রানি প্রথম এলিজাবেথ যে কারণে কুমারী ছিলেন
রানি প্রথম এলিজাবেথ, এই নামটির সঙ্গে মিশে আছে একজন সফল শাসকের ইতিহাস। তার সময়ে ইংল্যান্ডের মানুষ সবচেয়ে সুখের সময় কাটিয়েছে। তবে বিতর্ক কখনোই পিছু ছাড়েনি রানির। সারাজীবন ছিলেন একজন কুমারী। বিয়ে তো দূরের কথা কোনো পুরুষের সঙ্গে কখনো মেশেননি তিনি। যে কারণে তিনি নারী কি না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল।
রানি প্রথম এলিজাবেথের জন্ম ১৫৩৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের গ্রিনউইচে। তিনি ছিলেন রাজা হেনরি অষ্টম এবং তার দ্বিতীয় স্ত্রী অ্যান বোলেনের কন্যা। তার যখন মাত্র দুই বছর বয়স তখন তার মা অ্যান বোলেনকে শিরশ্ছেদ করে মৃত্যুদণ্ড দেন তার বাবা রাজা হেনরি অষ্টম। এরপর তিনি পালিত হয়েছেন সেবিকাদের কাছে। কিছুদিন সৎ মায়ের কাছেও পালিত হয়েছেন।
রানি এলিজাবেথ ছিলেন প্রখর মেধাবী। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি ঘরে শিক্ষা নিতে থাকেন। সব বিষয়েই পারদর্শী হয়ে ওঠেন তিনি। সংগীত থেকে শুরু করে নানান ভাষা সব বিষয়েই বেশ আগ্রহ ছিল তার। রানি ছিলেন যেমন মেধাবী তেমনি রূপবতী। রাজ্য পরিচালনা করতে গিয়ে বন্ধুর পাশাপাশি প্রচুর শত্রুও তৈরি হয়েছিল তার।
এলিজাবেথ সুন্দরী হলেও বিয়ের ব্যাপারে ছিলেন ঘোর বিরোধী। স্বামী থাকার ধারণাটিকে ঘৃণা করতেন তিনি। তার মা অ্যান বোলেনকে তার বাবা রাজা অষ্টম হেনরি শিরশ্ছেদ করে হত্যা করেছিলেন। এছাড়া তার সৎ বোন ম্যারির স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপসের বিবাহ বিপর্যয় দেখে বিয়ের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন রানি এলিজাবেথ।
রানি তার দেশ ও সাম্রাজ্যেকেই স্বামী ভাবতেন। কুমারী হওয়ার কারণে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এলিজাবেথের সঙ্গে মানুষজন যীশুখ্রীস্টের মাতা ভার্জিন ম্যারির তুলনা করতে থাকেন। অর্ধচন্দ্র এবং মুক্তার মতো প্রতীকগুলো- যা উভয়ই ভার্জিন ম্যারির সঙ্গে যুক্ত ছিল, যা প্রজারা ইংল্যান্ডের রানির সঙ্গে মিলিয়ে দেন। ওয়াল্টার রেলি, বিখ্যাত ইংরেজ অভিযাত্রী (তিনি স্প্যানিশ আর্মাদার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন), তিনি আমেরিকায় একটি বিদেশি উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভার্জিন রানির সম্মানে এটিকে ভার্জিনিয়া নামে অভিহিত করেন। বর্তমানে এটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য।
তবে এজন্য তাকে কম বিতর্কের স্বীকার হতে হয়নি। অনেকে বলে বেড়াতেন রানি এলিজাবেথ নাকি নারীই নন, তাহলে বিয়েটা করবেন কীভাবে! পাছে সব গোমড় ফাঁস হয়ে যায় তাই তিনি বিয়ের ঝামেলায় যাননি। এমনকি তিনি নাকি নারীদের ব্যাপারে বেশি আগ্রহী ছিলেন। যদিও এমন অভিযোগের কোনো প্রমাণ নেই কোথাও।
রানি ছিলেন একজন পুরুষ। এমনটাই দাবি করেন মার্কিন লেখক স্টিভ বেরি তার ‘দ্য কিংস ডিসেপশন’ বইতে। এমনকি বিখ্যাত ড্রাকুলার লেখক ব্রাম স্টোকারও এমনটা দাবি করেছিলেন, টিউডর বংশের যে রানি প্রথম এলিজাবেথ গোটা ইংল্যান্ড শাসন করেছিলেন তিনি ছিলেন একজন পুরুষ।
এই মিথ ছড়ানোর আরও একটি কারণ আছে বটে। স্পেনের তৎকালীন শাসক তার বড় ছেলের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দিলে এলিজাবেথ তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন কেন? যার কারণে স্পেনের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল তাকে। মার্কিন লেখক স্টিভের প্রশ্ন, বিবাহ সম্পর্ক তৈরি করে যে যুদ্ধ অনায়াসেই এড়াতে পারতেন, তাতে কেন জড়িয়ে পড়লেন রানি? আসলে তিনি নিজের আসল পরিচয় ঢাকতেই বিয়ে করেননি।
রানি যে নারী নন, পুরুষ এবং তিনি যে রাজা হেনরি অষ্টম এবং তার দ্বিতীয় স্ত্রী অ্যান বোলেনের আসল কন্যা এলিজাবেথ নন, এ কথাও ছড়িয়ে পড়েছিল ইংল্যান্ডজুড়ে। ১৮০০ শতকে বিসলেতে একটি কফিন আবিষ্কার করেন একজন ধর্মগুরু। যিনি দাবি করেন কফিনে থাকা মৃতদেহটি রেনেসাঁর উচ্চ-শ্রেণির কোনো অল্পবয়সী মেয়ের। তার পরনের পোশাক ছিল সে সময়ের অত্যন্ত দামি। যা ওয়ি গ্রামের কোনো মেয়ের পরার কথা না। আবার সেই মেয়ের চুল ছিল লালচে। যা থেকে ধারণা করা হয় সেই কফিনে রানি এলিজাবেথের মৃতদেহই ছিল। যা গোপনে তার সেবিকা কবর দিয়েছিলেন।
এই মিথের জোড়ালো হওয়ার আসল কারণ হলো, এলিজাবেথের বয়স ১০ বছর তখন ইংল্যান্ডে বুবোনিক প্লেগের মহামারি শুরু হয়েছিল। যার কারণে অনেক মানুষ মারা যায়। রাজা হেনরি তার মেয়েকে বাঁচাতে সৈন্য সামন্তসহ পাঠিয়ে দেন বিসলে নামে একটি গ্রামে। সেখানেই থাকতে শুরু করে ছোট্ট এলিজাবেথ। তবে তিনি কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে মারা যান। যা রাজার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখে তার সেবিকা।
প্লেগের প্রাদুর্ভাব কেটে যাওয়ার পর রাজা তার মেয়েকে আনতে যান। এ খবর শুনে আকাশ ভেঙে পরে সেই সেবিকার মাথায়। নিজেকে বাঁচাতে তিনি এক সিদ্ধান্ত নেন। রাজাকে তার মেয়ের মৃত্যুর কথা কিছুতেই জানাবেন না। এতে তার জীবনটাই হারাতে হবে। লাল চুলের কোনো মেয়েকে রাজকন্যা এলিজাবেথ সাজাবেন। কিন্তু এমন কোনো মেয়েকেই গ্রামে খুঁজে পাননি। শেষ পর্যন্ত একটি ছেলেকে রাজকন্যা এলিজাবেথের পোশাক ও পরচুলা পরিয়ে নিয়ে যান রাজার সামনে।
এলিজাবেথ নারী নন পুরুষ। এই প্রমাণের কখনো চেষ্টাই করেননি তিনি। এই বিশ্বাস তার প্রজাদের মধ্যে আরও জোড়ালো হয় তখন, যখন তিনি বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে থাকেন একের পর এক এবং ১৫৫৮ সালে সিংহাসনে বসার পর প্রথম এলিজাবেথ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন বিয়ে করবেন না। এছাড়া নির্বাচিত কয়েকজন দাসী ছাড়া তার কক্ষে কেউ ঢুকতে পারত না। তার বিশ্বস্ত কয়েকজন চিকিৎসকই কেবল তার চিকিৎসা করতেন। তিনি জনসম্মুখে পরচুলা পরতেন। এছাড়া তার মৃত্যুর পর তার মৃতদেহ ময়নাতদন্ত করা নিষেধ ছিল কঠোরভাবে।
- আরও পড়ুন
সবচেয়ে চওড়া জিহ্বা এখন তার
লেখক স্টিভের দাবি, এই সত্য শুধু জানতেন এলিজাবেথের চিফ মিনিস্টার উইলিয়াম সেসিল। সেসিল অবশ্য শেষ দিন পর্যন্ত সেই রহস্য ফাঁস করেননি। স্টিভের মতে, এর কারণটা ছিল সত্যিটা ফাঁস হয়ে গেলে ব্রিটেনে গৃহযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ত। কারণ টিউডর বংশের উত্তরাধিকারি হিসেবে তখন সে অর্থে সিংহাসনের আর কেউ দাবিদার নেই। তাই বাধ্য হয়েই মুখ বন্ধ রেখেছিলেন সেসিল।
স্টিভ তার বইতে আরও দাবি করেন, লন্ডনে ফেরার পর যখন ফের লেখাপড়া শুরু করেন কিশোরী এলিজাবেথ, তখন তার স্বভাব, আচরণের পরিবর্তন দেখে প্রচণ্ড বিস্মিত হন তার গৃহশিক্ষক। এমনকি নরম, পেলব এলিজাবেথের শারীরিক গড়ন পাল্টে পুরুষালি হতে থাকে। এলিজাবেথের আগের ও পরের ছবির মধ্যে সেই ফারাক স্পষ্ট।
তবে অনেক ইতিহাসবিদ এই যুক্তির বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়েছেন। যে রাজা গোটা বিশ্বের প্রায় অর্ধেক শাসন করেছেন তিনি তার নিজের মেয়েকে চিনতে পারবেন না তা কিছুতেই হতে পারে না। এছাড়া রানির শারীরিক গড়ন ছিল মেয়েদের মতোই। রানির অন্যান্য নারীদের মতোই নিয়মিত পিরিয়ড হতে বলে তার চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন তার মৃত্যুর পর।
সে যাই হোক আজ রানি প্রথম এলিজাবেথের জন্মদিন। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন খুবই সাধাসিদে। নাটক, নাচ খুব ভালোবাসতেন। পড়ালেখার পাশাপাশি তার ফ্যাশনে বেশ সচেতন ছিলেন। তিনি গহনা এবং চমৎকার পোশাক পছন্দ করতেন এবং তার পোশাকগুলো প্রায়শই সোনা এবং রৌপ্য দিয়ে তৈরি ছিল। তিনি মেকআপের সাহায্যে একটি আকর্ষণীয়ভাবে ফ্যাকাশে চেহারা অর্জন করেছিলেন। তার এই আকর্ষণীয় চেহারা এবং রূপচর্চা নিয়েও আছে নানান বিতর্ক।
তিনি চেহারাকে ধূসর, সাদা ও আরও সুন্দর করে তুলতে মুখে জোঁক লাগিয়ে রাখতেন। জোঁকেরা মুখ থেকে রক্ত চুষে নিতো। ফলে রক্তহীনতায় মুখ হয়ে যেত ফ্যাকাশে। কথিত আছে, চারশো বছর আগেই রূপচর্চার কারণে মারা যান রানি প্রথম এলিজাবেথ। নিখুঁত মেকআপের বহরই ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল রানিকে। এ তথ্য একেবারেই মনগড়া নয়। চিকিৎসক এবং ঐতিহাসিকদের বিশ্লেষণই ইঙ্গিত দেয় এমনটার।
সূত্র: অল দ্যট ইন্টেরেস্টিং, হিস্টোরি মিস্টেরিয়াস
কেএসকে/জেআইএম