ঢাকা-শরীয়তপুর : পথের বাঁকে বাঁকে
সারা দেশের বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল জাগো নিউজ পরিবারের সদস্যরা। আমরা গিয়েছিলাম শরীয়তপুর। ১৬ আগস্ট বিকেল ৪টায় হোসেন মার্কেটের সামনে থেকে আমি ও সহ-সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক উঠলাম প্রচেষ্টা পরিবহনে। মালিবাগ মোড় থেকে উঠলেন নিজস্ব প্রতিবেদক মানিক মোহাম্মদ। মালিবাগ মোড় থেকে কাকরাইল পর্যন্ত রাস্তা বন্ধ থাকায় গাড়ি রাজারবাগ হয়ে বিজয়নগর দিয়ে বের হলো। জ্যামের শুরু এখানেই। তারপর গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া, বাবুবাজার পেরিয়ে বুড়িগঙ্গা সেতুতে পৌঁছতেই আড়াই ঘণ্টা শেষ।
জ্যামের সঙ্গে সঙ্গে পরিবহনের আলসেমি সময়কে শেষ মুহূর্তে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এছাড়া আকাশের বৈরিতাও কম নয়। ৬টার সময়ই অন্ধকার হয়ে আসে চারপাশ। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে শিমুলিয়া ঘাটে পৌঁছতেই সন্ধ্যা সাতটা। অবশেষে শেষ লঞ্চটি পাওয়া গেল। সাড়ে সাতটায় ছাড়বে এটি। লঞ্চটি মিস করলে রাতটা হয়তো ঘাটেই থেকে যেতে হতো।
ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিতেই এগিয়ে চলছে লঞ্চ। পদ্মায় মাঝারি মানের স্রোত। বুকে হাল্কা দুরুদুরু কাঁপন। সহকর্মী আব্দুর রাজ্জাক স্মরণ করিয়ে দিলো পিনাক-৬ লঞ্চকে। মানিক মোহাম্মদ তাতে যুক্ত করলেন অনেক তথ্য। আলোচনা আর অবলোকনের মধ্যদিয়ে পদ্মা পার হলাম। নদীর বুক চিড়ে ধপাস ধপাস শব্দ ভেসে আসছে সেতু নির্মাণ কার্যক্রমের। সাড়ে আটটার দিকে যখন শরীয়তপুরের মাঝিকান্দি ঘাটে নামলাম তখনও বৃষ্টি।
ঘাটে এই রাতে গাড়ি বলতে মোটরসাইকেল অথবা টেম্পু। বৃষ্টি বলে মোটরসাইকেল উপযোগী নয়। ঘাট থেকে নড়িয়া উপজেলার নড়িয়া বাজারে যেতে ভাড়া পড়বে ৬শ’ টাকা। চলতে শুরু করলো টেম্পু। চালক জানালেন প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার দূর। রাতের পথ। তাই রাস্তা অনেকটা ফাঁকাই মনে হচ্ছে। আবার গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। তবুও যেন এগুচ্ছে না টেম্পু। পঁচিশ কিলোমিটার যদি ম্যাপ অনুযায়ি হয়, তবে গাড়ি যেতে এর দ্বিগুণ হতেই পারে। যে কারণে এমনটা মনে হচ্ছিল- তা হচ্ছে, মাঝিকান্দি ঘাট থেকে নড়িয়া পৌঁছতে নিশ্চয়ই একশ’ বাঁক পেরোতে হয়েছে।
এই জীবনে চলার পথে এতো মোড় বা বাঁক আর কোথাও দেখেছি কিনা মনে পড়ছে না। সাপের মতো এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে পথ। বাঁকে বাঁকে গাড়ির হর্ন, বিপরীতমুখি গাড়ির হেডলাইট মাঝে মাঝেই ভয় পাইয়ে দিচ্ছিল। এছাড়া রাস্তার দু’ধারে সোনালি আঁশ দুলছে বাতাসে। পাটখড়ি রেখে প্রায় অর্ধেকটা রাস্তা দখল করে আছে স্থানীয়রা। বলা যায় পাটের জন্যও প্রসিদ্ধ এ অঞ্চল।
এই আঁকাবাঁকা রাস্তাগুলো হয়তো কোনো এক কালে গায়ের মেঠোপথ ছিলো। অনেকটা কৃষকের জমির আইল (আল) ধরে রাস্তাগুলো নির্মিত হয়েছে। ফলে দাগ কেটে সোজা রাস্তা করার সুযোগ হয়নি কর্তৃপক্ষের। আর এ লাইনে গাড়ি চলাচল হয়তো খুব বেশি প্রাচীনও নয়।
সে যাই হোক, অবশেষে সর্পিল পথ পেরিয়ে রাত ১০টায় পৌঁছলাম নড়িয়া বাজারে। আমাদের শরীয়তপুর প্রতিনিধি মো. ছগির হোসেন সন্ধ্যা থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন। আমরা পৌঁছামাত্র খাবারের বন্দোবস্ত। মফস্বল শহরের মাঝারিমানের একটি হোটেলে খেতে বসে অনেক দিন পর যেন বাড়ির খাবারের স্বাদ পেলাম। পদ্মা তীরবর্তী এলাকা হওয়াতে অনায়াসেই পেয়ে গেলাম পদ্মার ইলিশ ভাজা। শুধু ইলিশ আর মুগডালে হয়ে গেল রাতের ভুড়িভোজ।
রাতে বিশ্রামের গন্তব্য নড়িয়া ডাকবাংলো। একটি ভিআইপি কক্ষ ছাড়া বাকি সবগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী। রাত ১১টার দিকে উঠলাম অগোছালো একটি কক্ষে। তখন পুরো এলাকায় বিদ্যুৎ ছিলো না। মোমবাতির আলোয় পোশাক পরিবর্তন করে শুরু হলো বিদ্যুতের জন্য অপেক্ষা। বসে বসে গল্প করে করে অপেক্ষার প্রহর আর ফুরায় না। অবশেষে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।
প্রায় রাত একটার দিকে ফ্যান দু’টো ঘুরে উঠলো। একটু স্বস্তি পেলাম। কিন্তু হায় শরীরের ঘাম মুছতে না মুছতেই দুইটার দিকে আবার বিদ্যুৎ বিভ্রাট। তারপর কখন যে সকাল হলো ঘুম ভাঙার আগে বুঝতে পারিনি।
সকালে ঘুমের রেশ কাটতে না কাটতেই ত্রাণ বিতরণের জন্য প্রস্তুতি। ছুটে চললাম কেদারপুর ইউনিয়ন পরিষদের দিকে। সেই আঁকাবাঁকা পথ যেন পিছু ছাড়ে না। বাঁকা পথে হেলেদুলে, ভাঙা রাস্তার ঝাঁকুনিতে পৌঁছে গেলাম কেদারপুর ইউনিয়নের অস্থায়ী কার্যালয়ে। কেদারপুর বাজারে অবস্থিত একটি একতলা মার্কেটের দুটি কক্ষে চলছে পরিষদের কাজ। বাজারের মূল সড়কের পাশে অবস্থিত বলে ত্রাণপ্রার্থী দেড় হাজার মানুষের উপস্থিতিতে জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে কেদারপুর।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সাংবাদিকদের সহযোগিতায় ঘামে ভিজে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে দেড় হাজার মানুষের হাতে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিতে পেরেছি। বিতরণের পর সাংবাদিক আলম ভাইয়ের অফিসে একটু গা জুড়াতেই পরবর্তী জেলার আহ্বান। ছুটতে হবে মাদারীপুরের শিবচরে। চোখে-মুখে হালকা জল ছিটিয়ে ঝুমুর হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে ছুটলাম শিবচরের উদ্দেশে।
আবারো সেই সর্পিল পথ। পথের বাঁকে বাঁকে জলের স্রোত। সবুজের হাতছনি। আমরা গেয়ে উঠলাম, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়; তবে কেমন হতো তুমি বলো তো?’
এসইউ/এমএস