স্বপ্ন, কিন্তু দুঃস্বপ্ন
টেবিলের উপর জাগোনিউজ২৪.কম-এর ‘ঈদ সংখ্যা ২০১৬’ পড়ে আছে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে। প্রতিদিন রুমে এসে ভাবি, আজ পড়বো। এভাবে আজ পড়বো, কাল পড়বো করে এই সংখ্যার দুয়েকটি কবিতা আর ছোটো গল্প ছাড়া তেমন কিছুই পড়া হয়ে ওঠেনি। তবে আজ বেশ ভালো লাগছে। ঠিক করলাম আজ বেশ কয়েকটি অধ্যায় পড়বোই পড়বো।
ঘড়িতে তখন রাত ১০টা। ধুলো ঝেড়ে ঈদ সংখ্যাটা হাতে নিলাম। সূচিপত্রে চোখ বুলাতে বুলাতে চোখ পড়লো ‘প্রযুক্তি’ অধ্যায়ে আরিফুল ইসলাম আরমানের ‘ঈদ এখন ফেসবুকেই’ লেখাটায়। এটি পড়তে না পড়তেই মনে আরেকটি চিন্তা এসে হাজির। যাই, একটু নিজের ফেসবুকে নোটিফিকেশন ও মেসেজটা একটু চেক করে আসি। এটা এক মানসিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। খেতে যাবো, গোসলে যাবো, পড়তে বসবো যেটাই করি না কেনো ফেসবুকে ঢুঁ মারাটা ট্রেডিশোনাল হয়ে গেছে। সে হোক ঘুমাতে যাওয়ার আগে বা ঘুম থেকে উঠে।
ঢুকতেই চোখে পড়লো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম রফিক ভাইয়ের স্ট্যাটাস, ‘লেখাপড়া প্রায় শেষের পথে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মোক্ষম সময়। বাড়িতে মা-বাবার কতো আবদার! প্রিয় মানুষটাকে কাছে টেনে নেয়ার আকুতি! কমতি নেই আগ্রহেরও! বাধা বলতে শুধু রটি-রুজি সন্ধানের পথ! সাধের কমতি নেই সীমাবদ্ধতা শুধু সাধ্যের।’ লেখাটি পড়ে মনটা কেমন জানি করে উঠলো। মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন। কেন এতো হতাশা। আমাকেও কি কোনো একসময় এমন স্টাটাস দিতে হবে! আমার হাতেও তো সময় খুব অল্প। তৃতীয় বর্ষ শেষ করতে চলেছি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি কেন। যাকে কিনা বলা হয় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ!
এই মুহূর্তে হতাশার স্ট্যাটাসের সঙ্গে মস্তিষ্কে দাগ কাটলো বিভাগের এক শিক্ষকের কথা। যে কথাটা সপ্তাহে অন্তত দুই-একবার শুনতেই হয়। কখনো বকা দিয়ে, কখনো ভালোবেসে আবার কখনো বুঝিয়ে কথাটা প্রায়ই স্যার বলতেন, ‘পড়াশোনা শেষ করে মিলিয়ে নিও। এই পাঁচ বছরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুমি কী না নিয়েছো আর কতোটা নিজেকে ক্ষয় করেছো। আর যদি কেবল ওই কাগজ (সার্টিফিকেট) কেনার জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে থাকো তাহলে যমুনা সেতু পাড় হয়ে দেখো; বুঝতে পারবা জীবনের আসল মানে কী।’
এই বক্তব্য আর ওই স্ট্যাটাসের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে নিজেকে আজ বড় গুলিয়ে যাচ্ছে। সত্যিই তো, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কি আদৌ কিছু নিতে পারছি? ছেলেকে মানুষ করার জন্য যেখানে বাবা খরচ করছে কাড়িকাড়ি টাকা, বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে রেখেছে লাইব্রেরিভরা বই, আবাসিকতার সুবিধা, ক্লাসরুম, শিক্ষক, খেলার জন্য মাঠ, সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক অঙ্গণ আসলে কোনটা নিতে পারছি আমি বা আমরা? প্রশ্নের উত্তর মিলছে না।
অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে পরিবার আত্মীয়-স্বজনের ইচ্ছা পূরণে ও নিজের ‘আগ্রহে’ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধে কী পরিশ্রমটাই না করেছি। তাহলে কী লাভ এতো পরিশ্রম করে। যদি শিক্ষাটাই না অর্জন করতে পারি। দেশ উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি শিক্ষায় ঘুণ ধরলে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দরকার কী? তবে কি সত্যিই ওই কাগজ কেনার জন্য এসেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে। যাতে চাকরির বাজারে নিজেকে ভালো দামে বেচতে পারি! বিভাগের আরেকজন শিক্ষকের কথা মনে পড়ছে। যিনি আজও ক্লাসে বললেন, ‘চাকরি পাওয়ার আসায় পড়ো না। প্লেজার নিয়ে পড়াশোনা করো। ভালো কিছু পড়ো। চাকরি তোমার কাছে ধরা দেবে।’
সময়গুলো বড্ডো একঘেঁয়ে হয়ে গেছে। একই কাজ প্রতিদিন করতে করতে মন বড় ক্লান্ত। মাঝে মাঝে মনে হয়, কোনো সংগঠনে যোগ দিই। কিন্তু কোনো সংগঠনে সংযোগ দেবো। কবিতা আবৃত্তি, বিতর্ক, নাট্যদল, লেখালেখি, সাংস্কৃতিক নাকি রাজনৈতিক কোনো সংগঠনে? ভাবতে ভাবতেই তো তিনটা বছর পার হতে চললো। তাহলে এই দু’বছরে আর কী হবে? সত্যি বলতে কি, ভালো সংগঠন করার সুবিধা অনেক। এখানে শেখার পরিধিও বেশি। নেতৃত্ব দেয়ার চর্চাটা এখানে খুব ভালোভাবে হয়। যার সুফল হয়তো সারাজীবন বয়ে বেড়ানো সম্ভব। এর আরও একটা ভালো দিক হলো, এটা সবাইকে নিয়ে পথ চলতে শেখায়। নিজের একাকিত্ব দূর করে। নিজেকে সবার মধ্যে বিলিয়ে দেয়ার সুযোগ তৈরি করে। তবে এই সব কাজের মধ্যেই পড়াশোনাটা জরুরি। না জানলে তোমাকে মানবে কে? হয়তো আমার মতোই অনেকেই স্বপ্ন দেখে নেতৃত্ব দেয়ার। কিন্তু সেই গুণগুলো অর্জন করার সময় আর হয়ে ওঠে না। হয়তো এ সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে নেতৃত্ব দেয়ার সেই সম্ভাবনাময় বীজগুলো মনের গহীনে বপন করাই সম্ভব হচ্ছে না।
সত্যি বলতে কি, ক্যাম্পাসটাকেও আজ বড় শূন্য মনে হয়। মনে হয় যেন নিঃষ্প্রাণ। রাবি অধ্যাপক রেজাউল হত্যা, গুলসান-শোলাকিয়া হামলাসহ নানা ধরনের ঘটনায় দেশের সঙ্গে তারুণ্যে চারণক্ষেত্র এই বিশ্ববিদ্যালয়ও আজ থমথমে। জায়গায় জায়গায় পুলিশের চেকপোস্ট। বারবার বই-খাতার ব্যাগ তল্লাশি, মাঝে মাঝে হলের রেইডের সতর্কবাণী হতাশ করে তুলেছে সকাল-সন্ধ্যা। নেই প্রাণবন্ত শিক্ষামূলক আড্ডা, নেই গলাচিরে ভেসে আসা সুর, নেই চায়ের কাপে একসঙ্গে চুমুকের সড়াৎ সড়াৎ আওয়াজ, নেই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক। আছে কেবল দিনের বেলায় ‘চুরি’ করে সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড; আর ক্যাপশনে লেখা থাকবে, ‘মজায় মজা।’ আজ শুনলাম, সামনেরে আগস্ট মাস থেকে রাবি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বাড়াতে নাকি ৩০ জন আনসার বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব অর্থায়নের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। আসলেই আমরা অনিরাপত্তায় ভুগছি!
মনটা আর সেই রাত ১০টার মতো নেই। ঈদসংখ্যা পড়তেও ইচ্ছা নেই। রাতের অনেকটা সময় চলে গেছে। ঘুমাতে হবে। সকালে ক্লাস আছে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে ইচ্ছা করি, আগামী ভোর থেকে জ্ঞানের পঠন-পাঠন, চর্চা ও জ্ঞান উৎপাদনের মাধমে নিজেকে যেন সদাপ্রস্তুত রাখতে পারি।
রাশেদ রিন্টু, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
বিএ