কা লাগলো আমাদের পৃথিবীর সঙ্গে।
বুলেটের চেয়ে প্রায় দশগুণ বেশি বেগে বস্তুটি প্রচণ্ড ধাক্কা দেওয়ায় পৃথিবীর ওপর থেকে বিপুল পরিমাণ বস্তু উপরের দিকে ছিটকে উঠলো। পৃথিবীর ওপরটা কেঁপে উঠলো প্রবলভাবে, পাথর গলে লাভার স্রোত বইলো। যে বস্তুটি এসে পৃথিবীর সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছিলো তার ওপর চোট পড়লো আরও বেশি, সেটা ভেঙে খান খান হয়ে গেলো। প্রচণ্ড তাপে তার দেহ বাষ্প হয়ে ছিটকে উঠলো মহাশূন্যে আর আঘাতের ধাক্কায় পৃথিবীর চারপাশে ঘুরপাক খেতে শুরু করলো। এই জ্বলন্ত গ্যাসের পুঞ্জ পৃথিবীর চারপাশ ঘুরপাক খেতে খেতে জমাট বেঁধে সৃষ্টি হলো চাঁদের দেহ।’
বিজ্ঞানীরা আরো বলছেন, ‘চাঁদের কক্ষপথ যে পৃথিবীর বিষুবরেখার সঙ্গে কোণ তৈরি করে আছে- সেটা এই সংঘর্ষেরই ফল। তাছাড়া চাঁদে আদৌ পানির কোনো সন্ধান মিলছে না। তার কারণ হলো- এক সময়ে গনগনে গরম হয়ে ওঠারই জন্য। পৃথিবীর মাটি-পাথরের সঙ্গে চাঁদের মাটি-পাথরের বেশ কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। চাঁদের গা জমাট বাঁধার পর তেজস্ক্রিয়তার তাপে ভেতরে কোথাও কোথাও পাথর গলে লাভার প্রবাহ বয়ে গেছে; তাতেই তার ওপর তথাকথিত বালুর সাগরগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। তবে এসব লাভা প্রবাহও শেষ হয়েছে অন্তত ৩০০ কোটি বছর আগে। তারপর এতো বছর ধরেই চাঁদ এক বিরান মরুভূমি হয়ে আছে।’
সে যাই হোক, তবে কেনো আমরা চাঁদের একটা পিঠ দেখি অন্য পিঠ দেখতে পাই না? তাহলে চাঁদের উল্টো পিঠের রহস্য কী! পৃথিবীর চারপাশে একবার ঘুরে আসতে চাঁদের কতো সময় লাগে? সেটা ঠিক ২৭.৩ দিন। তবে যখন পূর্ণ চন্দ্র হয় তখন একবার ঘুরে আসতে চাঁদের ২৯ দিন সময় লাগে। মজার বিষয় হচ্ছে, চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে ২৭.৩ দিনে এবং নিজ অক্ষের চারপাশে ঘুরতেও চাঁদের ঠিক ২৭.৩ দিন লাগে।
সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, ৬৮ বছর পর ১৪ নভেম্বর আবারও দেখা মিলবে ‘সুপার মুন’। ১৯৪৮ সালের ২৬ জানুয়ারির পর এতোগুলো বছরে চাঁদ কখনো পৃথিবীর এতো কাছে আসেনি। এ সময় পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু থেকে চাঁদের দূরত্ব হবে ২ লাখ ২১ হাজার ৫২৪ মাইল বা ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৫০৮ কিলোমিটার। সাধারণ দূরত্বের তুলনায় এবার পৃথিবীর আরও প্রায় ৮৫ মাইল কাছে চলে আসবে চাঁদ। তবে রাতের আকাশ যদি মেঘমুক্ত না থাকে তাহলে সুপার মুন দেখতে অপেক্ষায় থাকতে হবে আরও ১৮ বছর। বিজ্ঞানীদের দাবি, ২০৩৪-এর নভেম্বর মাসে ফের চাঁদ পৃথিবীর এতো কাছে আসবে।
একটু খেয়াল করে দেখবেন, সুদূর অতীতে আমরা চাঁদের ৫০ শতাংশ দেখতে পেলেও এখন আমরা মোট চাঁদের ৫৯ শতাংশ এলাকা দেখি। পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে চাঁদ যখন পৃথিবীর খুব কাছে চলে আসে তখন তার দূরত্ব হয় পৃথিবী থেকে ৩,৫৬,৪০০ কিলোমিটার যাকে বলা হয় অনুভূত। ইংরেজিতে Aphelion বলা হয়। আর যখন উপবৃত্তাকার পথে ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরে সরে যায় তখন দূরত্ব হয় ৪,০৬,৭০০ কিলোমিটার যাকে বলা হয় অপভূ। ইংরজিতে Perihelion বলা হয়।
সব মিলিয়ে চাঁদের ৪১ শতাংশ এলাকা সবসময় আমাদের চোখের আড়ালে থাকে। ১৯৫৯ সালেই আমরা প্রথমবারের মতো চাঁদের উল্টো পিঠের ছবি দেখলাম। রাশিয়ার লুনা-৩ চাঁদের উল্টো পিঠের ছবি তুলে পাঠিয়েছিলো। তাতে দেখা গেলো, সচরাচর চাঁদের যে পিঠ আমরা দেখতে পাই উল্টো পিঠটা অনেকটা সেরকমই। চাঁদের যে পিঠে সূর্যের আলো পরে সে পিঠে তাপমাত্রা ওঠে ১২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর অন্যপিঠে নেমে যায় ১৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত।
চাঁদের এতো জটিল হিসাব-নিকাশের পরও চাঁদ আমাদের প্রিয়। গল্প-কবিতা-গানে চাঁদের উপস্থিতি মায়াবী রূপে। চাঁদ আমাদের আলোড়িত, মোহিত ও বিমুগ্ধ করে। চাঁদের আলোয় প্রিয়জনের সান্নিধ্যে আমরা আন্দোলিত হই। গেয়ে উঠি- ‘চাঁদের সাথে আমি দেবো না তোমার তুলনা’।
তথ্যসূত্র : গুগল এবং কী ঘটছে মহাকাশে- আবদুল্লাহ আল মুতি
এসইউ/পিআর