সাপের উপদ্রব বাড়ে কেন?
মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত সাপের উপর ব্যাপক গবেষণা হয়নি। তবে বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ মোঃ আবু সাইদ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহসান গবেষণায় দেখেছেন, দেশে ১১৭ প্রজাতির সাপ রয়েছে। এর মধ্যে বিষধর সাপ ৩৪ প্রজাতির, বাকি ৮৩ প্রজাতি অবিষধর।
বাংলাদেশে মূলত কোবরা, গোখরা এবং কেউটে প্রজাতির সাপের দংশনে মানুষের মৃত্যু বেশি হয়। গোখরো সাপ দু প্রকার। পদ্ম গোখরা এবং খইয়া গোখরা। বাংলাদেশে ৫টি প্রজাতি ক্রেইট বা কেউটে সাপ পাওয়া যায়। এই ক্রেইট জাতের সাপকে স্থানীয়ভাবে কেউটেও বলা হয়। আমাদের দেশে ক্রেইট সাপ পাচ প্রজাতির যেগুলো দেওয়া যায় তা হলো, কমন ক্রেইট, ওয়ালস ক্রেইট, গেটার ব্লাক ক্রেইট, ব্যানডেট ক্রেইট বা শঙ্খিনী, লেসার ব্লাক ক্রেইট। এগুলোর মধ্যে মানুষ সাধারণত ব্যানডেট ক্রেইট বা শঙ্খিনী প্র্রজাতির সাপ বেশি চিনে।
বর্ষাকালে সাপের উপদ্রব কেন বাড়ে?
বন্যায় যখন বাড়ি-ঘর ডুবে যায় মানুষ তখন আশ্রয়ের জন্য উঁচু জায়গা এবং আশ্রয় কেন্দ্রে জড়ো হয়, তখন সাপও বাঁচার জন্য উঁচু জায়গায় মানুষের আশ্রয়স্থলে চলে যায়। ফলে মানুষ অসতর্কতার কারণে দংশনের শিকার হচ্ছে। বিষধর সাপ বন্যার পানিতে ভারত থেকে বাংলাদেশে ভেসে আসে। ফলে জুলাই-আগস্ট মাসে অর্থাৎ বর্ষাকালে মানুষ প্রতিনিয়ত এবং সর্বাধিক সর্পদংশনের শিকার হচ্ছে। দুই প্রজাতির গোখরা, পাঁচ প্রজাতির কেউটে, চন্দ্রবোড়া পানিতে সাঁতার কাটতে পারে।
বাসা,বাড়িতে সাপ দেখলে প্রাথমিকভাবে করণীয়
সাপ দেখলে হৈ-চৈ, চিৎকার চেচামেচি, দৌড়াদৌড়ি করা যাবে না। বাসার লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিন। রাতের বেলা হলে লাইট জ্বালিয়ে একজন সাপটির গতিবিধি লক্ষ্য রাখুন। মোবাইলে ছবি তোলা যদি সম্ভব হয়। ছবি তুলে সাপ বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠান। তারা সাপের ছবিটি দেখে প্রজাতি শনাক্ত করবেন। বিষধর না অবিষধর, সে হিসেবে করণীয় বলে দিবেন। ঘরের দরজা বা জানালা খুলে বড় কোনো লাঠি দিয়ে সামান্য নাড়া দিলে সাপ বের হয়ে যাবে। ঘরের ভেতরে গর্ত, আলমারির উপর, ফ্রিজের পেছনে অথবা এমন কোনো জায়গায় থাকে যেখান থেকে সাপ তাড়ানো যাচ্ছে না। তখন ৯৯৯ ফোন করে সাহায্য নিতে হবে। অথবা বন বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের প্রশিক্ষিত রেসকিউকারীদের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশে বর্তমানে বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রয়েছে, যারা দেশের বেশ কিছু জায়গায় সাপ রেসকিউ করেন। মনে রাখতে হবে, সাপ জড় বস্তু বুঝতে পারে না। তাই সাপ দেখলে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে পায়ের পাশ দিয়ে চলে যেতে পারে। কিন্ত ছোবল দিবে না। নড়াচড়া, ছোটাছুটি করলে খাবার, নয় তো শত্রু ভেবে ছোবল মারতে পারে।
সাপ কামড়ালে প্রাথমিক চিকিৎসা
সর্পদংশনের প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাক্তার আয়ান সিমপসং বলেছেন- ডু ইট রাইট অর্থাৎ সঠিক কাজটি করতে হবে। আর-রেসকিউ, আই- এমওবোলাইজ, জিএইচ-গো টু হসপিটাল, টি-টেল দ্য ডক্তর। সর্পদংশনের পর রোগী কে সাহস দিতে হবে। শান্ত রাখতে হবে। সাপ যেখানে কামড় দিয়েছে সেই অঙ্গের নড়াচড়া বন্ধ রাখা যাতে বিষ শরীরে দ্রুত ছড়িয়ে না পড়ে। অধিকাংশ সাপ হাতে বা পায়ে দংশন করে, দংশিত অঙ্গ নড়াচড়া না করার ফলে শরীরে বিষ ছড়াতে সময় লাগে। পায়ে ছোবল দিলে লাঠি বেধে পা সোজা করে স্টেচারে শুইয়ে দ্রুত চিকিৎসা কেন্দ্রে নিতে হবে। তবে মনে রাখবেন যে, কোনো ধরনের বাঁধনে সাপের বিষ আটকাতে পারে না। এতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে হাত-পা চিরতরে পঙ্গু হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে চন্দ্রবোড়া ও সবুজবোড়া সর্পদংশনে বাঁধন মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
ওঝার কাছে যেতে বারণ
ভারতীয় উপমহাদেশে যুগ যুগ ধরে ওঝার অপচিকিৎসা চলে আসছে। বাংলাদেশে সর্প দংশনের ১০০টির মধ্যে ৮০টি হলো অবিষধর সাপের দংশন। অবশিষ্ট ২০টি বিষধর সাপের দংশন। এই ২০টির মধ্যে ১০ টি হলো ড্রাই বাইট। সাপ এত দ্রুত ছোবল মারে যে সে মানুষ বা প্রাণীর দেহে পরিমিত মাত্রায় বিষ ঢুকাতে পারে না। এটাকে ড্রাই বাইট বলা হয়। এতে রোগীর দেহে বিষক্রিয়া হয় না। মানুষ মারা যায় না। মূলত ৮০ শতাংশ অবিষধর সাপের দংশন আর ১০ শতাংশ ড্রাই বাইটের রোগীদের উপর ওঝা তন্ত্র মন্ত্র দেখিয়ে রোগীকে ভালো করার প্রমাণ করে। ফলে মানুষের মধ্যে বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে, ওঝারা সর্প দংশিত রোগী ভালো করতে পারে। বাকি ১০ শতাংশ রোগীকে ওঝারা ভালো করতে না পেরে হাসপাতালে পাঠায়।
সাপের উপদ্রব ঠেকানোর উপায়?
সাপের পছন্দের খাবার ইঁদুর,ব্যাঙ। ঘরে বা আশপাশে ইঁদুর থাকলে সাপ সেটিকে খাওয়ার জন্য বাড়িতে প্রবেশ করে। সুতরাং বাড়ির ভেতরে আশপাশ থেকে ইঁদুর দূর করুন। মাটির ঘর হলে এবং আশপাশের সব ধরনের গর্ত বন্ধ করে দিন। ঝোপঝাড় পরিষ্কার রাখুন। ব্লিচিং পাউডার, চুন বা কার্বলিক এসিড ছড়িয়ে দিলে পোকা মাকড়, সাপের উপদ্রব কিছুটা কম হতে পারে। তবে এটি দিয়ে সাপ প্রতিরোধ করা যায় না।
সাপ নিয়ে যত কুসংস্কার
সাপ নিয়ে বেশকিছু কুসংস্কার রয়েছে এখনো। যেমন-সাপের মাথায় মনি থাকে, সাপ উড়তে পারে, সাপ গাভীর দুধ খায়, ফুলের গন্ধে সাপ আসে, দুমুখো সাপ, সাপের পা থাকে, বাঁশির সুর শুনে সাপ নাচে, রাতের বেলায় সাপের নাম বলতে নেই, দারাস সাপের লেজে কাটা থাকে, সাপকে আঘাত করলে ঘরে এসে দংশন করে।
সচেতনতার বিকল্প নেই
আমরা সবাই নিজ নিজ এলাকায় মানুষকে সাপ সম্পর্কে সচেতন করতে পারি। কী কী বিষয় মানলে মানুষ সর্প দংশনের শিকার হবে না। সর্পদংশিত হলে করণীয় কি, কোথায় চিকিৎসা নিতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে প্রচারণা চালাতে হবে। মানুষকে বুঝাতে হবে ১০০ টি সর্পদংশনের মধ্যে ৯০ টি অবিষধর/নির্বিষ সাপের দংশন, সুতরাং সাপের দংশন মানেই মৃত্যু নয়। মানুষকে বিষধর ও অবিষধর সাপ চেনাতে হবে। সাপ আমাদের কী কী উপকার করে তা মানুষকে বোঝাতে হবে। সাপ দেখলেই অকারণে যেন সাপ না মারে সে ব্যাপারে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা এবং গ্রামাঞ্চলে সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। সাপসহ যে কোনো বন্যপ্রাণী ধরা, মারা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ, এটি জনসাধারণের মাঝে প্রচার করতে হবে।
লেখক: এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, সেলস অপারেশনস, ফেয়ার ডিষ্টিবিউশন লিমিটেড
কেএসকে/জেআইএম