পাহাড়ের বাঁক নয় যেন স্বর্গ সিঁড়ি
শুক্রবারের সকাল বেলা। সূর্যের কিরণ ছড়াচ্ছে সবে। পাহাড়ের কোলঘেঁষে বেলা উঠতেই নির্ণয় হল পূর্ব-পশ্চিম। খাগড়াছড়ি শহরের ইকুইছড়ি হোটেল থেকে সকাল ১০টা নাগাদ রওনা হতেই সূর্যের তাপ বাড়তে থাকল।
তাপ বাড়ছে, বাড়ছে পাহাড়ের রূপ। ততক্ষণে মেঘরূপী কুয়াশারাও বিদায় নিচ্ছে। আলোর ঝলকানিতে সবুজ পাহাড়গুলো আরও গাঢ় সবুজে ফুটে উঠছে। রোদ, সবুজ আর আকাশচুম্বি পাহাড়গুলোর ত্রিমিলনে সৃষ্টির অপরূপ সৌন্দর্য প্রকাশ পাচ্ছে।
খাগড়াছড়ি শহর ছেড়েই দুর্গম পাহাড়ে যাত্রা। গন্তব্য রাঙ্গামাটির সাজেক ভেলি। শহর থেকে প্রায় ৬৩ কিলোমিটার দূরে। দীঘিনালা পর্যন্ত ১৮ কিলিমিটারের রাস্তা পাহাড় বেয়ে পার হলেও অতটা ভয়ঙ্কর নয়। বাঘাইহাট সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট পার হতেই বিপদসঙ্কুল রাস্তায় গাড়ি ছুটে চলল।
গাড়ি যাচ্ছে, বিপদ বাড়ছে। একেবারেই সরু রাস্তা। জনমানব আর বসতিহীন পাহাড়ের গাঘেঁষে পিচঢালা রাস্তাটি। রাস্তা থেকে খানিক দূরে দু-একটি আদিবাসী বাড়ির দেখা মেলে। আদিবাসী শিশুরা স্বাগত জানাতে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। শিশুরা হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। পর্যটকদের কেউ কেউ শিশুদের লক্ষ্য করে চকলেট, চুইংগাম, বিস্কুট ছুড়ে মারছে।
কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রাস্তাটি নির্মাণ করেছে। উদ্দেশ্য পর্যটকদের সাজেক ভেলির সৌন্দর্য অবলকন করানো। সাজেক ভেলি যেতে প্রায় শ’ খানেক পাহাড় ডিঙ্গাতে হয়। কখনও পাহাড়ের চূড়া মারিয়ে, আবার কখনও পাহাড়ের পাদদেশ হয়ে রাস্তা। চূড়া থেকে নামতে যেমন খাড়া ঢাল, আবার পাদদেশে থেকে চূড়ায় উঠতেও একই ঢাল। কোনো কোনো পাহাড়ের মধ্যভাগ কেটে রাস্তাটির গতিপথ নির্ধারণ করা হয়েছে।
খানিক পরপরই আচমকা মোড়। অমন ঢাল আর মোড় আসতেই পর্যটকদের অনেকে ভয়ে আঁতকে উঠছে। অনেকেই চিৎকার করে উঠছে। অনেকে সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়ে ভয় কাটানোর চেষ্টা করছে। তবুও থেমে নেই পথচলা। কমছে না গাড়ির গতিও। বরং গতি কমলেই বিপদ বাড়তে পারে। গাড়ি মানে দু-একটি প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল আর শ’ খানেক চান্দের গাড়ি। সাজেকে যাওয়ার প্রধান ভরসা চান্দের গাড়ি। ট্রাভেল এজেন্সি আর হোটেল কর্তৃপক্ষই মিলিয়ে দেয় এসব গাড়ি। সেনাবাহিনীর বিশেষ পাহারায় দিনে একবারই পর্যটকদের গাড়ি চলে এ রাস্তায়।
এভাবেই ঘণ্টা দুই পার। সাজেক ভেলির কাছে আসতেই বিশেষ সতর্ক বার্তা। পাহাড়ের কয়েকশ মিটার নিচে সিজক ঝর্ণার কাছে সমস্ত গাড়ি থামিয়ে দেয়া হল। পর্যটকদের আগে-পিছে সেনাবাহিনীর গাড়ি। মূলত গাড়িগুলোর ইঞ্জিন ঠাণ্ডা করতেই এই বিরতি। ইঞ্জিনে ঠাণ্ডা করতে পানি দিচ্ছেন হেলপাররা। চালকরা তেল, চাকাসহ গাড়ির অন্যান্য জিনিস পরীক্ষা করছেন। ইঞ্জিন বিকল হলে আর রক্ষা নেই।
রাস্তার পাশে সাইনবোর্ডে লেখা ‘বৃদ্ধ, শিশু এবং হৃদরোগে আক্রান্তদের এ রাস্তায় নিরুৎসাহিত করা হল’ সিজক তখন মাথার ওপর। তবে মনে হচ্ছিল সীমানাবিহীন। সিজকের পাহাড়চূড়া যেন মিলে গেছে আকাশ সীমানায়। আধঘণ্টা বিরতির পর ফের যাত্রা। খাড়া ঢাল মাড়াতে গাড়ির কোলো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেল পুরো রাস্তা। নারী পর্যটকদের অনেকেই চিৎকার করতে থাকল। অনেকের মধ্যেই আবার আনন্দ উল্লাস।
ভয়, আতঙ্ক আর মৃত্যুর হাতছানি উপেক্ষা করেই অবশেষে সিজকের সর্বোচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় আরোহন। পাহাড়ের বাঁক নয়, যেন স্বর্গ সিঁড়ি মাড়িয়ে স্বর্গীয় আশ্রমে প্রশান্তির নিশ্বাস ফেলল পর্যটকরা।
এএসএস/এমএমজেড/এবিএস